Advertisement
E-Paper

’৯০ ফিরিয়ে বিশ্বকাপ সেই ক্লোজেদের

মারাকানা ফিরিয়ে নিল তার অভিশাপ যে এখানে ফেভারিট জিতবে না, এটা আন্ডারডগদের চারণভূমি! পঞ্চাশ বছর আগে যে ওলট-পালটই ঘটে থাকুক, রোববার তারা কাগজে-কলমে ফেভারিট ফিলিপ লামের দলকেই স্থানীয় প্রচুর জনসমর্থনের মধ্যে চতুর্থ বার বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিল। গোটা ম্যাচ জুড়ে আর্জেন্তিনীয়রা সুযোগ নষ্ট করে গিয়েছেন। জার্মান পেশাদারিত্বের মুখ হিসেবে অতিরিক্ত প্লেয়ার মারিও গোটজে, যাঁকে কেউ হিসেবের মধ্যেই ধরেনি।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৪ ০৪:৩৪
বিশ্বজয়ী। দু’যুগ পরে সেই আর্জেন্তিনাকে হারিয়েই কাপ ঘরে তুলল জোয়াকিম লো বাহিনী। ছবি: রয়টার্স।

বিশ্বজয়ী। দু’যুগ পরে সেই আর্জেন্তিনাকে হারিয়েই কাপ ঘরে তুলল জোয়াকিম লো বাহিনী। ছবি: রয়টার্স।

মারাকানা ফিরিয়ে নিল তার অভিশাপ যে এখানে ফেভারিট জিতবে না, এটা আন্ডারডগদের চারণভূমি!

পঞ্চাশ বছর আগে যে ওলট-পালটই ঘটে থাকুক, রোববার তারা কাগজে-কলমে ফেভারিট ফিলিপ লামের দলকেই স্থানীয় প্রচুর জনসমর্থনের মধ্যে চতুর্থ বার বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিল। গোটা ম্যাচ জুড়ে আর্জেন্তিনীয়রা সুযোগ নষ্ট করে গিয়েছেন। জার্মান পেশাদারিত্বের মুখ হিসেবে অতিরিক্ত প্লেয়ার মারিও গোটজে, যাঁকে কেউ হিসেবের মধ্যেই ধরেনি। তিনি একটা শুরলের লুপিং পাস বুকে জমালেন। তার পর ভলিটা গোল করে দিলেন। এর চেয়ে অনেক সহজ সুযোগ ইগুয়াইন আর মেসি নষ্ট করেছেন। সের্জিও আগেরোর কথা যত কম বলা যায়, তত ভাল। তিনি গোটা টুর্নামেন্টটাই অবিশ্বাস্য খারাপ খেললেন। সাবেয়ার তাঁকে বদলি নামানোর স্ট্র্যাটেজি কাজ করল আজও।

লিওনেল মেসির যে বিশ্বকাপ স্বপ্নে হাত রাখা হল না তা একান্তই নিজেদের গোল করতে না পারার ব্যর্থতায়।

অদৃষ্ট দায়ী নয়। অদৃষ্ট তো বরঞ্চ দু’টো শট একটা ক্রসপিসে, একটা সাইডপোস্টে। দু’টোর কোনওটাই গোলে ঢুকতে দেয়নি। জার্মানরা শুধু নব্বইয়ের ফাইনালের বদলাই নিতে দিল না নয়। লাতিন আমেরিকা থেকে প্রথম ইউরোপের দেশ হিসেবে ট্রফি জিতে নজির তৈরি করে গেল।

জার্মানরা এ দিন নিজেদের খেলার আশি ভাগও খেলেনি। স্রেফ জার্মান স্পিরিটে ম্যাচটা নিয়ে চলে গেল। ব্রাজিল ধন্য ধন্য করছে মেসিদের পরাজয়ে। মেসি নিজে কী ভাবছেন? শেষ সুযোগ হিসেবে একটা ফ্রিকিক পেয়েছিলেন। বাঁ পায়ে ওই জায়গা থেকে অনেক গোল আছে তাঁর। জার্মান এবং ব্রাজিলীয় সমর্থকরা ক্লিষ্ট মুখে বসেছিলেন। কিন্তু এই মেসি ০-১ পিছিয়ে ম্যাচের শেষ মিনিট টেনশন ভোগা মানুষ। বারের ওপর দিয়ে বল উড়িয়ে দিলেন। ১১৩ মিনিটে তাঁদের গোল খাওয়াটাই বহাল রইল। আর কোপাকাবানার সমুদ্রের জল কিছু অবশ্যই বাড়ল লক্ষাধিক আর্জেন্তিনীয় সমর্থকদের সেখানকার জমায়েতের অশ্রু থেকে।

বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রথমার্ধের প্রোমো বলছিল, শেষ অংশ আরও জমজমাট হওয়া উচিত। প্রথমার্ধেই একটা নাকচ গোল। একটা সাইডপোস্টে প্রত্যাখ্যাত গোল, একটা সহজতম সুযোগ নষ্ট!

সবাই জানে জার্মানি ফাইনালে অবিসংবাদী ফেভারিট! কিন্তু দশ-পনেরো মিনিট বাদ দিয়ে বোঝা যাচ্ছিল না খেলাটা কারা নিয়ে চলে যাবে? বল দখল কার কত অংশ সেটা খেলার পর ফিফা থেকে মিডিয়ার কাছে একটা হিসেব আসে। কিন্তু সেই হিসেব আসার অনেক আগেই বলে দেওয়া যায়, বদলে দখলে জার্মানি অন্তত দশ শতাংশ এগিয়ে থাকবে। শুরুতে মনে হচ্ছিল আজ কি আরও একটা পর্তুগাল বা ব্রাজিল ঘটতে পারে? জার্মানি তো হাফলাইন অবধি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে আসছে।

এর পর বোঝা গেল এটাই সাবেয়ার স্ট্র্যাটেজি। ওদের এগোতে দাও। চাপটা তোমরা নাও। তার পর হঠাৎ ওদের ফাঁকা জমিতে দৌড়োতে শুরু করো। শুরুর দিকে মাঠে মেসিকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। যথারীতি জার্মান সিংহতে তিনি অবরুদ্ধ।

কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে এমন কাউকে যাঁকে কাপ ফাইনালের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ভাবাই হয়নি। গঞ্জালো ইগুয়াইন। আর্জেন্তিনা যেমন তাদের ডিফেন্সের বাঁ দিকটা অদ্ভুত ভাবে অরক্ষিত রেখে দিয়েছিল, তেমনই জার্মানির বাঁ দিকটাতেও অপ্রত্যাশিত ফাঁকা জমি। ইগুয়াইন সেখান থেকে একটা লম্বা দৌড়ে কোনাকুনি বল বাইরে মারলেন। কাপ ফাইনালে ওই জায়গা থেকে গোল হলে কেউ দারুণ গোলও বলবে না। এর পর আচমকাই সহজতম সুযোগটা পেয়ে গেলেন টনি ক্রুজের গোলকিপারকে করা ব্যাকহেড থেকে।

সামনে শুধু নয়্যার এবং আসলে ফাঁকা গোল। নাপোলি মাঠে এটা রোজ গোল করতেন। কিন্তু আজ উড়িয়ে দিলেন বাইরে। মেসি তত ক্ষণে ডান দিক থেকে মুভমেন্ট শুরু করেছেন। তার থেকে বল নিয়ে লাভেজ্জি ডান দিক থেকে যে ক্রস করেছিলেন, তাতে পা ছুঁইয়ে ইগুয়াইন গোল করেও ফেলেন। কিন্তু দু’গজের অফসাইড। আর্জেন্তিনীয়রা উৎসব করতে শুরু করেও দিয়েছিল। স্তব্ধ হয়ে গেল।

মারাকানা ততক্ষণে জমে গিয়েছে। তার আগে সন্দেহ হচ্ছিল জমবে কি না? শাকিরা অবধি গ্যালারির উত্তাপ তুলতে পারেননি। বেশ কিছু সিট ফাঁকা। তা হলে অনেক ব্রাজিলিয়ানরা দুঃখে এলেন না?

দশ মিনিটের মাঠের উত্তেজনায় আবার গ্যালারিকে মারাকানার স্বমহিমায় ফিরিয়ে দিয়ে গেল। তখন বোঝার উপায় নেই দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই আর্জেন্তিনীয়দের সহজ গোল মিস যে দুইতে গিয়ে দাঁড়াবে। লিওনেল মেসি বাঁ পায়ে পনেরো গজ থেকে সহজতম পুশ বাইরে মারবেন। ম্যানুয়েল নয়্যারের আজ সুইপার খেলা হচ্ছে না, জার্মানি এগারো জনেই নামছে। তা বলে এত সহজ গোল মিস করে কি জার্মানদের হারানো যায়।

কাপ ফাইনালের চাপ? তা তো আজ কামড়াচ্ছে জার্মানিকেও। নইলে একটা ক্রসেও ক্লোজে মাথা ছোঁয়াতে পারছেন না কেন? টনি ক্রুজ কেন আজ সেই বল রোমেরোর হাতে মারবেন, যা ক’দিন আগে বেলো মাঠে গোল করেছেন। মিডিয়া সেন্টারে নেমে দেখি ব্রাজিলীয় সাংবাদিক গজগজ করছেন, সে দিন কী মেরেছিলি, আর আজ কী মারলি! প্রথমার্ধের শেষ দিকটা আবার জার্মানি খেলা ধরল। এই সময় কর্নার থেকে বেনেডিক্ট হাওডেস একটা দুরন্ত হেডার নিয়েছিলেন। বলটা সাইডপোস্টে লেগে প্রথমার্ধের ভাগ্য যেন ড্র করিয়ে দিল ১-১!

সমাপ্তি অনুষ্ঠান সেই মাত্রায় যে পৌঁছলো না, এটা আশ্চর্য। জেনিফার লোপেজ বরং ব্রাজিলীয় জনতার অনেক অপ্রিয় চিকে সুর থেকে থিম সংটা পছন্দ না হওয়ায়। কিন্তু উদ্বোধনের দিন লোপেজ কুড়োলেন সাও পাওলো দর্শকের তুমুল হাততালি। আর শাকিরা যাঁকে দেখার জন্য এখানকার জনতা এত আকুল ভাবে তাকিয়ে ছিল, তার শো এমন ভাবে শেষ হল যেন ব্রাজিলের ডিফেন্স খেলে উঠল।

মিডিয়া সেন্টার আর তার আশেপাশের এলাকা কিন্তু শুরুর থেকেই গমগম করছে, জাভিয়ের জানেত্তিআর্জেন্তিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা প্লেয়ারকে ঘিরে প্রচন্ড উদ্দীপনা। জানেত্তিকে আগের বিশ্বকাপে বিস্ময়কর ভাবে মারাদোনা বাদ দিয়েছিলেন। সেই জায়গাতেই আজ খেলছেন মাসচেরানো। জানেত্তি, আজ তাঁর কী মনে হচ্ছে? উত্তর দিলেন না। এসে পড়ছেন ভালদানোও। ইগুয়াইনের গোলটা যিনি মেসির টিমে থাকলে মনে হয় না মিস করতেন বলে।

দ্বিতীয়ার্ধ থেকে লিওনেল মেসি বোধহয় সেই ম্যাজিক মুহূর্ত খুঁজতে থাকেন যা গয়কোচিয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে আজ বলেছেন। রাইট ইনসাইডের জায়গা থেকে বাঁ পায়ে বারবার ড্রিবল করতে করতে তিনি ঢুকে পড়ছেন। পিছন পিছন তিন থেকে চার জন। ফাইনালের এটাই হয়তো সেরা চিত্রকল্প। মুলার-লামের ডান দিকে বারাবার আক্রমণ তৈরি করাও।

ওঠা-নামা, গতি আর টেনশনে এটা নব্বইয়ের সেই রোম-যুদ্ধের চেয়ে অনেক উন্নত ফুটবল দেখাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল না আর্জেন্তিনা যে এত তীব্র আন্ডারডগ। খেলা শুরুর অল্প আগে মিডিয়া সেন্টার দুলিয়ে দিয়ে গেলেন মেক্সিকান মডেল কাম অভিনেত্রী কাম অ্যাঙ্কর ইনেস সাইনেজ। মার্কিন দেশের বছরখানেক আগে একটা লকাররুম ঘটনা আর ফক্স টিভিতে খোলামেলা পোশাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় যাঁকে নিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মেক্সিকোর বিখ্যাত মডেল বরাবরই মেসি-প্রেমে অন্ধ। বলে গেলেন, “একটা মানত করেছি আজ যেন লিও ফুটবলের প্রতি ওর শৈশবের অকৃত্রিম ভালবাসাটা ফেরত পায়। তা হলেই চলবে।”

পরে দেখা গেল মেসিদের শৈশব ফিরে পাওয়াটা জার্মানদের জন্য যথেষ্ট ছিলই না। ওটা ম্যাচের সেরা ছবিও ছিল না। ম্যাচ সেরা দৃশ্য মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে অবস্থাতেও সোয়াইনস্টাইগারের মাঠ ছাড়তে না চাওয়া।

আর একটা নতুন প্রবাদেরও হয়তো তা জন্ম দিয়ে গেলজার্মান রক্ত পড়লে, জার্মানিকে হারানো যায় না। মেসি কেন, পোপ আর্জেন্তিনীয় হলেও না!

fifa world cup germany argentina messi gautam bhattacharya klose
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy