ঢাকায় টিম হোটেলে পাক ম্যানেজার ইন্তিখাব আলম। রবিবার। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
পাকিস্তান টিমের প্র্যাকটিস ছিল এ দিন ঐচ্ছিক। যাওয়াটা যার যার ইচ্ছের ওপর। কিন্তু ওই রকম হারের ঠেলায় গিয়েছিল গোটা টিম। সন্ধেবেলা টিম বাস থেকে নেমে নিজের ঘরে যাওয়ার আগে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্তে কথা বললেন পাক টিম ম্যানেজার ইন্তিখাব আলম। বিষয় বিরাট কোহলি, মহম্মদ আমের এবং অবশ্যই গত রাতের মহাযন্ত্রণা...
ইন্তিখাব (প্রশ্ন করার আগেই নিজে থেকে যেন স্বগতোক্তি) কিছু করার নেই। এক দল লোককে আপনি জলের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। পইপই করে বোঝাতে পারেন কী ভাবে জল খেতে হবে। তার পর তারা যদি উন্মাদের মতো ঢক-ঢক করে গোটা জল এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলতে চায় তো আপনি কী করবেন! নেই নেই, সেই ক্লাস নেই। ম্যানেজার কী করবে? কোচ কী করবে?
প্রশ্ন: আপনি এত বছর ধরে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের রান্নাঘর সামলেছেন। আপনাকে এত হতাশ কখনও দেখেছি বলে মনে হয় না। কালকের ৮৩ অলআউট কি এতটাই বিদীর্ণ করে দিয়েছে?
ইন্তিখাব: এডুকেশন নেই। বুদ্ধি নেই। কী করে খেলা হবে? আগেকার পাকিস্তান টিম ভেবে দেখুন তো। মজিদ খান। ইমরান খান। আসিফ ইকবাল। আমি। জাহির। কেউ অক্সফোর্ড থেকে পাশ করেছে, কেউ পাকিস্তানের কলেজে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে।
প্র: কী বলছেন, পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে ক্রিকেটের কী সম্পর্ক? জাভেদ মিয়াঁদাদ কি অক্সফোর্ড গিয়েছিলেন নাকি?
ইন্তিখাব: যায়নি কিন্তু জাভেদ মিয়াঁদাদ ক্রিকেট শিক্ষিত ছিল। ক্রিকেট শিক্ষা থাকলে আর এডুকেশনের দরকার পড়ে না। জাভেদ জানত কোথায় কী করতে হবে। কখন কী করতে হবে। সেই স্ট্রং কমন সেন্স পাচ্ছি কোথায় এখনকার ছেলেদের মধ্যে? নইলে কালকের উইকেটে কেউ ওই রকম ধুম-ধাড়াক্কা খেলে? টি-টোয়েন্টি কি গা জোয়ারি খেলা নাকি যে পেলাম আর মারলাম? এটাতেও টেকনিক লাগে। কোহলিকে দেখেও কি এরা শিখবে না? কী বিউটিফুল ছেলেটা বলল কাল খেলার পর। এই পিচে ধুমধাম মার চলে না। আহা। বোঝালো যে, আমি যত বড় ব্যাটসম্যানই হই না কেন উইকেটকে সম্ভ্রম জানাতে হবে। মনে মনে ওকে কুর্নিশ করেছি কথাটা শুনে।
প্র: এটাই পাক ড্রেসিংরুমে শোনানো উচিত?
ইন্তিখাব: ধুর, জানি না তাতেও কিছু হবে কি না।
প্র: আপনাকে দেখছি প্রায় তিরিশ বছর। পাক ক্রিকেট মহল মনে করে আপনার মাথা বরফের মতো শীতল। সেই আপনি এত ধৈর্যহারা— অবাক লাগছে খুব।
ইন্তিখাব: ধৈর্যহারা নই। এখনও তো আমরা টুর্নামেন্টের বাইরে যাইনি। এশিয়া কাপ ফাইনালে এখনও যেতে পারি। ট্রফি জিততে পারি।
প্র: বিরানব্বই বিশ্বকাপে তো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আপনারা ৭৪ অলআউট হয়ে গিয়েছিলেন। তার পরেও যে ট্রফি জেতেন সেই গল্প নিশ্চয়ই এ দিন টিম মিটিংয়ে ছেলেদের বললেন?
ইন্তিখাব: মিটিং হয়েছে কিন্তু আমি একটা কথাও বলি। বিরানব্বই বিশ্বকাপ নিয়ে তো আগেও বলা হয়েছে। কোনও হেলদোল তাতেও কি হয়েছে? ও সব মনে করিয়ে কোনও লাভ নেই। হওয়ার হলে এমনিতেই হবে।
প্র: মহম্মদ আমেরের কালকের স্পেলটার সময় ডাগ আউটে বসে আপনি কী ভাবছিলেন?
ইন্তিখাব: ভাবছিলাম ওর যদি ওয়াসিমের মতো ইনকাটারটা থাকত! সেই বলটা যেটা ভেতরে ঢুকে আসে। তা হলে ভারত আরও বেশি সমস্যায় পড়ত।
প্র: ওয়াসিম তো নিজে বলেছেন এই বয়সে উনি আমেরের মতো বোলার ছিলেন না।
ইন্তিখাব: ধুর বিনয় করেছে। আমের খুব ভাল। আরও উন্নতি করতে হবে। কিন্তু আমের হল দুর্দান্ত বোলার। আর ওয়াসিম ছিল ম্যাজিশিয়ান। আমায় মাফ করবেন— দুটো এক ক্যাটেগরি নয়।
প্র: আমেরকে কী করতে হবে ওয়াসিম হওয়ার জন্য?
ইন্তিখাব: ওয়াসিম দু’দিকে বল ইচ্ছেমতো মুভ করাতে পারত। বিপজ্জনক বাউন্সার দিত প্রায় এক অ্যাকশনে। পুরনো বলে যা খুশি করত। এত প্রশ্ন করছেন, এ বার আমার অবাক লাগছে। বিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে দু’টো ডেলিভারি ভুলে গেলেন নাকি?
প্র: না না মনে আছে। এ বার বলুন আমের ভার্সেস কোহলি কেমন দেখলেন?
ইন্তিখাব: দারুণ দেখলাম। ওই রকম একটা উইকেটে ছেলেটা ব্যাট করল সব মিড ব্যাট দিয়ে। উফ। এটাই ক্লাস। আমি ধোনির সঙ্গে একমত যে কালকের পিচটা মোটেও টি-টোয়েন্টি-যোগ্য ছিল না। অখাদ্য। কিন্তু মাঝে মাঝে এই সব পিচ বসন্ত বাতাসের মতো। হঠাৎ সুযোগ করে দেয় রিয়েল ক্লাস বোঝানোর। দেখি তো বাবা তুমি সত্যি কেমন? তা কোহলিকে দেখলাম সত্যি ভাল!
প্র: এই প্রজন্মের সচিন বলা শুরু হয়ে গিয়েছে। বাড়াবাড়ি না ঠিক?
ইন্তিখাব: আমার মনে পড়ছিল মার্টিন ক্রো-কে। পাকিস্তান বোলারদের জিজ্ঞেস করুন কে ওদের সবচেয়ে ভাল খেলেছে? ওরা আগে মার্টিন ক্রো-র নাম বলবে। রিভার্স সুইং এত ভাল খেলতে আর কাউকে দেখিনি। আর একজনকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। জাহির আব্বাস।
প্র: কিন্তু অনেকে বলে জাহির ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে কুঁকড়ে থাকতেন।
ইন্তিখাব: সেটা কেরিয়ারের শেষের দিকে। ফার্স্ট হাফে ফাস্ট বোলিং দারুণ খেলত। এজবাস্টনে যে টেস্টটায় জাহির ২৭৪ করেছিল সেই টেস্ট সিরিজে তো আমি ক্যাপ্টেন।
প্র: দুর্ধর্ষ ইনিংস নিশ্চয়ই?
ইন্তিখাব: হ্যাঁ কিন্তু ওকে দেখা হলেই ঠাট্টা করি, তোর ২৭৪ দেখেছি। ২৫৪ দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে তোর স্পেশ্যাল নক একাত্তরের সিরিজে কেন্টের সঙ্গে সেঞ্চুরি। বেস্ট নক।
প্র: একটা কাউন্টি ম্যাচে সেঞ্চুরি বেস্ট নক?
ইন্তিখাব: ইয়েস কারণ ইনিংসটা খেলা হয়েছিল ভিজে পিচে। তখন পিচ কভার ছিল না। কিন্তু বোলার্স রান-আপ ঢাকা ছিল। ওই পিচে জাহির বারবার আন্ডারউডকে তুলে মেরেছিল মিড উইকেট আর মিড অনের মাঝখান দিয়ে। জীবনে কখনও ভুলব না। ভেজা উইকেটে আন্ডারউডকে ওই মার স্বপ্নেই অসম্ভব। জাহির সেটা বাস্তবে করেছিল।
প্র: আপনি কি বলতে চান মীরপুরের কোহলির সঙ্গে কেন্ট মাঠের জাহিরের মিল পেলেন?
ইন্তিখাব: হালকা ছায়া দেখলাম বোধহয়। কালকের উইকেটটা খুব খারাপ ছিল।
প্র: কিন্তু এটা তো টি-টোয়েন্টি?
ইন্তিখাব: হোক না। টি-টোয়েন্টিতেও জবরদস্ত টেকনিক লাগে। কোহলির সেটা আছে।
প্র: এই যে বলা হয় মডার্ন ব্যাটসম্যানকে ভাল বোলিং খেলতে হয় না। তার আমলে চ্যালেঞ্জ অনেক কম?
ইন্তিখাব: কিছুটা ঠিক। কিন্তু যারা বলে তারা ভাবে না মডার্ন ব্যাটসম্যানকে তিন ধরনের ক্রিকেটে দিনের পর দিন সফল হতে হয়। এই চ্যালেঞ্জটাও তো আগে ছিল না। কোহলির নম্বর তাই আমি কমাতে পারলাম না।
প্র: আপনি যেমন কোহলি-কোহলি করছেন লোকের বিভ্রম হতে পারে আপনি পাকিস্তানি ম্যানেজার না ভারতের?
ইন্তিখাব: না সত্যি বলতে কী এর আগে আমি অতটা মন দিয়ে কোহলিকে দেখিনি। কিন্তু কাল এক রাত্তিরে ছেলেটা আমায় অনুরাগী বানিয়ে দিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy