খেলাধুলোয় অখ্যাতদের উঠে আসার ঘটনা বা প্রত্যাবর্তনের কাহিনি কোনও নতুন বিষয় নয়। প্রায় প্রতি বছরই এমন ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আসে। তবে ২০২৫ সালটা বাকি বাকি সব বছরের থেকে একেবারেই আলাদা। ক্রিকেট হোক বা ফুটবল, এই বছর অখ্যাতদের উঠে আসার বছর। এই বছর প্রত্যাবর্তনেরও। এই বছর অজস্র কান্না, ব্যর্থতা, না পারা অতিক্রম করে জয়ের সাগরে নিজেদের মেলে ধরার বছর। ‘কোনও দিনই হবে না’ কে মিথ্যা প্রমাণ করে, স্বপ্নকে সত্যি করার জেদ, আকাঙ্ক্ষার সাক্ষী থাকল এই বছর। সেই তালিকায় যুক্ত হল আরও এক দল। দক্ষিণ আফ্রিকা।
চলতি বছর ক্রিকেট ও ফুটবলে ট্রফির খতিয়ান দেখলে বোঝা যাচ্ছে, কেউ প্রথম বার ট্রফি জিতেছে। আবার কেউ দীর্ঘ দিনের ট্রফিখরা কাটিয়েছে। আনন্দবাজার ডট কম সেই দলগুলিকে নিয়েই আলোচনা করল।
হোবার্ট হারিকেন্স (বিগ ব্যাশ লিগ)
আইপিএলের ধাঁচে শুরু হওয়া এই লিগ গত ১৪ বছর ধরে চলছে। কোনও দিন ট্রফি জিততে পারেনি হোবার্ট হারিকেন্স। দু’বার রানার্স হয়েছে। অবশেষে এ বছর খরা কাটিয়ে ট্রফি জিতেছে তারা। নেথান এলিসের নেতৃত্বাধীন দল ফাইনালে হারিয়েছে ডেভিড ওয়ার্নারের সিডনি থান্ডার্সকে। ফাইনালে শতরান করে দলকে জেতান মিচেল ওয়েন। অস্ট্রেলিয়ার যে শহরগুলি ক্রিকেটবিশ্বের কাছে পরিচিত, সেই পার্থ, অ্যাডিলেড বা মেলবোর্নের সঙ্গে এক গোত্রে বসানো হয় না হোবার্টকে। তারাই এ বার বিবিএল জিতে চমকে দিয়েছে।
নিউক্যাসল ইউনাইটেড (ইংলিশ লিগ কাপ ফাইনাল)
ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবলে এক সময় উপরের দিকেই থাকত নিউক্যাসল। গত দুই দশকে তাদের গরিমা অনেকটাই কমে গিয়েছিল। প্রিমিয়ার ডিভিশন থেকে অবনমনও হয়ে গিয়েছিল। অবস্থা বদলায় ২০২১ সালে সৌদি সরকারের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড নিউক্যাসল কেনার পর। প্রচুর অর্থ দিয়ে নামীদামি ফুটবলার কিনতে থাকে তারা। ফল পাওয়া যায় দ্রুত। আবার প্রিমিয়ার লিগের উপরের সারিতে উঠে আসে নিউক্যাসল। কিন্তু ট্রফি আসছিল না কিছুতেই। সেই খরা মিটেছে এ বছর। লিভারপুলের মতো ধারেভারে এগিয়ে থাকা এবং শক্তিশালী ক্লাবকে হারিয়ে লিগ কাপ জিতেছে তারা। ফাইনাল জিতেছে ২-১ গোলে।
বোলোনা এফসি (কোপ্পা ইটালিয়া)
নিউক্যাসলের মতো ইটালির ফুটবলেও এক সময় গরিমা ছিল বোলোনার। কিন্তু দুই মিলান, জুভেন্টাসের দাপটে তারাও এক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে অবনমনও হতে হয়েছে। সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। কোপ্পা ইটালিয়া ফাইনালে তাদের সামনে ছিল এসি মিলান। ড্যান এনদোয়ের একমাত্র গোলে জেতে তারা। লিগে নবম স্থানে শেষ করা দলের এই কৃতিত্ব রাতারাতি নজরে আসে গোটা বিশ্বের। এই সাফল্য কাজে লাগিয়ে আবার ইটালির ফুটবলের মূলস্রোতে ফেরার চেষ্টা করছে বোলোনা।
ক্রিস্টাল প্যালেস (এফএ কাপ)
ইংরেজদের ফুটবলে অন্যতম পুরনো ট্রফি। ইংল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। অখ্যাত দলের কাছে বিখ্যাত দলের হারের উদাহরণও রয়েছে। তবে ক্রিস্টাল প্যালেস যা করে দেখাল তার সঙ্গে কোনও কিছুরই তুলনা হয়। ক্লাবের ১১৯ বছরের ইতিহাসে প্রথম বার এফএ কাপের মতো এত বড় ট্রফি জিতেছে তারা। আজ পর্যন্ত কোনও দিন প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারেনি। জেতার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বড় কোনও ফুটবলারও এই ক্লাবের হয়ে খেলেননি। তারাই ইতিহাস গড়েছে এফএ কাপ জিতে।
আরও পড়ুন:
টটেনহ্যাম হটস্পার (ইউরোপা লিগ)
এ বারের প্রিমিয়ার লিগে অবনমনের এক ধাপ উপরে শেষ করেছে যে দল, তারাই কি না ইউরোপের দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতা জিতছে! সাম্প্রতিক কালে এমন ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য তারা যাদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিল, সেই ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ছিল এক ধাপ উপরে, ১৬ নম্বরে। দু’দলের এই ম্যাচকে ‘দশকের সবচেয়ে বিরক্তিকর’ ফাইনাল হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। টটেনহ্যাম অবশ্য বরাবরই ইংল্যান্ডের ফুটবলে প্রথম সারিতে থেকেছে। শুধু ট্রফিটাই জিততে পারছিল না। ১৭ বছর সেই খরা কেটেছে।
প্যারিস সঁ জরমঁ (চ্যাম্পিয়ন্স লিগ)
ইউরোপের ক্লাব প্রতিযোগিতায় প্যারিস সঁ জরমঁ বিখ্যাত হয়েছিল চলতি শতকে, যখন সেই দলে খেলতে আসেন রোনাল্ডিনহো গাউচো। ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার পরেও এক বছরে সেই ক্লাবে ছিলেন। পরে আবার এই ক্লাব শিরোনামে উঠে আসে ডেভিড বেকহ্যাম যোগ দেওয়ার পর। এই ক্লাবে খেলেই অবসর নেন বেকহ্যাম। সেই ম্যাচে ৪০টি ক্যামেরা তাক করা ছিল শুধু বেকহ্যামের দিকেই। পরিস্থিতি বদলায় কাতারের সংস্থা প্যারিসের মালিকানা কিনে নেওয়ার পর। কিলিয়ান এমবাপে, নেমার, লিয়োনেল মেসি— বিশ্বের তাবড় ফুটবলারদের কিনে নেয় তারা। অথচ ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল এই তিন ফুটবলারকে ছাড়াই!
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আইপিএল)
আইপিএলের ১৮তম সংস্করণ। দলে শুরু থেকে খেলেন বিরাট কোহলির মতো ক্রিকেটার। অথচ সেই বেঙ্গালুরুর ট্রফি জিততে গেল ১৮টি বছর! খরা কাটল এ বার। পঞ্জাব কিংসকে হারিয়ে প্রথম বারের আইপিএল জিতল বেঙ্গালুরু। আইপিএল জয়ী দলগুলির তালিকায় যোগ হল আরও একটি নাম। এত বছর ধরে বেঙ্গালুরু আইপিএলের অন্যতম জনপ্রিয় দল হলেও ট্রফিটাই শুধু ছিল না। মঙ্গলবারের পর থেকে সেই আক্ষেপও আর থাকবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকা (বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ)
১৯৯৮ সালে প্রথম বার কোনও আইসিসি (চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) ট্রফি জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এত দিন সেটাই ছিল প্রথম ও শেষ ট্রফি। বহু বার ট্রফি জয়ের দোরগোড়ায় এসেও তা হাত ছাড়া হয়। তাদের কপালে জুড়ে যায় ‘চোকার্স’ তকমা। একের পর এক বিশ্বকাপে সেই তকমার আঁঠা আরও গাঢ় হয়। তবে ২০২৫ সালে পুরনো সব ব্যর্থতা ভুলে নতুন যাত্রা শুরু হয় তাদের। এ বার অন্যান্য দলের মতো তারাও প্রত্যাবর্তনের কাহিনি লিখল। ২৭ বছর পর আরও এক বার আইসিসি ট্রফি জিতল দক্ষিণ আফ্রিকা। ফাইনালে হারাল অস্ট্রেলিয়াকে। ২১ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ফেরার সাড়ে তিন দশক পর টেস্ট ক্রিকেটের সিংহাসনে বসল দক্ষিণ আফ্রিকা। চাপে পড়লেও যা তাঁরা আর ‘চোকার্স’ নন তা দেখালেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই অন্ধকার সময়ে আলোর কিরণ নিয়ে এলেন বাভুমা। সঙ্গে ছিল পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা দল। আইপিএলে প্রথম বার নিজের পুরনো দলের জয়ের পর নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার জয়েরও সাক্ষী থাকলেন প্রাক্তন অধিনায়ক এবি ডিভিলিয়ার্স।