Advertisement
১৮ মে ২০২৪
আনন্দবাজারের মুখোমুখি ভারত অধিনায়ক, বিরাট-মন্ত্রের সন্ধান

এক্সক্লুসিভ কোহালি: প্রশংসায় ভাসব না, নিন্দাও ভাঙবে না

একটা জিনিস আমি সব সময় নিশ্চিত করার চেষ্টা করি— আমি এই জীবনটা বাঁচতে চাই সম্পূর্ণ সততা নিয়ে। এই যে আপনার সামনে কথা বলার সময় আমাকে যে রকম দেখছেন, আমি ঠিক সে রকমই।

রাজকীয়: শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও একদিনের সিরিজে দু’টি সেঞ্চুরি। ক্রিকেটে চলছে কোহালির শাসন। —ফাইল চিত্র।

রাজকীয়: শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও একদিনের সিরিজে দু’টি সেঞ্চুরি। ক্রিকেটে চলছে কোহালির শাসন। —ফাইল চিত্র।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:২৮
Share: Save:

ব্যাটে তাঁর আগুন জ্বলছে। কিন্তু মাঠের বাইরের তিনি কেমন ধরনের চরিত্র? কী ভাবে চ্যালেঞ্জ জেতেন? অভাবনীয় এই ধারাবাহিক সাফল্যের মন্ত্র কী? সমস্যায় পড়লে কী ভাবে সমাধানের কথা ভাবেন? জিতলে দর্শকদের এক রকম আচরণ, হারলে আর এক রকম— কী ভাবে নিজেকে রক্ষা করেন? উত্তর দিতে আনন্দবাজার-এর সামনে হাজির ভারত অধিনায়ক এবং এই মুহূর্তে ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা সুপারস্টার বিরাট কোহালি। গত এক বছরে ভারতের কোনও সংবাদপত্রে দেওয়া একমাত্র সাক্ষাৎকার। আজ তৃতীয় পর্ব।

প্রশ্ন: ম্যাচ হারলে বা ট্রফি জিততে না পারলেই যে সমালোচনা শুরু হয়ে যায়, সেগুলো কী ভাবে সামলান?

বিরাট: একটা জিনিস আমি সব সময় নিশ্চিত করার চেষ্টা করি— আমি এই জীবনটা বাঁচতে চাই সম্পূর্ণ সততা নিয়ে। এই যে আপনার সামনে কথা বলার সময় আমাকে যে রকম দেখছেন, আমি ঠিক সে রকমই। আমি কারও আড়ালে কোনও ‘গেম’ খেলি না। সামনা-সামনি, সোজাসুজি যা বলার বলি। সেটা কারও কারও পছন্দ হবে, আবার কেউ কেউ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। যত ক্ষণ আমার অন্তরাত্মা বলছে, আমি ঠিক কাজ করছি, সেটা করে যাব। একটুও দ্বিধা আসবে না আমার মধ্যে। তখন আমার সামনে লক্ষ, কোটি মানুষ দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাদের দিয়েও যদি আমার বিরুদ্ধে বলানো হয়, আমি শুনব না। প্রভাবিত হব না।

প্র: এই বলিষ্ঠতা, এই মনের জোরটাই কি আপনার শক্তির উৎস?

বিরাট: আই ডোন্ট নো, আই ডোন্ট নো। আমি শুধু এটুকু জানি যে, দিনের শেষে আমাকেই মাঠে গিয়ে সমস্ত চাপটা নিতে হবে। যারা মন্তব্য করছে, মতামত দিচ্ছে, তারা সবাই মাঠের বাইরে বসে করছে। ভিতরে কী চলছে, সেটা না জেনে, না বুঝে মতামত দিচ্ছে। প্রত্যেক বার যখন মাঠে নামি, আমাদের উপর যে সীমাহীন প্রত্যাশা থাকে, সেটা শুধু আমরাই টের পাই। কোনও বড় টুর্নামেন্টের আগে আমাদের দলের সকলের মনের মধ্যে কী চলে, সেটার খোঁজ বাইরের কেউ পায় না। ইয়েস, আমরা মানুষকে, দর্শকদের, ভক্তদের আনন্দ দিতে ভালবাসি। তাদের এন্টারটেনমেন্ট উপহার দিতে চাই। কিন্তু সকলকে বুঝতে হবে যে, সব সময় আমরা জিতব এটাও হয় না।

(একটু থেমে) আমরা সব সময় জিততে চাই কিন্তু তার পরেও কখনও-সখনও ম্যাচ হেরে যেতে পারি। জিতলে সবাইকে পাশে পাওয়া যায় কিন্তু হারলে ক’জন আমাদের ভিতরকার যন্ত্রণাটা বুঝতে পারে। বা বোঝার চেষ্টা করে? ক’জন বলে যে, আরে ইয়ার, এই ছেলেগুলো এত পরিশ্রম করে নিজেদেরকে তৈরি করেছে ম্যাচটা বা টুর্নামেন্টটা জিতবে বলে। আজ হেরে গিয়ে ভিতরে-ভিতরে ওরা কতটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল! ক’জন বলে যে, ওরাই তো আমাদের আনন্দ দিয়েছে, আজ হেরে গিয়ে ওদের কী রকম লাগতে পারে! সকলের প্রতিক্রিয়াটাই এত বেশি নিজের অনুভূতি নির্ভর। আমার কী রকম লাগছে, তার উপর ভিত্তি করে আমার প্রতিক্রিয়াটা হবে। অথচ, আরও একটা দিক যে আছে— খেলোয়াড়দের দিক— এত পরিশ্রম করার পরেও হেরে গেলে তাদের কেমন লাগতে পারে, সেটা কেউ ভাবার তোয়াক্কা করে না।

প্র: এটা তো খুবই খারাপ লাগার মতো একটা ব্যাপার হতে পারে। এক জন ক্রিকেটার কী ভাবে নিজেকে এর থেকে রক্ষা করবে?

বিরাট: জানি না...আমি সত্যিই জানি না। মাঠে দাঁড়িয়ে কোনও ব্যানার তো তুলে ধরতে পারব না যে, ‘সাপোর্ট আস’ (আমাদের সমর্থন করুন)। একটাই উপায়— আমাদের বুঝতে হবে যে, নিজের কাজটা করে যেতে হবে। দিনের শেষে সেটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়াতেই ভারসাম্য এনে ফেলো। প্রশংসায় ভাসব না, তাহলে নিন্দাও ভাঙতে পারবে না। সেটাই সেরা ফর্মুলা। আমাদের কাজ হচ্ছে, মাঠে গিয়ে দলের জন্য ১২০ শতাংশ দেওয়া। যদি নিজে ভিতরে ভিতরে নিশ্চিত হও যে, দলের জন্য সেরাটা দিয়েছি, তা হলে অন্য মতামতে প্রভাবিত হব কেন?

প্র: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে হেরে যাওয়ার পরেও যে আপনি ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা এই দর্শন থেকে?

বিরাট: ছেলেরা কী রকম পরিশ্রম করছে কাছ থেকে দেখলে তাদের পাশে আপনা-আপনিই দাঁড়াতে ইচ্ছে করবে। আমি নিজে চোখে দেখছি, চেষ্টায় কারও কোনও ফাঁক নেই। তা হলে এক দিনের ফল দেখে সকলের টানা পরিশ্রমকে নস্যাৎ করে দেব কেন? আর আমি টিমের ক্যাপ্টেন। ম্যাচের পর সঠিক ছবিটা মিডিয়ার সামনে গিয়ে তুলে ধরা আমার দায়িত্ব। প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে আমি কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বোঝানোর চেষ্টা করি না যে, আমার টিমের সব কিছু ভাল, বাকিদের সব কিছু খারাপ। যদি আমাদের কোথাও ভুল হয়ে থাকে, যদি কোথাও আমরা ব্যর্থ হয়ে থাকি, সেটাও আমি বলি। ইয়েস, যদি অন্যায় সমালোচনা হয়, তা হলে আমি প্লেয়ারদের পাশে দাঁড়াই। আবার যদি কখনও মনে হয় নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত, সেটাও আমি বলতে ছাড়ি না।

প্র: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার কাছে হারের পরে প্রেস কনফারেন্সে এসে যে রকম টিমের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়ে গেলেন...

বিরাট: একদমই তাই। ওই ম্যাচটায় আমরা ভুল করেছিলাম, যে ভুলগুলো করা উচিত হয়নি। কখন প্লেয়ারদের পাশে দাঁড়াব, কখন তাদের সতর্ক করব, সেটাও ঠিকঠাক বুঝতে হবে। আর অন্যকে কোনও কিছু বলার আগে, ক্যাপ্টেন নিজে সেটা করে দেখাতে প্রস্তুত থাকবে— এটাই আমি মনে করি। আমি টিমের কাছে সৎ থাকতে চাই। সম্পূর্ণ সততা নিয়ে নিজের মনের ভাব, আইডিয়া প্রকাশ করতে চাই টিমের কাছে।

প্র: বিরাট, আপনি চ্যালেঞ্জ ভালবাসেন। এই মনোভাব কি আপনার মধ্যে সহজাত ভাবেই এসেছে নাকি ক্রিকেট দুনিয়ার কঠিন পথ চলতে গিয়ে গড়ে উঠেছে?

বিরাট: আমার মনে হয়, এটা একটা প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথেই আসে। আমি বিশ্বাস করি, জীবনে যা ঘটে, সেটা ঘটার থাকে বলেই থাকে। কাকতালীয় বলে কিছু হয় না। জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আর কোনও উপায় থাকে না, চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতেই হবে। সেই সব মুহূর্তগুলোই একজনকে তৈরি করে দিতে পারে। আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথায়। আমি পারবই, এটা ভাবতে হবে। চ্যালেঞ্জকে বুকে জড়িয়ে ধরতে হয়, তবেই চ্যালেঞ্জ জেতা যায়। যদি সারাক্ষণ ভাবতে থাকি পারব না, যদি আগেই আত্মসমর্পণ করে ফেলি, তা হলে কেউ টেনে তুলতে পারবে না।

প্র: মানে চ্যালেঞ্জ আমার, আমাকেই গ্রহণ করতে হবে?

বিরাট: আমি সেরকমই বিশ্বাস করি। এ ব্যাপারে আপনিই পারেন আপনাকে সাহায্য করতে। আর কেউ পারবে না। এক-একজনের ক্ষেত্রে যাত্রাপথ এক-একরকম। তাই তুলনা করা যাবে না। আমার কাছে পছন্দের পথ যেমন ধারাবাহিকতা রেখে এগিয়ে চলা। কিন্তু সেটা পেতে গিয়ে আমি কান্নাকাটি শুরু করতে পারি না যে, এই আমি কোনও রকম বিতর্কে জড়াব না। জীবনে আমার কোনও সমস্যা থাকবে না। কেন আমার জীবনটা ওর মতো সহজ হবে না? এ সব ভাবলেই আমার গতিপথ থেকে আমি সরে যেতে থাকব।

প্র: কঠিন মুহূর্তকে পেরনোর বিরাট-মন্ত্র তাহলে কী?

বিরাট: আমার দিকে ঘটনাগুলো যখন আসে, আমি সেগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ভালবাসি। যদি কোনও সমস্যা আসে, সেটার সমাধানের রাস্তা খুঁজে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কী জানেন তো, কেউ চুপচাপ এক জায়গায় বসে ভাবে না যে, জীবনের সমস্যাগুলো কী ভাবে মেটানো যায়। সমস্যা থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়, নিজেকে আরও শক্তিশালী করে তোলা যায়। আমি মনে করি, কোনও ঘটনাকে যদি অন্য ভাবে দেখা যায়, তা হলে সেটা নেতিবাচক হলেও কিছু না কিছু ইতিবাচক তরঙ্গ বেরিয়ে আসতে পারে। যদি এক জায়গায় বসে ভাবতে থাকি নিজের কী সর্বনাশ হল, তা হলে সেটা সমস্যাই থেকে যাবে। ব্যাপারটা আপনার মাথায়। আপনি কীভাবে একটা চ্যালেঞ্জকে দেখছেন, সেটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE