Advertisement
E-Paper

পিংলা থেকে কমনওয়েলথ

পিংলা ব্লকের করকাই গ্রাম। এই গ্রামেরই মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিলেন। বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না। তবুও হাল ছাড়েননি। লড়াকু প্রণতি নায়েকের কথা শুনলেন সৌমেশ্বর মণ্ডলপিংলা ব্লকের করকাই গ্রাম। এই গ্রামেরই মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় কমনওয়েলথ গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিলেন। বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল না। তবুও হাল ছাড়েননি। লড়াকু প্রণতি নায়েকের কথা শুনলেন সৌমেশ্বর মণ্ডল

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৪৭
লড়াকু: জিমন্যাস্টিক্সের আন্তর্জাতিক মঞ্চে চেনা নাম প্রণতি। ছবিটি তাঁরই সৌজন্যে প্রাপ্ত।

লড়াকু: জিমন্যাস্টিক্সের আন্তর্জাতিক মঞ্চে চেনা নাম প্রণতি। ছবিটি তাঁরই সৌজন্যে প্রাপ্ত।

প্রশ্ন: ছোটবেলা থেকেই কি মেদিনীপুরে?

উত্তর: না। ছোটবেলা কেটেছে ঝাড়খণ্ডে।

প্রশ্ন: মেদিনীপুরে কবে আসা হল?

উত্তর: পড়াশোনার জন্য আসা। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মামাবাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলা ব্লকের করকাই গ্রামে চলে আসি। এখানেই শুরু পড়াশোনা। পরে বাবা মা করকাইয়ে বাড়ি করে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান।

প্রশ্ন: ছোটবেলার স্মরণীয় ঘটনা?

উত্তর: চার বছর বয়সে উঁচু জায়গা থেকে হঠাৎ নীচে পড়ে যাচ্ছিলাম। মাথা নীচের দিকে, পা উপরের দিকে। মাথা বাঁচানোর জন্য নিজের অজান্তেই দু’টি হাত আগে মাটিতে পড়ে। তারপর হাতের ওপর ভর দিয়ে কাঠ হুইল খেলার মতো ঘুরে যাই। সেই থেকে শুরু হয় কাঠ হুইল খেলা। তবে ছোট থেকেই খেলাধুলোয় আগ্রহ ছিল।

প্রশ্ন: জিমনাস্টিক্সে কবে থেকে? কোথায় শেখেন? প্রথম গুরু কে?

উত্তর: করকাই জনকল্যাণ শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়ার সময় শিক্ষিকা সন্ধ্যা মালাকার (সম্পর্কে নিজের মামি) স্কুলে ছেলে মেয়েদের খেলাধুলোর জন্য পাশের নাকপুরা গ্রামের জিমন্যাস্টিক্স প্রশিক্ষক শুভাশিস চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠান। সেই থেকে শুরু হয় জিমন্যাস্টিক্স শেখা। কয়েক মাস শেখার পর শুভাশিসবাবুর বাড়িতে গিয়ে অনুশীলন করি। শুভাশিস চক্রবর্তী আমার প্রথম গুরু।

প্রশ্ন: ছোটবেলায় কী খেলতে ভাল লাগত? তখন কি জিমন্যাস্টিক্সে কোনও রকম সম্ভাবনা ছিল?

উত্তর: কবাডি আর গুটি খেলা খুব পছন্দ করতাম। তার সঙ্গে যোগাসন ও জিমন্যাস্টিক করতাম। আমি সব সময় দৌড় ঝাঁপ ও কাঠ হুইল করতাম বলেই বাড়ির লোকেরা জিমন্যাস্টিক্সে ভর্তি করেছিল।

প্রশ্ন: জিমন্যাস্টিক্স বেছে নিলেন কেন?

উত্তর: শুভাশিসবাবুর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে তেমাথানি মনসারাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। স্কুলের শিক্ষক রাধাকান্ত শীটের প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় জেলা জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলাম। চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাজ্য জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সুযোগ পাই। প্রথমবার রাজ্য প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারিনি। তবে সাই কমপ্লেক্সে ট্রায়ালের জন্য ডাক পাই। ২০০৩ সাল থেকেই সাইয়ে জিমন্যাস্টিক্সে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি।

প্রশ্ন: গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে জিমন্যাস্টিক্স বেছে নেওয়ায় পরিবার ও পাড়ার লোকের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

উত্তর: বাবা মা, মামিমা, মাসি, বাড়ির সকলেই অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। বলেছিল, সাইয়ে সকলে সুযোগ পায় না। তুই সুযোগটা কাজে লাগাস। পাড়ার লোকেরা এ বিষয়ে কিছু জানত না। তাই খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

প্রশ্ন: আর্থিক সমস্যা হয়নি?

উত্তর: বাবা বাস চালক ছিলেন। সংসার চালানোর পরে তিন মেয়ের পড়াশোনা চালাতে হিমসিম খেতে হতো তাঁকে। তবে স্কুলের শিক্ষক রাধাকান্তবাবু সাহায্য করেছেন। সেই সময় আমাদের যুবভারতীতে বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ম্যানেজার স্বপন মণ্ডল। কয়েক মাস পরে সাইয়ের জিমন্যাস্টিক্সের কোচ সাইয়ে হস্টেলের ব্যবস্থা করে দেন।

প্রশ্ন: প্রথম সাফল্য কবে আসে?

উত্তর: ২০০৩ সালে জেলা জিমন্যাস্টিক্সে চ্যাম্পিয়ান হই। ২০০৪ সালে রাজ্য প্রতিযোগিতা, ২০০৪ সালেই ন্যাশনাল আর্টিস্টিক যোগায় সফল হই।

প্রশ্ন: এখন পর্যন্ত স্মরণীয় সাফল্য?

উত্তর: ২০০৮ সালে প্রথম প্লেনে চড়ে রাশিয়া যাওয়া। মস্কোয় আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিক্সে ভল্ট ইভেন্টে চতুর্থ স্থান দখল করা।

প্রশ্ন: বাংলার মেয়েরা জিমন্যাস্টিক্সে সেভাবে আসেন না কেন? শুধুই পরিকাঠামোর অভাব নাকি মানসিকতায় সমস্যা?

উত্তর: অন্য রাজ্যের তুলনায় বাংলায় মেয়েরা জিমন্যাস্টিক্সে এগিয়ে আছে। বর্তমানে বাংলা থেকে আমি, ত্রিপুরা থেকে দীপা কর্মকার ও হায়দরাবাদ থেকে অরুণা রেড্ডি ছাড়া ভারতে মেয়েরা সেভাবে নেই। তবে বাংলায় জুনিয়র বিভাগে অনেক মেয়েই ভাল ফল করছে। বাংলায় পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। অন্য রাজ্যে জিমন্যাস্টিক্সের পরিকাঠামো তুলনামূলক ভাবে অনেক এগিয়ে।

প্রশ্ন: আপনার জীবনে অনুপ্রেরণা?

উত্তর: সাইয়ের প্রশিক্ষক মিনারা বেগম ও আমার মা-বাবা।

প্রশ্ন: কাকে রোল মডেল মনে করেন?

উত্তর: অলিম্পিক্সে চ্যাম্পিয়ান আমেরিকার সিমোন বাইলস।

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পদক তালিকায় খুব কাছে এসেও ফিরতে হয়েছে কয়েকবার। শিক্ষাগুরু কী বলছেন এই বিষয়ে?

উত্তর: আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ড খুব কঠিন। নিয়মিত কঠোর অনুশীলন দরকার। কয়েকবার জন্ডিস হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। অনুশীলন করতে গিয়ে চোট পেয়েছি। এই বছর কমনওয়েলথ-এ যাওয়ার আগে দিল্লিতে অনুশীলন করতে পারিনি। স্কুল খেলো ইন্ডিয়া হওয়ার জন্য ১৫ দিন অনুশীলন বন্ধ ছিল। মিনারা ম্যাডাম বলেছেন, নিয়মিত মন দিয়ে অনুশীলন করে ফিট থাকতে হবে। সামনে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপ রয়েছে। সেই দিকে তাকিয়ে এখন থেকেই তৈরি হওয়ার চেষ্টায় আছি।

প্রশ্ন: কমনওয়েলথে নামার আগে দীপা কর্মকার শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন? কোনও পরামর্শ দিয়েছিলেন?

উত্তর: দীপাদি শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। বলেছিল নিজের সেরাটা করে দেখা।

প্রশ্ন: এখন বাড়ি ফিরতে পারেন?

উত্তর: এখন কলকাতার সাই কমপ্লেক্সে থেকে অনুশীলন করি। মাঝে মধ্যে দিল্লিতে প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিতে যাই। বাড়ি খুব কম আসা হয়।

প্রশ্ন: নিজের জেলার জন্য আলাদা কোনও ভাবনা আছে?

উত্তর: মেদিনীপুর জেলায় জিমন্যাস্টিক্স প্রশিক্ষণের তেমন কোনও ভাল ব্যবস্থা নেই। আমার একার ভাবনা দিয়ে কিছু হবে না। আমি যদি দীপা কর্মকার হতাম তাহলে আমার ভাবনার মূল্য থাকত। মেডেল পাওয়ার পর সবাই চেনে, কথা শোনে।

প্রশ্ন: জেলাস্তরে জিমন্যাস্টিক্সকে জনপ্রিয় করে তুলতে কী কী প্রয়োজন?

উত্তর: ভাল পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। যাতে অনুশীলনের সময় কোনও চোট না লাগে সেদিকে নজর দিতে হবে। ৪-৫ জন ভাল প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ দেবেন। টিম তৈরি করে কাজ করতে হবে। তাহলেই ছেলে মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাল ফল করবে।

প্রশ্ন: জিমন্যাস্টিক্স খেলতে চায়, কিন্তু কী ভাবে শুরু করবে ভাবতে পারছে না। কী পরামর্শ দেবেন?

উত্তর: প্রথমে বেসিক জিনিস ভাল করে শিখতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। জেলা ও রাজ্য স্তরে সফল হতে হবে।

প্রশ্ন: দীপা খুব কাছে গিয়েও অলিম্পিক পদক পাননি। বাঙালি এখন আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। নিজে কতটা আশাবাদী?

উত্তর: ২০১৮ সালের অগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমস রয়েছে। ২০২০ অলিম্পিক্সের জন্য আমিও তৈরি হচ্ছি। চেষ্টা করব।

Pranati Nayak Commonwealth Games Gymnast
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy