Advertisement
E-Paper

কী এমন করেছি যে আমাকে পিছন থেকে ছুরি মারা হল

পদত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেঙ্গালুরুর হোটেলে বসেই ইস্টবেঙ্গল ছাড়ার চাঞ্চল্যকর নেপথ্য কাহিনি আনন্দবাজারে লিখলেন বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। ইস্টবেঙ্গলের চিফ কোচ থেকে শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলাম।বেঙ্গালুরুর টিম হোটেল থেকে ই-মেলে ক্লাবকর্তাদের কাছে পদত্যাগের চিঠিটা পাঠিয়ে যখন এই লেখাটা লিখছি, তখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কী এমন করেছি যে, আমার টিমের ভেতরেরই কিছু লোক এ ভাবে আমাকে পিছন থেকে ছুরি মারল?

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩৭
ফুটবল থেকে দূরে। চোখ এখন আইপিএলে। সোমবার রাতে নিজের বাড়িতে। ছবি-উৎপল সরকার

ফুটবল থেকে দূরে। চোখ এখন আইপিএলে। সোমবার রাতে নিজের বাড়িতে। ছবি-উৎপল সরকার

ইস্টবেঙ্গলের চিফ কোচ থেকে শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলাম।

বেঙ্গালুরুর টিম হোটেল থেকে ই-মেলে ক্লাবকর্তাদের কাছে পদত্যাগের চিঠিটা পাঠিয়ে যখন এই লেখাটা লিখছি, তখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কী এমন করেছি যে, আমার টিমের ভেতরেরই কিছু লোক এ ভাবে আমাকে পিছন থেকে ছুরি মারল? কেন ফুটবলারদের সঙ্গে আমার গণ্ডগোল লাগানোর জন্য কলকাতা লিগ জেতার পর থেকে উঠেপড়ে লাগল টিমের সাপোর্টিং স্টাফের কেউ কেউ আর দু’-একজন ফুটবলার!

আমাদের ড্রেসিংরুম আলোচনার সব খবর যারা রং চড়িয়ে মিডিয়ার কাছে প্রতিদিন পৌঁছে দিত। বিশ্বাস করুন, অনেক চেষ্টা করেও ওদের অন্যায়কে আটকাতে পারলাম না। সে জন্যই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছি। জানি না ক্লাবকর্তারা আমার চিঠি নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই পরিবেশ আমার আর ভাল লাগছে না। তাই সরে দাঁড়ালাম।

অঙ্কের হিসেবে হলেও এখনও কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের আই লিগ জেতার সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে। দু’টো ম্যাচ বাকি। তার পর সামনে ফে়ড কাপ আছে। নতুন কেউ এসে হাল ধরুক। জোর গলায় বলছি, আমাকে কেউ পদত্যাগ করতে বলেনি। কারও চাপে আমি পদত্যাগ করিনি। পনেরো-ষোলো বছর কোচিং করাচ্ছি। জানি কখন সরে দাঁড়াতে হয়। আর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো ক্লাবে কোচেরা চিরদিনের জন্য আসে না। বিশ্বের কোথাও কোনও বড় ক্লাবে সেটা হয় না। আর জনগণের ক্লাবে তো ব্যর্থ হলেই সবার আগে কোচের গর্দান!

কিন্তু আমি কি সত্যিই ব্যর্থ? কিছুক্ষণ পরেই কলকাতার ফ্লাইট ধরব। অথচ তার আগেও বেঙ্গালুরুর আইবিআইএস হোটেলের ৫০২ নম্বর ঘরে বসে বারবার ভেবে চলেছি নিজের গত কয়েকমাস লাল-হলুদের কোচিং জীবনের কথা। কলকাতা লিগ জিতেছি। এ মরসুমে তিনটে ডার্বি খেলেছি, একটাতেও হারিনি। দু’টোয় জিতেছি। বারবার পিছিয়ে পড়েও আই লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ দৌড়ে ফিরিয়ে এনেছি টিমকে। গত চার-পাঁচ বছর তো ইস্টবেঙ্গল সাত-আটটা ম্যাচের পরই আই লিগ খেতাব দৌড় থেকে ছিটকে পড়ত। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক টুনার্মেন্টে ভাঙা টিম নিয়ে গিয়েও রানার্স হয়েছি। তবু আমার বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত কেন? কার স্বার্থে? কীসের স্বার্থে? আমরা সবাই তো ইস্টবেঙ্গলকে ট্রফি দেওয়ার জন্যই এই ক্লাবে এ বার এসেছিলাম। তবু এই সাবোতাজ কেন?

ক্লাবকর্তাদের কাছে আমি একজন পজিটিভ স্ট্রাইকার চেয়েছিলাম। ওঁরা অনেক খুঁজেছেন। আমিও খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। বার্নার্ড মেন্ডিকে পাওয়া গেল। ক্লাবকর্তারা বললেন, ও ইউটিলিটি ফুটবলার। আমি নিতে রাজি হয়ে গেলাম। বলতে দ্ধিধা নেই আমার সম্মতি নিয়েই কর্তারা মেন্ডিকে নিয়েছিলেন। কিন্তু মেন্ডিকে আই লিগের মতো টুর্নামেন্টের মধ্যে এনে পুরো ফিট করার সুযোগ ঘটেনি। ওর কাছ থেকে যে খেলাটা প্রত্যাশিত ছিল সেটা পাইনি।

সেটা তো গেল একটা অংশ। কিন্তু বন্ধ ড্রেসিংরুমের মধ্যে মেন্ডির সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে সেটা কী ভাবে মিডিয়ায় বেরিয়ে গেল দিনের পর দিন? বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগে কর্তা-ফুটবলারদের সব আলোচনাও তো বাইরে বেরিয়ে গেল! কে দিল? আমরা যারা কোচিং করি তারা সবাই জানি ড্রেসিংরুমে নানা রকম কথা হয়। কথাকাটাকাটি হয়। রাগ-অভিমান হয়। একটা দলে বা এটা হতেই পারে। বিশ্বে সর্বত্র হয়। কিন্তু সেটা নিয়মিত মিডিয়ার কাছে পৌঁছে দিয়ে কোচের সঙ্গে ফুটবলারদের লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা কোথায় হয়েছে? যা এ বার আমার টিমের ক্ষেত্রে হল!

পরিষ্কার বলছি টিমের মনোবল ভাঙতে এটা করা হয়েছে। কোচ হিসাবে টিমে শৃঙ্খলা রাখতেই হবে আমাকে। ভাল না খেললে সেই প্লেয়ারকে বাদ দিতে হবে। সেটাই নিয়ম। কিন্তু যাকে বাদ দিলাম তাকে নানা ভাবে দিনের পর দিন লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। সেই ফুটবলারও ভুল বুঝে আমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। প্র্যাকটিসে দেখেছি আমার সঙ্গে কথা বলছে না। পরে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি সামলেছি। মেন্ডির সঙ্গে আমার সম্পর্ক যখন বিষিয়ে দেওয়া হল তখন ক্লাবের এক শীর্ষকর্তার উপস্থিতিতে ওর সঙ্গে কথা বললাম। যা শুনলাম তা অবাক করার মতো। যা আমি কখনও বলিনি সেটাই আমার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। র‌্যান্টি, ডংদের আমার বিরুদ্ধে তাতিয়ে দিয়ে মিথ্যে বলা হয়েছে, আমি ম্যান ম্যানেজমেন্ট জানি না! বিদেশি ফুটবলার নাকি ট্যাকল করতে পারি না। আমার হাসি পেত এ সব শুনে। আমি ব্যারেটো, চিডিদের নিয়ে সাফল্য পেয়েছি। ভাইচুং আমার কোচিংয়ে খেলেছে। দু’বার অবনমন বাঁচিয়ে মোহনবাগানকে আই লিগে এক বার রানার্স আর এক বার চার নম্বর করেছি। মহমেডানকে আই লিগ টু-তে চ্যাম্পিয়ন করেছি।

যা শুনছি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি নাকি ভাল করে প্র্যাকটিস করাই না। তা হলে এই যে কলকাতা লিগ বা ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্য সেটা কী ভাবে এল? ভাল প্র্যাক্টিস ছাড়াই? বলা হচ্ছে, আমি নাকি ভীতু কোচ। ভদ্রতা মানে যদি ভীরুতা হয়, নোংরামিকে এড়িয়ে হাসি মুখে কোচিং করানোটা যদি ভীতু কোচের সংজ্ঞা হয়, হ্যাঁ, তা হলে বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য ভীতু কোচ। অনেকে এখন বলতে পারেন, আনন্দবাজারে আমার কলামে যা লিখেছি, এ সব কথা আমি কেন কর্তাদের বলছি না? নিশ্চয়ই বলেছি। তাঁরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। বাইরে টিমের সঙ্গে বিশিষ্ট কাউকে কাউকে পাঠাননি। কিন্তু ড্রেসিংরুমের গোপন খবর লিক হয়ে যাওয়া আটকাতে পারেননি।

বেঙ্গালুরুর কাছে হারের পর এখন অনেকে এও বলছেন, কেন অমুক ফুটবলারকে খেলানো হয়নি, কেন তমুক ফুটবলারকে খেলানো হল? দেখুন, দল হারলে বিশ্বের সর্বত্র এ সব প্রশ্ন কোচেদের শুনতে হয়। এমনকী যে নেই তাকে কেন খেলানো হল না তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে! আসলে টিমে প্রচুর চোট-আঘাত ছিল। পরের ম্যাচগুলোর কথা ভেবে আমাকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কোচ হিসেবে আমি একটা ফিট টিম নামাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার প্রশ্ন, যারা নেমেছিল তারাও তো টিমের সেরা ফুটবলার। তাদের তো খেলানোর জন্যই এ বার সই করানো হয়েছিল। তারা জেতাতে পারল না কেন? কেন এ রকম বিশ্রী গোল খাবে কিপাররা? কোচ খুব খারাপ মানছি। কিন্তু মেন্ডি-র‌্যান্টি–খাবরারা জেতাবে না কেন? এই খাবরাই তো ওকে খেলানো হচ্ছে না বলে কর্তাদের সামনে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল!

নিজে খেলেছি বলে আরও ভাল জানি যে, ইস্টবেঙ্গলে এ রকম পরিবেশ কখনও ছিল না। কিন্তু এখন টিমের মাত্র দু’-তিনজনের জন্যই যা বিশ্রী পরিবেশ দাঁড়িয়েছে ভাবলে খুব খারাপ লাগে। আর ভাল লাগছে না।

তবু বলব, যেটুকু লিখলাম সেটা হিমশৈলের চুড়ো মাত্র। সব লিখলে টিমের মধ্যে মারামারি লেগে যাবে। সেটা একেবারেই চাই না। ইস্টবেঙ্গলের জন্য শুভেচ্ছা থাকল।

East Bengal Biswajit Bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy