Advertisement
E-Paper

Ravi Bishnoi: জোধপুরের যোদ্ধা

চলত রবি বিষ্ণোইয়ের নীরব ক্রিকেট সাধনা। সব লড়াই, অধ্যবসায়ের পুরস্কার পেলেন বুধবারের ইডেনে। একের পর এক গুগলির ইন্দ্রজালে যখন দিশেহারা দেখাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটিংকে, নিশ্চয়ই জোধপুরের বাড়িতে বসে বাবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিনটার কথা।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৬:৫৭
হুঙ্কার: ইডেনে উইকেট নিয়ে উল্লাস বিষ্ণোইয়ের। বুধবার।

হুঙ্কার: ইডেনে উইকেট নিয়ে উল্লাস বিষ্ণোইয়ের। বুধবার। ছবি বিসিসিআই।

বাবা সরকারি স্কুলের হেডমাস্টার। পুত্রের তাই ক্রিকেট মাঠে ছুটে যাওয়া সহজ ছিল না।

কড়া অনুশাসনের মধ্যে বড় হওয়া। পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোনও কিছুই করা যাবে না। রাজস্থানের জোধপুরে কে আবার ক্রিকেট খেলে! প্রায়ই ভাইকে নিয়ে লুকিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে হত ক্রিকেট খেলবেন বলে। বিশেষ করে রবিবার। বাবা যেন জানতে না পারেন।

ভয়ে-ভয়ে সারাদিন ক্রিকেট খেলা। আবার বাবার চোখের আড়ালে সন্ধে হওয়ার আগেই চুপটি করে বাড়ি ঢুকে পড়ো। দাঁড়ান, শেষ হয়নি। কোথায় খেলতেন তিনি? না, এমন এক মাঠ, যা ক্রিকেটের জন্য কম, বেশি ব্যবহার হত বাস গুমটি হিসেবে। এর মধ্যেই ললিত মোদীকে নিয়ে বিতর্ক আছড়ে পড়ল। রাজস্থান ক্রিকেট যেন আরওই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত হতে থাকল। আরওই তলিয়ে যেতে থাকল দেশের ক্রিকেট মানচিত্র থেকে।

তার মধ্যেই চলত রবি বিষ্ণোইয়ের নীরব ক্রিকেট সাধনা। সব লড়াই, অধ্যবসায়ের পুরস্কার পেলেন বুধবারের ইডেনে। একের পর এক গুগলির ইন্দ্রজালে যখন দিশেহারা দেখাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটিংকে, নিশ্চয়ই জোধপুরের বাড়িতে বসে বাবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই দিনটার কথা। যখন ছেলেকে কাঁদতে দেখে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘আর ক্রিকেট খেলে কাজ নেই। পড়াশোনায় মন দাও।’’ সেই সময় রাজস্থানের যুব দলের ট্রায়াল দিতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন বিষ্ণোই। মাথার উপর পৃথিবী ভেঙে পড়ার উপক্রম।

‘‘আমি ব্যর্থ হয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি, ব্যর্থ হয়েছি। তাই তো আমি সফল।’’ মাইকেল জর্ডানের এই বিখ্যাত উক্তি কি কেউ তাঁর কানে মন্ত্রের মতো ঢুকিয়ে দিয়েছিল? কে জানে!

ইডেনে অভিষেকেই ম্যাচের সেরার পুরস্কার নিতে দেখে মনে-মনে হাসছিলেন নিশ্চয়ই বিষ্ণোই পরিবারের আর এক জন। তাঁর মা। বাবার কড়া শাসনের মধ্যে ছেলেকে যিনি প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে। মা নিজেও যে ক্রিকেটের বড় ভক্ত! ভারতের ম্যাচ মানেই টিভির সামনে থেকে নড়বেন না। ছেলে খেললে তো কথাই নেই! ইডেনে রবি-উদয়ে সব চেয়ে গর্বিত হওয়ার দিন তাঁর। চার ওভারে ১৭ রান দিয়ে দুই উইকেট। বিষ্ণোই একা বল করেননি বুধবারের ইডেনে। প্রত্যেকটি বলের দৌড়ের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তাঁর মায়ের চোয়াল শক্ত করা প্রতিজ্ঞা, সমর্থন আর নীরব প্রার্থনা। মায়েরা যেমন করে থাকেন, আর কী!

অভিষেক ম্যাচে তাঁর হাতে ইন্ডিয়া ক্যাপ তুলে দিলেন আর এক লেগস্পিনার যুজ়বেন্দ্র চহাল। বিরতিতে যখন বিষ্ণোই বলছিলেন, ‘‘আমি উত্তেজিত ছিলাম তবে কিছুটা স্নায়ুর চাপেও ভুগছিলাম,’’ মনে হচ্ছিল তখনও অভিষেকের ধুকপুকানি কমেনি তাঁর। অথচ কী বীর বিক্রমেই না একের পর এক গুগলি নিক্ষেপ করে যাচ্ছিলেন। কে না জানে, লেগস্পিনারের সব চেয়ে কলজের জোর লাগে গুগলি করতে গেলেই। সামান্য এদিক-ওদিক হওয়া মানেই তো গ্যালারিতে বল উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। বিশেষ করে এই সব ক্যারিবিয়ান পাওয়ার-হিটারদের গদার সামনে।

কী ছিল তাঁর রণনীতি? সম্প্রচারকারী চ্যানেলের সামনে বলে গেলেন প্রথম ম্যাচের নায়ক, ‘‘স্টাম্পে-স্টাম্পে বল করে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি জানতাম, ওদের শক্তি আছে। হাত খোলার সুযোগ দিলে মেরে দেবে।’’ কী অসম্ভব পরিণত মস্তিষ্ক! দেশের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলছেন, কে বলবে! স্পিনার মানেই বোধ হয় এমন চিন্তাশীল মনন। যিনি তাঁর হাতে ইন্ডিয়া ক্যাপ তুলে দিলেন, সেই চহাল যেমন দাবা খেলেন। মস্তিষ্ককে শান দেওয়ার জন্য। কুম্বলে বরাবর মেধাবী ক্রিকেটারের মুখ ছিলেন। অশ্বিনও তাই। এঁদের প্রত্যেকেই রয়েছেন বিষ্ণোইয়ের পছন্দের তালিকায়। তিনি নিজে? এই দলের নতুন হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড় খুব বই পড়তে ভালবাসেন। যদি বই সঙ্গে নিয়ে ফ্লাইট ধরতে ভুলে যান রাহুল, তরুণ লেগস্পিনারের হ্যান্ড ব্যাগেজে ঢুঁ মারতে পারেন। বেস্টসেলার পেয়ে যাবেন।

বড় হয়েছেন শেন ওয়ার্নের ভিডিয়ো ইউটিউবে দেখে। যাঁকে বিষ্ণোই ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ মানেন। যুব দলের কোচ থাকার সময় দ্রাবিড় তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার সঙ্গে কুম্বলের মিল রয়েছে। দু’জনেই জোরের উপরে লেগস্পিনটা করাও।’’ কুম্বলের মতোই লেগস্পিন কম করেন তিনি, যদিও এত দ্রুত তুলনা টানার বোকামি কেউ করবে না। তবে দ্রুতগতিতে ছিটকে আসা গুগলির স্রোত সব চেয়ে বেশি মনে করাচ্ছিল প্রয়াত আব্দুল কাদিরকে। পাক লেগস্পিন জাদুকর যদি আজ বেঁচে থাকতেন! অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দ্রাবিড় আর আইপিএলে পঞ্জাব কিংসে কুম্বলে। এক জন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের প্রাচীর হলে অন্য জন বোলিংয়ের কুতুব মিনার! দুই কিংবদন্তির অমূল্য পরামর্শে ধারালো হয়েছেন বিষ্ণোই। ভারতীয় যুব দলের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেই উত্থান তাঁর। কিন্তু ওই পর্যন্ত পৌঁছনোর কাহিনিটাই যে চমকপ্রদ! জোধপুরে কোথায় ছিল ক্রিকেট স্বপ্ন লালন করার সুযোগ? ঠিক মতো প্র্যাক্টিসের বন্দোবস্তই তো নেই। বছর দশেক আগে তাঁর দুই পুরনো বন্ধু শাহরুখ পাঠান এবং প্রদ্যোৎ সিংহ ঠিক করলেন, অ্যাকাডেমি গড়বেন। কিন্তু কারও কাছে পয়সা নেই। অগত্যা নিজেরাই শ্রমিকের কাজ করলেন। বিশেষজ্ঞ এনে পিচ তৈরির খরচটুকু জোগাড় হল। বাকিটা, পাথর ভাঙা থেকে শুরু করে সিমেন্ট বয়ে নিয়ে যাওয়া— লেবারের কাজ পুরোটাই করতে হয়েছিল তাঁদের। নিজেরা পাঠশালা তৈরি করলেন। সেখানেই লেগস্পিনের তালিম নিলেন। তার পরে ইডেনের পরীক্ষাগারে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে বেরোলেন। আদর্শ ওয়ার্ন, কুম্বলে বা অশ্বিনের মতো লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হতে পারবেন কি না, সময় বলবে। কিন্তু আপাতত ভারতীয় ক্রিকেটের নবতম সিন্ডেরেলা কাহিনি হিসেবে যে উদয় হলেন, সন্দেহ নেই।

আর জোধপুর?

কত সব বড় বড় পরিচালকেরা সেখানে ঘুরে গিয়েছেন। কেল্লার শহরের শোভা তাঁদের ফিল্মে ব্যবহার করবেন বলে। ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজ়েস’-এর ক্রিস্টোফার নোলান। কে জানত, বর্জিত, উপেক্ষিত ক্রিকেট ভিতরে ভিতরে গজরাচ্ছে গুগলির গোলায় রাজপুতদের ইতিহাস সমৃদ্ধ শহরকে জবাব দেওয়ার জন্য।

কে বলল, জোধপুরে শুধু শুটিংই হয়! ওই তো ইডেনের সবুজ মখমলে ডানা মেলে উড়ছেন তিনি— রবি বিষ্ণোই! ফিল্মি নয়, রক্তমাংসের সুপারহিরো!

Ravi Bishnoi India West Indies
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy