মুখোমুখি: সাংবাদিক বৈঠকে নীরজ সোনার পদক দেখাচ্ছেন প্রাক্তন অ্যাথলিট অঞ্জু ববি জর্জকে। ইনসেটে, ক্লাউস বার্তোনিজ়। ছবি পিটিআই।
বছর দুয়েক আগে পুরনো কোচের সঙ্গে সমস্যা দেখা দেওয়ার পরে এক জার্মান বায়োমেকানিক্স বিশেষজ্ঞকে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স সংস্থা দায়িত্ব দেয় নীরজ চোপড়াকে তৈরি করার। গত দু’বছর ধরে সোনাজয়ী নীরজকে একার হাতে তৈরি করেন তিনি। কী রকম ছিল সেই যাত্রাপথ? সামনেই বা এখন কী লক্ষ্য? সব কিছু নিয়ে মঙ্গলবার আনন্দবাজারকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন ক্লাউস বার্তোনিজ়। নীরজের এই গুরুকে এখন ভারতীয় ক্রীড়ামহলে ডাকা হচ্ছে ‘কিং ক্লাউস’ বলে। পদক জয়ের পরের দিনই যিনি টোকিয়ো থেকে ফিরে যান জার্মানি।
প্রশ্ন: এখন কোথায় আছেন আপনি?
বার্তোনিজ়: জার্মানিতে আমাদের একটা ছোট্ট গ্রামে। খুব শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। একেবারে ফ্রান্স সীমান্তের গা ঘেঁষে।
প্র: সোনা জেতার পরের দিনটা কী রকম ছিল আপনাদের?
বার্তোনিজ়: আমি খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলাম। জার্মানি ফেরার বিমান ধরতে হয়েছে সকালেই। তাই ব্যাগ গুছোতেই ব্যস্ত ছিলাম। তবে আগের রাতটা দারুণ কেটেছে। আমি আর নীরজ গেমস ভিলেজে ফেরার পরে সবাই এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানিয়ে যায়। সারা রাত আমাদের গল্পগুজব করে কেটে যায়।
প্র: ২০১৯ সালের শেষ দিকে আপনি নীরজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রথম দেখাতে আপনার কী ভাল লেগেছিল?
বার্তোনিজ়: ওর শারীরিক দক্ষতা এবং মানসিকতা। তখনই বুঝেছিলাম, নীরজ এক জন অলরাউন্ড অ্যাথলিট। মানে ওর মধ্যে নানা ধরনের দক্ষতা আছে। যা এক জন জ্যাভলিন থ্রোয়ারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্র: সেগুলো কী রকম?
বার্তোনিজ়: নীরজ কিন্তু খুব ভাল এক জন ডেকাথেলিট (যেখানে দশটা ইভেন্ট থাকে। একশো মিটার দৌড় থেকে শট পাট, হাই জাম্প) হতে পারত। হাই জাম্পে খুব ভাল। জিমন্যাস্টদের মতো দক্ষতা আছে। এই রকম দক্ষতাসম্পন্ন অ্যাথলিট বলেই আজ নীরজ এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। আর মানসিকতার দিক দিয়ে বলব ওর মতো চনমনে, ফুরফুরে ছেলে আমি কমই দেখেছি।
প্র: জ্যাভলিনে বিজ্ঞান আর বায়োমেকানিক্সের ভূমিকাটা ঠিক কী?
বার্তোনিজ়: জ্যাভলিনের গতি, কী ভাবে সেটা ছুড়তে হবে, হাওয়ার গতি এগুলো সব হিসেব করে ট্রেনিং করাতে হয়। জ্যাভলিনের গতিপথটা কী রকম হলে বেশি দূরে যাবে, সেটাও মাথায় রাখতে হয়। তার পরে সেই অনুযায়ী ট্রেনিং করানো হয়। এ সবই বিজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত। যে রকম টোকিয়োয় নীরজ একটু নিচু করে জ্যাভলিনটা ছুড়েছিল। ওগুলো হাওয়ার গতি, জ্যাভলিনের গঠন দেখে ঠিক করতে হয়।
প্র: এ সবের জন্য কী ভাবে প্রস্তুত করিয়েছিলেন নীরজকে?
বার্তোনিজ়: আমি নীরজকে বলেছিলাম, তোমার শরীরটা একটা ধনুকের মতো হবে। ছিলা থেকে তির বেরিয়ে যাওয়ার মতো জ্যাভলিনটা উড়ে যাবে। নিজেকে ‘ধনুশ’ মনে করবে। আর সেই ‘ধনুশ’ বানানোর জন্য নীরজকে খুব ‘হাই ইনটেনসিটি ট্রেনিং’ করাতে হয়েছিল। অর্থাৎ, যে ট্রেনিংটা খুব দ্রুত গতিতে করতে হবে। নীরজ ওজন তুলত খুব দ্রুততার সঙ্গে। তার পরে খুব দ্রুত হার্ডলের ওপর দিয়ে লাফাতে হত। কখনও এক পায়েও লাফাতে হয়েছে। তার পরে শরীরটা একেবারে বেঁকিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চাবুকের মতো উঠে এসে ভারী বল ছুড়তে হয়েছে। এই রকম ট্রেনিং না হলে ওর পক্ষে জ্যাভলিন ভাল ছোড়া সম্ভব হত না।
প্র: অলিম্পিক্স ফাইনালে নামার আগের রাতে কী মন্ত্র দিয়েছিলেন আপনার ছাত্রকে?
বার্তোনিজ়: আমি শুধু বলেছিলাম, যাও ফাইনালটা উপভোগ করো। যাও মৌজ করো (নিজেই হিন্দিতে বলে হাসলেন)। আসলে ওই সময় নীরজকে ঘিরে প্রত্যাশাটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। অ্যাথলেটিক্সের প্রথম পদক পাওয়ার জন্য সবাই ওর দিকে তাকিয়েছিল। তাই আমি চেয়েছিলাম ওকে চনমনে, চাপমুক্ত রাখতে।
প্র: সোনা জেতার পরে নীরজ নিজে বলেছেন, ৯০ মিটারের উপরে জ্যাভলিন ছুড়তে চান। আপনি কি কোনও লক্ষ্য স্থির করেছেন ওর জন্য? যেমন ১০০ মিটার?
বার্তোনিজ়: ওই ভাবে অত দূরের লক্ষ্য স্থির করে এগোনো যায় না। ধীরে ধীরে এগোতে হয়। আমরা এখন ৯০ মিটারের লক্ষ্য ঠিক করেছি। তার পরে ৯৫ মিটার। এই ভাবে এগোবো। ১০০ মিটার ছুড়বে বলে জার্মানির ইয়োহানেস ফেইটার কী হাল হল দেখলেন তো?
প্র: কী রকম?
বার্তোনিজ়: অলিম্পিক্সের আগে ফেইটা হুঙ্কার দিয়েছিল, ১০০ মিটারের বেশি ছুড়বে। নীরজকে হারাবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজেই ছন্দ হারাল, চোটও পেল। একটা কথা বলি। কেউ কেউ আছে মুখে বড্ড বেশি কথা বলে। কিন্তু কাজের সময় গিয়ে আর পারে না। নীরজ সে রকম নয়। ও অত্যন্ত নম্র। মুখে কোনও বড় বড় কথা নেই। কাজ দিয়েই নিজেকে চিনিয়ে দেয় নীরজ।
প্র: বলা হয়, জ্যাভলিন হল এমন একটা ইভেন্ট, যেখানে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা লাগে। আপনি কি সেটা মাথায় রেখে নীরজকে অনুশীলন করাতেন?
বার্তোনিজ়: অবশ্যই। আমি ওকে জিমন্যাস্টের মতো ট্রেনিং করিয়েছি। ফ্লোর এক্সারসাইজ়, আনইভেন বার, প্যারালাল বার— সবেতে নিয়মিত অনুশীলন চলত। তার পরে স্প্রিন্ট করিয়েছি। যাতে দ্রুত ছোটার ক্ষমতা বাড়ে। ওয়েটলিফ্টারদের মতো ওজন তুলিয়েছি। হাইজাম্প করিয়েছি নিয়মিত। আর তার ফলটাই আপনারা এখন দেখতে পাচ্ছেন।
প্র: দু’বছর আগের ওই চোট থেকে নীরজকে বার করে আনতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছিল আপনাকে?
বার্তোনিজ়: আমরা খুব সতর্ক ভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। নীরজের ডান কনুইয়ে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। শরীরের নীচের অংশের শক্তি ফিরিয়ে আনতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু ‘থ্রোয়িং আর্ম’টা নিয়ে আমরা চিন্তায় ছিলাম। ওর ফিজ়িয়ো ইশান মারওয়াহা দারুণ কাজ করেছে। নীরজ ওর উপরে খুব ভরসা রাখত। প্রায় ছ’মাস লেগেছিল নীরজকে আগের সেই জায়গায় ফিরিয়ে আনতে।
প্র: সামনে এখন কী লক্ষ্য আপনাদের?
বার্তোনিজ়: আমি সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে আবার নীরজের সঙ্গে কাজ শুরু করব। পরের বছর তিনটি বড় প্রতিযোগিতা আছে। যা জিততে চাই। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস এবং বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স। তিনটেতেই ভাল ফল করতে হবে।
প্র: ভারতীয় পরিবেশে কাজ করতে পেরে কেমন লেগেছে?
বার্তোনিজ়: আমার খুব ভালই লেগেছে। সব রকম সুবিধেই পেয়েছি। জাতীয় সংস্থা, জেএসডব্লিউ, সবাই আমাদের পাশে ছিল। না হলে এত বড় সাফল্য আসে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy