Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

টিম গেম আর আক্রমণের ঝড়ে করিমকে ওড়ালেন বাগান কোচ

হতাশায় কপাল চাপড়াচ্ছেন কখনও। কখনও দুই হাত বুকের কাছে তুলে এনে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে গ্যালারির দিকে তাঁকাচ্ছেন। আবার বারবার সুয়োকাদের বল দখলের লড়াইয়ে হেরে যেতে দেখে জলের বোতলেও লাথি মারছেন। করিম বেঞ্চারিফাকে কখনও এমন হতাশ, হালছাড়া, রাগত দেখা যায়নি মাঠে। শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় বৈশাখের আকাশের সব মেঘ যেন নেমে এসেছে মরক্কান কোচের মুখে।

উড়ছেন কাতসুমি। আই লিগে উড়ছে সবুজ-মেরুনও।

উড়ছেন কাতসুমি। আই লিগে উড়ছে সবুজ-মেরুনও।

রতন চক্রবর্তী
পুণে শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৭
Share: Save:

মোহনবাগান-২(জেজে, কাতসুমি)

পুণে এফসি-০

হতাশায় কপাল চাপড়াচ্ছেন কখনও।

কখনও দুই হাত বুকের কাছে তুলে এনে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে গ্যালারির দিকে তাঁকাচ্ছেন। আবার বারবার সুয়োকাদের বল দখলের লড়াইয়ে হেরে যেতে দেখে জলের বোতলেও লাথি মারছেন। করিম বেঞ্চারিফাকে কখনও এমন হতাশ, হালছাড়া, রাগত দেখা যায়নি মাঠে। শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় বৈশাখের আকাশের সব মেঘ যেন নেমে এসেছে মরক্কান কোচের মুখে।

স্টেডিয়ামের মেন গেটের বাইরে মোহনবাগানের টিম বাস ঘিরে চলছিল উৎসব। সনি নর্ডিদের সঙ্গে সেলফিতে ছবি তোলার জন্য হুড়োহুড়ি। সে দিকে না তাকিয়ে করিম সোজা চলে এলেন সাংবাদিক সম্মেলনে। ‘‘মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হবে এটা বলার সময় আসেনি। আরও অনেক অঘটন হবে। দেখুন কী হয়।’’ বলে দিলেন প্রাক্তন বাগান কোচ। যিনি সব ট্রফি দিলেও আই লিগ আনতে পারেননি গঙ্গাপারের ক্লাবে। করিম আসার আগেই বাগান কোচ সঞ্জয় সেন বলে গিয়েছিলেন, ‘‘পুণের মাঝমাঠকে খেলতে দেব না ঠিক করেছিলাম। সেই স্ট্র্যাটেজি কাজে লেগেছে। ওরা তো একটাও গোলের সুযোগ পায়নি।’’ যা শোনানো হল পুণে কোচকে। নীল জামা-প্যান্ট পরে আসা করিমের মুখ দিয়ে বেরোল, ‘‘আমার টিমকে হারিয়ে যে যা পারছে বলে যাচ্ছে। হয়তো আমি কোচ বলেই। আমি কিন্তু কারও বিরুদ্ধে বলি না।’’

মোহনবাগান টিম হোটেলে শুক্রবার রাতে ডিনারের সময় সনিদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ধনরাজ পিল্লাই-এর। একই হোটেলে এয়ার ইন্ডিয়ার টিম নিয়ে উঠেছেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা হকি তারকা। শুনলাম তিনি সনি-কাতসুমিদের বলেছেন, ‘‘কঠিন ম্যাচ জিততে হলে দু’টো জিনিস দরকার। টিম গেম আর লড়াকু মেজাজ।’’ হকির প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের টিপসের জন্য কি না জানা নেই। করিমের পুণের বিরুদ্ধে এই দু’টো শক্তিই অনায়াস জয় এনে দিল সঞ্জয় সেনের টিমকে। ছোট ছোট পাস আর বল তাড়া করে যাওয়া এই দু’টোতেই কেল্লাফতে। খেতাব জয়ের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল পালতোলা নৌকা। শিলংয়ে খারাপ রেফারিংয়ের শিকার হয়ে হারতে হয়েছিল বাগানকে। সেই যন্ত্রণা আগুন লাগানো চরকির মতো ছুটে বেড়ালো বালেওয়াড়ি স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসে। এ দিন সকালে গোটা পূর্ব আর উত্তর ভারতের ভূকম্পন পশ্চিম ভারতে অনুভূত না হোক, পুণেতে বিকেলে করিমের টিম কিন্তু সারাক্ষণ কম্পন টের পেল বাগানের আক্রমণের লাভাস্রোতে। সঞ্জয় সেনের প্রেসিং ফুটবলের ধাক্কা এতটাই ছিল, পাল্টা পুণে দাঁতই ফোটাতে পারেনি বেলোদের উপর। একটা ভাল গোলেরও সুযোগ তৈরি করতে পারেননি এডগার-ডার্কোসরা।

বহু দিন পর বাগান একটা টিমের মতো খেলছে। ওকোলি ওডাফার মতো কারও উপর নির্ভরশীল নয় এই টিম। সনি বা বোয়া বা কাতসুমি কেউই এই টিমের তারকা নন। মণীশ, ডেনসন, প্রীতমদের মতোই তাদের সঙ্গে ব্যবহার করেন বাগান-কোচ। আলাদা কোনও গুরুত্বই পান না তারকারা। কর্তারা মাথা না গলানোয় সঞ্জয়ও নিজের মতো করে টিম সাজাচ্ছেন, অঙ্ক কষতে পারছেন। যেমন এ দিন করলেন।

কাতসুমিকে ব্যবহার করলেন ‘ফেক স্ট্রাইকার’ হিসাবে। জেজের ঠিক পিছনে। মণীশ ভার্গবকে পাঠালেন উইংয়ে। পঞ্জাব তনয় টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়তে শুরু করতেই সব ওলট পালট। অন্য উইংয়ে সোনিও ছিলেন ভয়ঙ্কর। তাঁকে টানা মার খেয়ে যেতে হল। তাতেও কি আটকাতে পারলেন করিম? না। বাগানের দু’টো গোলের পিছনেই হাইতি তারকার অবদান। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তাঁর চোখে জল। বলছিলেন, ‘‘মার খেয়েছি বলে দুঃখ নেই। কিন্ত ম্যাচটা না জিতলে টিমটা চাপে পড়ে যেত।’’ বোয়াকে ধরে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছিলেন করিম। কিন্তু এ দিন সকালেই তাঁর সঙ্গে কথা বলে ক্যামেরুন স্ট্রাইকারকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন বাগান কোচ সঞ্জয়। টিম মিটিং-এ বোয়া বলে দেন, ‘‘আমি নেই তো কী? আমরা জিতবই। আমাদের সামনে রাস্তায় কেউ নেই। জিতে ফেরো। আমাদের সবাই কিন্তু গোল করতে পারে।’’ একাত্মতার এমন সুগন্ধী ফুল বাগানে ইদানীং ফোটেনি। যা এখন শোভা পাচ্ছে।

ফেডারেশন নানা আছিলায় ক্লাবগুলোর টুঁটি টিপে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফ্র্যাঞ্চাইজিদের প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। টাকার লোভে। কিন্তু ক্লাবের আবেগ তাতে আটকানো যাচ্ছে না। পুণে, মুম্বইতে যঁারা চাকরির জন্য চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা সবাই মিলে তৈরি করেছেন মুম্বই-পুণে মেরিনার্স ক্লাব। মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে এসেছিলেন স্টেডিয়ামে। সনি-ডেনসনদের সমর্থনে গলা ফাটাতে। ওই ফ্যানস ক্লাবের জার্সি পরে আসা জনা পঞ্চাশেক সদস্য-সদস্যা চিৎকার করে গেলেন নাগাড়ে, পুণের সমর্থকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তাতে এতটাই জোর ছিল যে পুণের ডিজের বলা ‘‘হু উইল উইন? পুণে...পুণে’’ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। বাইরের মাঠে এসে এই সমর্থন পাবেন সম্ভবত ভাবতেই পারেননি জেজে-সনিরা। ওই শব্দব্রহ্মের জোরেই সম্ভবত বাগান শুরুটা করল দাপট দেখিয়ে। শেষটাও। মাঝে দশ মিনিট বাদ দিলে পুরো মাঝমাঠই ছিল মেরিনার্সদের দখলে। ঝড়ের মতো আক্রমণ তুলতে তুলতেই জেজের গোলটা হয়ে গেল। সনির শটটা পোস্টে লেগে ফিরতেই জেজে গোলটা করে ফেললেন। কাতসুমিকেও গোলের বলটা তুলেছিলেন সনি।

মহারাষ্ট্র সফরের প্রথম ম্যাচ জেতার পর বাগান শীর্ষে থেকে গেল। সফরে রয়েছে আরও দু’টো ম্যাচ। বাগান যে ভাবে মাঠে নেমেই ঝড় তুলছে তাতে সনিদের রোখা মুশকিল। আর তিনটে ম্যাচ জিতলেই বাগানে পাঁচ বছর পর ট্রফি ঢুকবে। একের পর এক বিদেশি কোচ বধ করা সঞ্জয়ের টিম যা খেলছে তাতে সেটা অসম্ভব নয়। করিম বেঞ্চারিফা যতই সংশয়ী হোন। বাগানে বসন্ত কিন্তু এসে গেছে।

মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রীতম, আনোয়ার, বেলো, ধনচন্দ্র, মণীশ (কিংশুক), ডেনসন, শেহনাজ (বিক্রমজিৎ), কাতসুমি, সনি, জেজে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE