উপদেশ: নিজের বাড়িতে শঙ্করকে শূন্যে শরীর ভাসিয়ে রাখার ব্যাকরণ শেখাচ্ছেন বাংলা তথা ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক তরুণ বসু। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
মঙ্গলবারের সন্ধে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ছ’টা। শ্যামনগর রোডের নর্থল্যান্ড কো-অপারেটিভ সোসাইটির চার তলায় চোদ্দো নম্বর ফ্ল্যাটে হঠাৎ আবির্ভাব তাঁর।
তিনি শঙ্কর রায়। সোমবারের মোহনবাগান-মহমেডান ম্যাচের ট্র্যাজিক হিরো। হেরে গেলেও যিনি বাড়ি ফিরেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিয়ে। যাঁর ফ্ল্যাটে তিনি হাজির সেই গৃহকর্তাও সত্তর দশকে বাংলা ও ভারত কাঁপানো কিংবদন্তি গোলকিপার—তরুণ বসু। পঁচাত্তরের লিগে মহমেডানের হাবিব খাঁ-র পেনাল্টি আটকে নায়কের মতো মাঠ ছেড়েছিলেন তিনিও। তখন তিনি ইস্টবেঙ্গলে। শঙ্করকে দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আয়। তোর জন্যই বসেছিলাম।’’
কলকাতা ময়দানে দুই প্রজন্মের দুই গোলকিপারের আড্ডা। যার সাক্ষী শুধু আনন্দবাজার। ৭১ বছরের তরুণ বসু সত্তর দশক দাপিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলে। আর শঙ্কর সবে পা দিয়েছেন গোলকিপিং-এর গলি থেকে রাজপথে।
ময়দানের একদা ক্ষিপ্রতম গোলকিপার তরুণ বসু থাকেন শ্যামনগর রোডে। আর শঙ্কর নাগেরবাজারে। মঙ্গলবারে আড্ডার আগে কেউ কাউকে চিনতেন না। সন্তোষ ট্রফিতে শঙ্করের গোলকিপিং দেখেছিলেন তরুণ। আর সোমবার দেখেছেন শঙ্করের লড়াই।
ম্যাচ সেরা হয়েও মোহনবাগানের বিরুদ্ধে হেরে গিয়ে মন খারাপ শঙ্করের। আগাম আন্দাজ করেই ময়দানে টুপি পরে গোল রক্ষা করা তরুণের হঠাৎ প্রশ্ন, ‘‘মোহনবাগানের বিরুদ্ধে দু’টো গোল যে খেয়েছিস তা মনে আছে তোর?’’ শুনে মাথা নাড়েন বছর বাইশের এই নবীন গোলকিপার। সঙ্গে সঙ্গে স্নেহসুলভ ধমক, ‘‘বড় গোলকিপার হতে গেলে এটাই তোর করা চলবে না। একদম ভুলে যা ওই গোল দু’টো।’’
হাতের কাছে তরুণ বসুকে পেয়ে এতক্ষণে জড়তা কেটে গিয়েছে শঙ্করের। বললেন, ‘‘স্যার আউটিং-এ একটু সমস্যা হচ্ছে। সেটা কাটাতে চাই।’’ শুনেই একাত্তরে ভারতীয় দলের রাশিয়া সফরে সেরা গোলকিপারের নির্দেশ, ‘‘এই সোফাটায় শুয়ে পড়।’’ বাধ্য ছাত্রের মতো শঙ্কর সোফায় শুতেই তরুণ বসু বলতে শুরু করলেন, ‘‘মনে কর তোর পায়ের পাতাগুলো নেই। এ বার হাঁটু থেকে বাকি অংশ নেই, এ বার কোমর থেকে, হাত থেকে, এ বার পুরো শরীরটাই...।’’ একটু থেমে ফের বলতে শুরু করে দেন, ‘‘এটা একদিনে হবে না। রোজ বাড়িতে প্র্যাকটিস কর। প্রতি ম্যাচের তিন ঘণ্টা আগে ড্রেসিংরুমে এ রকম টানটান হয়ে শুয়ে এটা অনুশীলন কর তো। এক সময় তোর মনে হবে শূন্যে ভাসছিস। এটা যে দিন থেকে হবে, সে দিন থেকেই তোর আউটিং ভাল হয়ে যাবে। জাম্প করে শূন্যে ভেসে থাকার সময় কোনও সমস্যা থাকবে না। আমিও এক সময় এটা করে ফল পেয়েছি।’’
মানিব্যাগের পকেট থেকে একটা ছবি এ বার বের করেন তরুণ। সাদা-কালো সেই ছবিতে দশর্কঠাসা ইডেনে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতোই শূন্যে ভাসছেন তিনি। ওই অবস্থায় চাপড় মেরে বল বিপন্মুক্ত করছেন। বললেন, ‘‘যেটা তোকে শেখালাম, সেটা কাজে লাগিয়েই তিয়াত্তরের লিগে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে এটা করেছিলাম।’’
শঙ্কর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছেন কিংবদন্তি এই গোলকিপারের কথা। আর তরুণ বলে যাচ্ছেন, ‘‘বলের থেকে চোখ সরাবি না কখনও। সব সময় মনে রাখবি ছ’গজ বক্সে কোনও ডিফেন্ডার নেই। তুই ডিফেন্ডার। বুকে এই জোরটা রেখেই ম্যাচ খেলতে নামবি।’’
এ বার এল পরিবারের কথা। শঙ্করের বাড়ির কথা জেনে বললেন, ‘‘তোর সংগ্রামের কথা জানি। কিন্তু মাঠে নেমে মনে রাখবি বক্সের মধ্যে তুই-ই প্রিন্স। তুই-ই সুলতান।’’
আরও পড়ুন:জয় দিয়ে ক্রিকেট ফিরল পাকিস্তানে
শঙ্কর এ বার টেনে আনেন পাঠচক্র ম্যাচে চার গোল হজমের কথা। উত্তর এল, ‘‘আমি সন্তোষ ট্রফিতে ছয় গোল খেয়েছিলাম পঞ্জাবের বিরুদ্ধে। ওগুলো মনে রাখবি না।’’
সুব্রত পালের ভক্ত শঙ্কর এ বার তাঁর আদর্শের কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘স্যার, দেশের হয়ে খেলতে গেলে কী করতে হবে বলবেন?’’ উত্তর আসে, ‘‘দাওয়াই একটাই। ভাল পারফর্ম করা। তার জন্য তোর ক্ষিপ্রতা বাড়াতে হবে। সমারসল্ট অনুশীলন কর। জিমে গেলে তোর ওজনের অর্ধেক ওজন দ্রুত তোলার ট্রেনিং কর। ক্ষিপ্রতা বাড়বেই।’’
একটু থেমে তরুণ বসু বলে চলেন, ‘‘পেনাল্টি বাঁচানোর জন্য নিজে লাইনে দাঁড়িয়ে তার চার-পাঁচ গজ আগে একটা লাইন টেনে রাখবি। দু’টো পা যেন কাছাকাছি থাকে। গোললাইন বরাবর না ঝাঁপিয়ে, ওই সামনের লাইন লক্ষ করে কোনাকুনি ঝাঁপ দেওয়া প্র্যাকটিস কর। উপকার পাবি।’’
আর চাপমুক্ত থাকতে? এ প্রসঙ্গে একদা ভারত কাঁপানো গোলকিপারের অনুজকে পরামর্শ, ‘‘সাতটায় রাতের খাওয়া সেরে ন’টায় ঘুমিয়ে পড়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দে। সিনেমাও দেখতে পারিস। কিন্তু শৃঙ্খলা হারাবি না।’’
সোমবার কল্যাণীর মাঠে ম্যাচ সেরা হওয়ার পুরস্কার পেয়েও মনমরা ছিলেন শঙ্কর। এ দিন এক ঘণ্টার এই আড্ডা কেমন লাগল জানতে চাইলে নাগেরবাজারের ছেলে বলছেন, ‘‘আমার মতো সাধারণকে অসাধারণ করার জ্বালানি তরুণ স্যার ভরে দিলেন মগজে। ম্যাচ সেরার চেয়েও মূল্যবান পুরস্কার এটাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy