ডার্বি নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও কাটল না। বল গুছিয়ে ঘরে ফিরছে মোহনবাগান। ছবি: উৎপল সরকার
কলকাতা ডার্বি বুধবার হবে কি না তা নিয়ে দুই প্রধানের লড়াই নতুন দিকে মোড় নিল।
কল্যাণী স্টেডিয়ামে বল গড়ানোর আগেই মাঠের বাইরে শুরু হয়ে গেল অন্য ডার্বি-যুদ্ধ। যা একইসঙ্গে হাস্যকর এবং নাটকীয়।
নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে রাজি হয়ে গেলেও মোহনবাগান আবার নতুন শর্ত দিয়েছে সোমবার। সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু এবং অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত এ দিন রাত আটটায় ক্লাবতাঁবুতে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে দেন, ‘‘আমাদের এ বারের টিম কোনও ম্যাচ কল্যাণী স্টে়ডিয়ামে খেলেনি। তাই প্র্যাকটিসের জন্য অন্তত দু’দিন সময় দিতে হবে কোচ-ফুটবলারদের। ডার্বি আমরা খেলব তবে এক দিন বা দু’দিন পরে।’’
বাগানের নতুন দাবির অর্থ, ৭ সেপ্টেম্বরের বদলে ৮ বা ৯ তারিখ ম্যাচ হলে দল মাঠে নামবে। আপাতত এটাই অবস্থান সবুজ-মেরুনের। এবং সেটা একেবারেই মানতে নারাজ ইস্টবেঙ্গল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর ঘোষণার মিনিট পনেরোর মধ্যে ইস্টবেঙ্গল সচিব কল্যাণ মজুমদার বলে দিলেন, ‘‘আমরা আগেই আইএফএ-কে জানিয়ে দিয়েছি কলকাতা লিগের সূচিতে ৭ সেপ্টেম্বর ডার্বি ম্যাচ রয়েছে। ওই দিন বিকেল তিনটেয় ম্যাচ। আমরা ওই সময়ই মাঠে নামব। ওই দিনের পরে আমরা আর ডার্বি খেলব না। ’’
ইস্ট-মোহনের মাঠের বাইরের যুদ্ধং দেহি মনোভাবে তীব্র সমস্যায় ডার্বির সংগঠক আইএফএ। অনেক টাকা খরচ করে তৈরি কল্যাণীর অস্থায়ী গ্যালারি সোমবার পরিদর্শনের পরে পিডব্লিউডি অফিসাররা সেই গ্যালারি বাতিল করে দেওয়ায় আইএফএ কর্তারা এমনিতেই মুষড়ে পড়েছেন। রাতে দুই প্রধানের কর্তাদের ম্যাচের তারিখ নিয়ে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি এবং অনড় অবস্থানের পর আইএফএ কর্তারা আরও চাপে। আজ, মঙ্গলবার সকালে তড়িঘড়ি সংস্থার পদাধিকারীদের মিটিং ডেকেছেন আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায়। সকাল এগারোটার ওই সভায় হয়তো ঠিক হবে ডার্বির চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ।
কী সিদ্ধান্ত হতে পারে সভায়? উৎপলবাবু বলেন, ‘‘মোহনবাগানের টাটকা চিঠি পেয়েছি। এখন কিছু বলা সম্ভব নয়। আগে সবার সঙ্গে কথা বলি।’’ ম্যাচ কি পিছোতে পারে? আইএফএ সচিব বললেন, ‘‘সবাই কী বলে দেখি।’’ অর্থাৎ ম্যাচ পিছোনোর সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি রাজ্য ফুটবল সংস্থার প্রধান। শোনা যাচ্ছে, আইএফএ কর্তারা ডার্বি জট কাটানোর তিনটে ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা করছেন।
এক) ইস্টবেঙ্গলকে এক দিন পরে (৮ সেপ্টেম্বর) এই ম্যাচ খেলার অনুরোধ করা। আইএফএ-র ধারণা, আইএসএলে খেলা লাল-হলুদের ফুটবলাররা তখনও টিমের সঙ্গে থাকছেন বলে ইস্টবেঙ্গল রাজি হয়ে যেতে পারে। মনে করা হচ্ছে, ইস্টবেঙ্গল কর্তারা রাজি হলে উত্তর ২৪ পরগণা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে তাদের রাজি করানো কঠিন হবে না।
দুই) বাগান কর্তাদের অনুরোধ করা যাতে তাঁরা ডার্বি ৭ সেপ্টেম্বর-ই খেলে দেন। আর কোনও ঝামেলা না করে।
তিন) জট একেবারেই কাটাতে না পারলে ৭ সেপ্টেম্বর-ই ম্যাচ করতে অনড় থাকা। সে ক্ষেত্রে ইস্টবেঙ্গলকে ওয়াকওভার দিয়ে দেওয়া।
জানা গিয়েছে, সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়ে গিয়েছে সোমবার রাত থেকেই। তবে দুই প্রধানের কর্তারাই নিজেদের অবস্থানে এখনও অনড় রয়েছেন বলে খবর। আইএফএ কর্তারা চাইছেন, যে করে হোক ডার্বি করতে। কারণ তাদের সঙ্গে কলকাতা লিগ সম্প্রচার চ্যানেলের চুক্তির অন্যতম অঙ্গ ডার্বি। সেটা-ই না হলে সমস্যায় পড়বে আইএফএ। এমনিতেই তাদের অবস্থা কাহিল। কারণ, কল্যাণীতে ডার্বি হলে সাড়ে সাত হাজারের বেশি দর্শক খেলা দেখতে পারবেন না। পুলিশ সেই অনুমতিই এখনও পর্যন্ত দিয়েছে। ডার্বির দীর্ঘ ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। সাধারণত আশি-নব্বই হাজার দর্শক ছাড়া ডার্বি কখনও হয়নি বাংলায়। ফলে প্রশ্ন উঠছে, বাঙালির চিরকালীন ফুটবল লড়াইয়ের এই দুর্দশার জন্য দায়ী কে? আঙুল উঠছে কিন্তু আইএফএ-র দিকেই।
ইস্টবেঙ্গলে ডংয়ের সেলফি তোলার পালা। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
প্রথমে ভেস্তে যাওয়া টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচের রিপ্লে চাওয়া, পরে সেই ম্যাচের তারিখ নিয়ে ঝামেলা পাকানো, কল্যাণীর মাঠের নিরাপত্তা এবং গ্যালারির ফিট সার্টিফিকেট দাবি— গত কয়েক দিন ধরে বাগান কর্তারা নাটকীয় ভাবে নানা অছিলায় চাপ সৃষ্টি করেছেন আইএফএ-র উপর। এ দিন তাতে নতুন সংযোজন, ডার্বির আগে টিমের অনুশীলনের জন্য অন্তত দু’দিন সময় চেয়ে চিঠি পাঠানো। ক্লাব সূত্রের খবর, সোমবার শঙ্করলাল চক্রবর্তীর টিমকে কল্যাণীর মাঠে অনুশীলন করার জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাগান টিম যায়নি। কেন যায়নি তা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে বাগানে। যার কোনওটাই সে ভাবে যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
ইস্ট-মোহন ঝামেলার মধ্যে আবার এ দিন আইএফএ সচিবের বিরুদ্ধে বাগান প্রেসিডেন্ট টুটু বসু সরাসরি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন। টুটুর দাবি, ‘‘পয়লা সেপ্টেম্বর উৎপলবাবুর সঙ্গে আমি মিটিং করেছিলাম। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ডার্বি নিয়ে দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ম্যাচ পিছোবেন। সেই কথা উনি রাখেননি। এটা আমাকে আঘাত করেছে।’’ যা শুনে আইএফএ সচিবের জবাব, ‘‘বড় ম্যাচের জট কাটানো নিয়ে আমার সঙ্গে ওনার মিটিং হয়েছে ঠিক। তবে ডার্বি পিছব বলে ওনাকে কোনও প্রতিশ্রুতি আমি দিইনি।’’
টুটু-উৎপলের ‘গোপন সভা’-র খবর এ দিন বাগান কর্তারা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ্যে এনে দেওয়ায় পর ইস্টবেঙ্গল সচিব আবার দারুণ চটেছেন। ‘‘নতুন নাটক শুরু হয়েছে। ওরা বলেছিল আইএফএ এখন ইস্টবেঙ্গল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তা হলে এই গোপন সভা হল কী করে? আর ওরা দু’দিন সময় চেয়েছে প্র্যাকটিসের জন্য। এই দু’দিন কবে থেকে শুরু হল? এখানে ফেডারেশনের মতো কড়া শাস্তির ব্যবস্থা নেই বলেই ওরা এ সব করে পার পেয়ে যাচ্ছে,’’ বলে দিয়েছেন লাল-হলুদ সচিব। যা শুনে আইএফএ সচিবের আবার মন্তব্য, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গেও আমি অনেক বার কথা বলেছি নানা সমস্যা মেটাতে। প্রয়োজনে আবার কথা বলব। কথা তো বলতেই হবে।’’
ডার্বি অন্তত এক দিন পিছিয়ে দেওয়ার দাবির পাশাপাশি বেশি টিকিটের দাবিও করেছিল বাগান। তবে সেটা তেমন জোরাল নয়। তাঁদের এখন পাখির চোখ, ডার্বি অন্তত এক দিন পিছিয়ে দেওয়া। একান্তে তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের তৈরি করে দেওয়া তারিখে কিছুতেই খেলব না।’’
তাই কর্তাদের ইগোর লড়াই দাঁড়িয়ে গিয়েছে ৭ আর ৮ সেপ্টেম্বর দু’টো তারিখ নিয়ে। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ফারাকে খেলতে চাইছে দু’দল। নিজেদের অবস্থানে অনড় তারা। আর তাদের নির্ঘণ্টে ম্যাচের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে আইএফএ কোন ফর্মুলায় গোটা ব্যাপার এখন সামলায় সেটাই দেখার!
“মোহনবাগান-টালিগঞ্জ ম্যাচের রিপোর্ট আমি আইএফএ-কে জমা দিয়েছিলাম। সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তও হয়ে গিয়েছে। এই ব্যাপারে আমার আর কী বলার থাকতে পারে! শুধু ম্যাচটা শেষ করতে না পারার একটা অতৃপ্তি রয়ে গিয়েছে। মাত্র এক মিনিট বাকি ছিল ম্যাচ শেষ হতে। হয়তো ওই ম্যাচটা শেষ করাতে পারলে এখন যা ঘটছে এত কিছু ঘটত না।”
—দীপু রায় (ভেস্তে যাওয়া বাগান-টালিগঞ্জ ম্যাচের সেই বিতর্কিত রেফারি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy