ভারতের ফুটবলে কি নতুন যুগ আসতে চলেছে? জাতীয় শিবিরে রায়ান উইলিয়ামস এবং অবনীত ভারতীকে ডাকার পর সে রকমই মনে করছেন অনেকে। বিদেশে খেলা ভারতীয় বংশোদ্ভূতেরা যাতে ভারতের হয়ে খেলেন, তার চেষ্টা চলছিল অনেক দিন থেকেই। রায়ান এবং অবনীতকে ডাকার মধ্যে দিয়ে তারই সূচনা হল। ভারতে এই মুহূর্তে যে সব বিদেশি ফুটবলার খেলছেন, তাঁদের চেয়েও কি ভাল রায়ান এবং ভারতী?
কে রায়ান উইলিয়ামস?
অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ফুটবলার রায়ান যেন ঘরে ফিরছেন। তাঁর দাদু লিঙ্কন গ্রস্টেট মুম্বইয়ের বিখ্যাত ফুটবলার ছিলেন। অতীতে টাটাদের দল এবং মুম্বইয়ের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছেন। দাদুর ইচ্ছাতেই ভারতের হয়ে খেলতে আসা রায়ানের। বলেছেন, “আমার দাদু বেঁচে থাকার সময় একটা কথা বার বার বলতেন, ‘ভারতের হয়ে খেলো’। ভারতের পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু ভারতের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল না। আমি ও আমার পরিবার অনেক ভেবেছি এই নিয়ে। জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হওয়া যে কোনও ফুটবলারের কাছে গর্বের মুহূর্ত। অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি। ভারতের জার্সি গায়ে চাপাতে পারলে সব সময়ে নিজের সেরাটা দেব।”
রায়ানের পেশাদার ফুটবলের শুরুটা অস্ট্রেলিয়াতেই। ইসিইউ জুনডালুপের হয়ে খেলা শুরু করেন। এর পর এক দশক ইংল্যান্ডের ফুলহ্যাম, পোর্টসমাউথ, অক্সফোর্ড ইউনাইটেড এবং রদারহাম ইউনাইটেডে খেলেছেন। ২০২২-এ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে পার্থ গ্লোরিতে যোগ দেন। পরের বছর বেঙ্গালুরু এফসি-তে। সেখানেই খেলছেন এখন। সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে তাঁর জুটি জমে গিয়েছে। সুনীলের জোরাজুরিতেই ভারতের হয়ে খেলতে রাজি হয়েছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট ছেড়ে ভারতের পাসপোর্ট নিয়েছেন।
ভারতীর কাহিনি
ভারতীর জন্ম কাঠমাণ্ডুতে। ছোট বয়সে রোমে চলে যান। সেখান থেকে নাইজেরিয়া। সে দেশেই প্রথম ফুটবলের প্রতি ভালবাসা জন্মায় ভারতীর। ২০০৬ বিশ্বকাপ দেখার পর ফুটবলার হওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেন তিনি। নাইজেরিয়ায় স্কুল পর্যায়ে গোলকিপার হিসাবে যাত্রা শুরু। এর পর ভারতে আসেন এবং দিল্লির একটি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। দিল্লি সিনিয়র ডিভিশন লিগে শাস্ত্রী এফসি-তে যোগ দেন। সেখান থেকে দিল্লির যুব দল এবং ভারতের অনূর্ধ্ব-১৬ দলেও সুযোগ পান।
২০১২-য় ভারতী সিঙ্গাপুরে গেলং আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। দু’বছর পর স্পেনের ক্লাব রিয়াল ভায়াদোলিদের যুব দলে যোগ দেন। সেখানে প্রশংসিত হয়েছিল তাঁর টেকনিক্যাল দক্ষতা এবং রক্ষণ করার ক্ষমতা। এইনট্র্যাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং অ্যান্ডারলেখ্টের স্কাউটদের নজরে পড়ে যান। জার্মানির ১৮৬০ মিউনিখ, এফএসভি ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং ডার্মস্ট্যাড ৯৮ ক্লাবের হয়ে অনুশীলন করেন।
২০১৫-য় প্রথম পেশাদার চুক্তি সই করেন পোল্যান্ডের ক্লাব পোডবেস্কিডজ়ি বিয়েলস্কো-বিয়ালায়। দক্ষিণ এশিয়ার খুব কম খেলোয়াড়ই পোল্যান্ডে খেলেছেন। সেখান থেকে পর্তুগালের সিনত্রেন্সে যোগ দেন। তার পর ভারতের কেরল ব্লাস্টার্স, চেক প্রজাতন্ত্র, কিরঘিজ়স্তান, পানামা এবং আর্জেন্টিনার ক্লাবে খেলেছেন। এখন তিনি খেলেন বলিভিয়ার অ্যাকাডেমিয়া ডেল বালোম্পি বলিভিয়ানোতে। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের হয়ে খেলতে চাইছিলেন ভারতী। অবশেষে সেই স্বপ্ন হয়তো পূরণ হতে চলেছে।
কেন দু’জনে জাতীয় শিবিরে?
সম্প্রতি বাংলাদেশের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হামজ়া চৌধুরি। বাংলাদেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন করায় ইংল্যান্ডের নাগরিকত্ব ধরে রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের নাগরিকত্বও পেয়েছেন হামজ়া। তবে ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্ব এখনও বৈধ নয়। ফলে বিদেশের কোনও নাগরিক ভারতের হয়ে খেলতে চাইলে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে তাঁকে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে হবে। অনেকেই সেটা করতে রাজি হন না। অতীতে মাইকেল চোপড়া বা বিকাশ ধোরাসুকে এই কারণেই ভারতের হয়ে খেলানো যায়নি। রায়ান ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে রাজি হয়েছেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। অতীতে একই কাজ করেছিলেন আরাতা ইজুমি, যিনি জাপানের নাগরিকত্ব ছেড়ে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। ভারতের হয়েও খেলেছেন। অবনীতও ভারতের নাগরিকত্ব নিতে আগ্রহী।
আরও পড়ুন:
ভারতের হয়ে খেলার জন্য এঁরা কতটা যোগ্য?
ভারতে এই মুহূর্তে যে সব বিদেশি ফুটবলার খেলেন বা অতীতে যাঁরা খেলে গিয়েছেন, তাঁদের থেকেও রায়ান বা ভারতী ভাল কি না তা সময়ই বলবে। তবে ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে যোগাযোগের কথা যদি বলতে হয়, তা হলে রায়ান এগিয়ে থাকবেন। গত দু’বছর বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলার সুবাদে ভারতের পরিবেশ ভালই চেনা তাঁর। ৩২ বছর বয়স হলেও ভারতীয় দলে স্ট্রাইকারের যে অভাব রয়েছে তা মেটাতে পারেন রায়ান। অবনীত সেন্ট্রাল ব্যাক। ভারতীয় ফুটবলে সে ভাবে পরীক্ষিত নন। তবে বিদেশের প্রচুর ক্লাবে খেলার সুবাদে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন।
ভারতীয় ক্লাবের মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভাল বিদেশিরা খেলেন মোহনবাগানে। জেমি ম্যাকলারেন, জেসন কামিংসেরা বিশ্বকাপে খেলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের হয়েও বহু ম্যাচ রয়েছে। ফলে এঁদের ভারতীয় দলে নিতে পারলে লাভই হবে। কিন্তু কেউই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব ছাড়তে রাজি হবেন না। একই কথা প্রযোজ্য দিমিত্রি পেত্রাতোসের জন্যও। ইস্টবেঙ্গল বা অন্যান্য ক্লাবেও গত কয়েক বছরে কোনও বিদেশিই ভারতের হয়ে খেলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন ক্লাবে এমন অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রয়েছেন যাঁরা ভারতের হয়ে খেলতে আগ্রহী। শুধু মাত্র নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নিয়মের জন্য তাঁদের ভারতের হয়ে খেলানো যাচ্ছে না।