Advertisement
E-Paper

২৭ বছর পর ঘুচল ‘চোকার্স’ তকমা, শাপমুক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার, অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে টেস্ট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন বাভুমারা

১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার সাড়ে তিন দশক পর টেস্ট ক্রিকেটের সিংহাসনে বসল তারা। ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচালেন বাভুমা, মার্করামেরা।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫ ১৭:১৫
cricket

টেস্ট বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স।

এক কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের হাত ধরেই স্বাধীন হল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট।

১৯১১ সালে ব্রিটিশ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল মোহনবাগান। পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই জয়ে যা গুরুত্ব ছিল তার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় কোনও অংশে কম নয়। অ্যাপার্থেইড পলিসি (বর্ণবিদ্বেষ)-র কারণে ২১ বছর নির্বাসনে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরে এসে ১৯৯৮ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল বটে, কিন্তু বিশ্বক্রিকেটে কৌলিন্য পায়নি। উল্টে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল থেকে জুড়ে গিয়েছে ‘চোকার্স’ তকমা। একের পর এক বিশ্বকাপে সেই তকমার আঁঠা আরও গাঢ় হয়েছে। বলা হয়েছে, বড় ম্যাচের চাপ নিতে পারে না তারা। অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, জাক কালিস, এবি ডিভিলিয়ার্সেরা সেই তকমা মুছতে পারেননি। তা ঘোচালেন টেম্বা বাভুমা, এডেন মার্করাম, কাগিসো রাবাডারা। বিশেষ করে বলতে হয় মার্করামের কথা। ১৩৬ রান করে তিনি যখন সাজঘরে ফিরছেন, তত ক্ষণে দলের জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।

২৭ বছর পর আরও এক বার আইসিসি ট্রফি জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার সাড়ে তিন দশক পর টেস্ট ক্রিকেটের সিংহাসনে বসল তারা। চাপে পড়লেও যা তারা আর ‘চোকার্স’ নন তা দেখালেন বাভুমা, মার্করামেরা। যে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেই তকমা জুটেছিল, সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই তা মুছল। দ্বিতীয় ইনিংসে কামিন্স, স্টার্ক, হেজ়লউডদের তেমন সুযোগ দিলেন না বাভুমা ও মার্করাম। উল্টে যত সময় গড়াল তত কাঁধ ঝুঁলে গেল কামিন্সদের। নইলে কেন এত রক্ষণাত্মক হয়ে পড়লেন অসি অধিনায়ক। যেখানে উইকেট তোলা ছাড়া গতি নেই সেখানে বাউন্ডারিতে ফিল্ডার রাখলেন। বোঝা গেল, দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের পথে বিলম্ব করা ছাড়া আর কোনও পরিকল্পনা নেই তাঁর। হার মেনে নিয়েই বোধহয় চতুর্থ দিন খেলতে নেমেছিল অস্ট্রেলিয়া। তাদের শরীরী ভাষা সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। তাই কামিন্স, স্টার্কেরা একক দক্ষতায় উইকেট তুললেও তাতে দক্ষিণ আফ্রিকার জয় আটকাতে পারলেন না।

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ব্রিটিশদের হাত ধরে ১৮৮০ সালে সেখানে ক্রিকেট শুরু। ধীরে ধীরে তার বিস্তার। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পর তারাই তৃতীয় দেশ যারা টেস্ট খেলেছে। এই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে ঝড় বয়ে গিয়েছিল ১৯৭০ সালে। সেই সময় তাদের ক্রিকেটে অ্যাপার্থেইড পলিসি চলছে। কোনও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের নেওয়া হচ্ছে না। তারই শাস্তি পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ২১ বছর নির্বাসিত করা হয় তাদের। আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা কিছু টেস্ট খেলেছিল বটে, কিন্তু তা স্বীকৃতি পায়নি। অবশেষে ১৯৯১ সালে নতুন পলিসি আনার পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার ক্রিকেট খেলার অনুমতি দেয় আইসিসি। দলে নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার রাখতে হবে, সেই মর্মেই আবার ক্রিকেটে ফেরে তারা।

নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার পর ১৯৯২ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই টেস্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে তৎকালীন বিসিসিআই সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান আলি বাখারের ভূমিকা ছিল দেখার মতো। বিশেষ করে ডালমিয়ার উদ্যোগেই হয়েছিল সেই ম্যাচ। কপিল দেবের ভারতের কাছে সেই ম্যাচ হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে দীর্ঘ ২২ বছর পর আবার লাল বলের ক্রিকেটে দেখা যায় প্রোটিয়াদের।

ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পরের বছর ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে প্রথম বার প্রকৃতির কাছে মার খায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রান তাড়া করছিল তারা। ফাইনালে উঠতে দরকার ছিল ১৩ বলে ২২ রান। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়। খেলা শুরু হওয়ার পর ডাকওয়ার্থ লুইস নিয়মে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ বলে ২২ রান। হারতে হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তার সাত বছর পর প্রথম আইসিসি ট্রফি জেতে দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ওঠে তাদের হাতে। সেই শেষ। তার পর থেকে শুধু হতাশা জুটেছে তাদের কপালে। ১১টা আইসিসি প্রতিযোগিতার সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অ্যালান ডোনাল্ডের ‘ব্রেনফেড’ হয়ে রান আউট ক্রিকেটের ইতিহাসে অমর ফ্রেম হয়ে থেকে গিয়েছে।

গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার ২৬ বছর পর। সেখানে ভারতের বিরুদ্ধে একটা সময় জেতার মুখে ছিল তারা। ২৪ বলে দরকার ছিল ২৬ রান। সেখান থেকে হারে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিছুতেই ফাইনালের গণ্ডি পার হতে পারছিল না তারা। চলতি বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে উঠে আবার হারতে হয় তাদের।

দক্ষিণ আফ্রিকার সেই অন্ধকার সময়ে আলোর কিরণ নিয়ে এলেন বাভুমা। ২০১৪ সালে অভিষেক হয় ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির বাভুমার। তিন ফরম্যাটে খেললেও ধীরে ধীরে ছোট ফরম্যাট থেকে বাদ পড়েন তিনি। ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসাবে টেস্টে শতরান করেন তিনি। ২০২১ সালে কুইন্টন ডি’কককে সরিয়ে এক দিনের দলের অধিনায়ক করা হয় বাভুমাকে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কও। ২০২৩ সালে টেস্টের অধিনায়কত্বও পান বাভুমা। টেস্ট অধিনায়ক হিসাবে তাঁর রেকর্ড দেখার মতো। ১০টা টেস্টে অধিনায়কত্ব করে ৯টা জিতেছেন তিনি। একটাও হারেননি। এই ১০টা টেস্টে তাঁর ব্যাটিং গড় প্রায় ৬০। কেরিয়ারে মাত্র ৪টে শতরান করলেও তাঁর কত ৭০, ৮০, ৯০ রানের ইনিংস যে দলকে জিতিয়েছে তা মনে রাখার মতো।

এ বার যে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠবে তা আগে বোঝা যায়নি। শেষ দুটো সিরিজ়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় তারা। সেখানেও তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে বাভুমাকে। বলা হয়েছে, অনেক কম ম্যাচ খেলে ফাইনালে উঠেছে তারা। দুর্বল দলকে ঘরের মাঠে হারিয়েছে। সেখানে ইংল্যান্ড, ভারত সেখানে অনেক বেশি ম্যাচ খেলেছে। ফলে সুবিধা পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এখনও বাভুমাকে কোটার ক্রিকেটারই বলা হয়। তাঁর উচ্চতা নিয়ে মিম হয় সমাজমাধ্যমে। বাভুমা অবশ্য তা নিয়ে বেশি ভাবেন না। ছোটবেলায় তিনি যেখানে ক্রিকেট খেলতেন, সেখানে তিনটে রাস্তা এসে মিশত। তার মধ্যে একটা রাস্তাকে বলা হত লর্ডস। সেই রাস্তায় খেলার বিশেষ সুযোগ পেতেন না বাভুমা। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নামার আগে তিনি বলেছিলেন, “যে লর্ডসে খেলার সুযোগ পেতাম না, সেই লর্ডসে অধিনায়ক হিসাবে খেলতে নামছি। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।” সেই লর্ডসে তিনি শুধু খেললেন না, চ্যাম্পিয়ন হয়ে মাঠ ছাড়লেন।

তৃতীয় দিন খেলা শেষে ডিভিলিয়ার্স বলছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা জিতলে কেঁদে ফেলবেন তিনি। মার্করাম, বেডিংহ্যাম জুটি দলকে জয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি নিশ্চয় কাঁদছেন। এত দিন দুঃখে অনেক বার চোখের জল ফেলেছেন। এ বার আনন্দে তা বাঁধ মানছে না। অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের পর যে দক্ষিণ আফ্রিকা জিততে পারে তা ক’জন ভেবেছিলেন। প্রথম ইনিংসে যেখানে দল ১৩৮ রান অল আউট হয়ে গিয়েছে সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮২ রান তাড়া করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেটাই সম্ভব করলেন বাভুমা ও মার্করাম। দৌড়তে পারছিলেন না বাভুমা। খোঁড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তার পরেও লড়াই ছাড়েননি। স্টার্ক, কামিন্স, হেজ়লউডদের মোকাবিলা করেছেন।

বাভুমা পাশে পেয়েছেন মার্করামকে। প্রথম ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে শতরান করলেন। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে নিজের তৃতীয় শতরান করলেন তিনি। বাভুমা ধীরে খেললেও মার্করাম থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকার স্কোরবোর্ড সচল থাকে। তৃতীয় দিনই শতরান করেছিলেন তিনি। তার পরেও ছাড়েননি। চতুর্থ দিন বাভুমা আউট হওয়ার পরেও খেলে গিয়েছেন। তাঁর ব্যাট থেকে একের পর এক বল বাউন্ডারিতে গিয়েছে আর সাজঘরে বসে হাততালি দিয়েছেন বাভুমারা। শেষ দিকে সামান্য মনঃসংযোগের অভাবে আউট হতে হয় তাঁকে। তত ক্ষণে খেলার ফয়সালা প্রায় হয়েই গিয়েছে। দল যত জয়ের দিকে গেল, গ্যালারিতে বসে মুখের হাসি তত চওড়া হয়েছে প্রাক্তন অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের। গ্যালারিতে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন ডিভিলিয়ার্স। বোঝা যাচ্ছিল আবেগ সামলাতে সমস্যা হচ্ছে। দল জিততেই সাজঘরে যে ভাবে ক্রিকেটারেরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন তাতে বোধা গেল, এই জয়ের স্বাদ কতটা। অবশ্য বাভুমা ভাবলেশহীন। চেয়ারে বসে শুধু হাততালি দিচ্ছেন। তবে তাঁর চোয়াল বুঝিয়ে দিল, কত সমালোচনার জবাব দিয়েছেন তিনি। সত্যিই এক কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের হাত ধরেই শাপমুক্তি হল দক্ষিণ আফ্রিকার।

South Africa Cricket Team australia cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy