১০ ইনিংস। ১২৮ রান। ৯৯ স্ট্রাইক রেট। আইপিএলের এই পরিসংখ্যান কোনও বোলারের নয়। ২৭ কোটি টাকার ঋষভ পন্থের। আইপিএল বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত লখনউ সুপার জায়ান্টসের অধিনায়ককে চেনা ফর্মে দেখা যায়নি একটি ম্যাচেও। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন তিনি। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি কেন হল দেশের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের?
পন্থকে আউট করার জন্য ভাল বল করার প্রয়োজন হচ্ছে না প্রতিপক্ষ দলের বোলারদের। ভুল শট খেলে উইকেট ছুড়ে দিয়েছেন একাধিক ম্যাচে। আউট হয়েছেন সহজ বলেও। ব্যাটে রান না থাকায় ব্যাটিং অর্ডারের বিভিন্ন জায়গায় দেখা গিয়েছে পন্থকে। কোনও ম্যাচে ওপেন করেছেন, কোনও ম্যাচে ব্যাট করতে নেমেছেন সাত নম্বরে। আবার কোনও ম্যাচে নিজেকে ক্রমশ পিছোতে পিছোতে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করতেই নামেননি! কার্যত পালিয়ে গিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় এবং পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নেমেও সাফল্য পাননি পন্থ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনার ধাক্কা সামলে গত বছর আইপিএলের আগে ২২ গজে ফিরেছিলেন পন্থ। দিল্লি ক্যাপিটালসকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ক্রিকেটার পন্থকেও দেখা গিয়েছিল চেনা ছন্দে। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ভারতের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পন্থের। অথচ তার পর থেকে পন্থকে চেনা যাচ্ছে না ২২ গজে। ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে এবং অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট সিরিজ়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারেননি। বেশ কয়েক বার কঠিন পরিস্থিতিতে উইকেট ছুড়ে দিয়েছেন। দলকে ভরসা দিতে পারেননি। অনর্থক আগ্রাসী ব্যাটিং করে এবং বার বার একই ভুল করে দলকে ডুবিয়েছেন। আস্থা হারিয়েছেন কোচ গৌতম গম্ভীরের। গত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একটি ম্যাচেও ভারতের প্রথম একাদশে জায়গা হয়নি তাঁর। জাতীয় নির্বাচকেরা তাঁকে প্রথম উইকেটরক্ষক হিসাবে নির্বাচিত করলেও গম্ভীর অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন লোকেশ রাহুলকে। শুধু তা-ই নয়। ভারতের টি-টোয়েন্টি দলেও অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে সঞ্জু স্যামসনকে।
পন্থ ভেবেছিলেন, তাঁকে বিপুল দাম দিয়ে আইপিএলের নিলামে কিনে নেবে পঞ্জাব কিংস। কারণ, নিলামের আগে সবচেয়ে বেশি টাকা ছিল পঞ্জাবের কাছে। তা ছাড়া গত বছর পর্যন্ত দিল্লির কোচ রিকি পন্টিং এ বার পঞ্জাবের দায়িত্বে। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়কের সঙ্গে পন্থের সম্পর্কও যথেষ্ট ভাল। সে কারণে দিল্লির আর্থিক প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলামে ভাগ্যপরীক্ষা করতে নেমেছিলেন। আইপিএলের নিলাম হতাশ করেনি পন্থকে। পছন্দের পঞ্জাবের হয়ে খেলার সুযোগ না হলেও পন্থকে পেতে বেশ কয়েকটি দল ঝাঁপিয়েছিল। তাতে লক্ষ্মীলাভ হয় তরুণ উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের। রেকর্ড ২৭ কোটি টাকায় পন্থকে কেনেন লখনউ কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েন্কা।
দাম পেলেও তার মূল্য দিতে পারছেন না পন্থ। এ বারের আইপিএলে মাত্র চারটি ম্যাচে ১০ রানের গণ্ডি পেরিয়েছে তাঁর ব্যাট। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে ১৫, গুজরাত টাইটান্সের বিরুদ্ধে ২১, চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে ৬৩ এবং পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে ১৮। একমাত্র চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধেই পন্থের ব্যাটিং ঋষভসুলভ দেখিয়েছিল।
কেন এমন দুর্দশা ক্রিকেটার পন্থের? ভারতীয় দলের প্রাক্তন সদস্য রবীন উথাপ্পা বলেছেন, ‘‘ব্যাটার পন্থ দ্বিধায় ভুগছে। ওর ব্যাটিংয়ে যা স্পষ্ট। কোন বল কী ভাবে খেলবে বুঝতে পারছে না। কোথায় ব্যাট করতে নামবে, সেই সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না। এমন এমন জায়গায় ব্যাট করতে নামছে, যেখানে ব্যাট করতে অভ্যস্ত নয়। আব্দুল সামাদকে আগে নামাচ্ছে! আসলে কিছুই ঠিকমতো করতে পারছে না। পন্থ বুঝতেই পারছে না, ওর কী ভূমিকা হওয়া উচিত।’’ উথাপ্পার মতে, ২০ ওভারের ক্রিকেটে ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বরে নামা উচিত পন্থের। তিনি বলেছেন, ‘‘২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তিন নম্বরে ব্যাট করেছে পন্থ। ওটাই ওর জায়গা। মাঠে নেমে বোলারদের শাসন করাই ওর পছন্দ।’’
উথাপ্পার মতোই পন্থকে দেখে হতাশ নভজ্যোৎ সিংহ সিধু। তিনি বলেছেন, ‘‘আসল সমস্যা হল শট নির্বাচন। চালিয়ে খেললেই সমস্যার সমাধান হয় না। হতে পারে পন্থ চাপে রয়েছে। দাম, নেতৃত্ব, রেকর্ড, প্রত্যাশা— সব কিছু নিয়ে তৈরি হওয়া চাপ সামলানো সহজ নয়। পন্থ চাপ সামলাতে পারছে না। হতাশা দেখা যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না অনেক সময়। আগে যে বলগুলো অনায়াসে মাঠের বাইরে পাঠাত, এখন সেগুলো মারতেই পারছে না!’’
পন্থকে ফর্মে ফেরার দাওয়াই কয়েক দিন আগে বাতলে দিয়েছিলেন বীরেন্দ্র সহবাগও। পরামর্শের সুরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘তোমার কাছে একটা মোবাইল ফোন আছে। যে কাউকে ফোন করতে পারো। তোমার মাথায় যদি নেতিবাচক চিন্তা আসে, তা হলে কারও সঙ্গে আলোচনা করতে পার। অনেক ক্রিকেটার রয়েছে, যারা তোমাকে পরামর্শ দিতে পারবে। তোমার আদর্শ তো মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ওকেই ফোন করো। কথা বললে অনেকটা হালকা হতে পারবে।’’
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই মনে করছেন, পন্থ চাপ সামলাতে পারছেন না। বাড়তি কিছু করার তাগিদে ভুল করছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে আরও চাপে পড়ে যাচ্ছেন। ২৭ কোটি টাকাই কি কাল হল দেশের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটারের?