দুপুর সওয়া তিনটে। দমদম বিমানবন্দরের সিকিউরিটি জোনে এক নীল জ্যাকেটের দর্শন পাওয়া গেল। জ্যাকেটের ভেতর থেকে সাদা জামা উঁকি মারছে। জামার কলারটা উঁচু করা। কোচির উড়ান ধরার জন্য বোর্ডিং গেটের সামনে আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে দেখে মনেই হচ্ছে না, চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি তাঁর আটলেটিকো কলকাতা ফের আইএসএলে খাদের কিনারায় এসে ঠেকেছে। মনেই হচ্ছে না, কেরল ব্লাস্টার্সের ঘরের মাঠে ভাগ্য নির্ধারণের লড়াই করতে চলেছে তাঁর দল।
কলকাতার স্প্যানিশ কোচের মুখে হাসি। যেন কিছুই হয়নি। ভেতরে ঢুকে একটা সিটে বসে পড়লেন। স্যুটকেসের উপরেই পা তুলে দিয়ে দিব্যি রাজকীয় মেজাজে! পাশেই তাঁর টেকনিক্যাল টিমের কয়েক জন এবং আটলেটিকোর এক কর্তা। হাসি মুখেই তাঁদের সঙ্গে এক গুরুগম্ভীর আলোচনায় ব্যস্ত হয় পড়লেন। আগের দিন যুবভারতীতে নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড ম্যাচে রেফারিং মোটেই পছন্দ হয়নি তাঁর। রাগ এখনও কমেনি। সেটাই বারবার বলে চলেছেন। শোনা গেল, রেফারিং নিয়ে প্রতিবাদপত্র জমা দেওয়া হবে।
পরের কেরল ম্যাচ নিয়ে প্রশ্ন করলে হাবাস আবার ঠাট্টার মেজাজে! প্রসঙ্গই পাল্টে দিতে চাইলেন। ‘‘বাইরে আজ খুব গরম। এখানটায় বেশ ঠান্ডা। তাই না!’’ এটাই হয়তো চূড়ান্ত পেশাদার কোচের স্টাইল। যতই টেনশনের চোরাস্রোত নিজের ভেতরে বয়ে চলুক না কেন, দলের মধ্যে সেটা যেমন ছড়াবেন না, তেমনই মিডিয়ার সামনেও ফাঁস করবেন না! জোসে মোরিনহো, পেপ গুয়ার্দিওলার মতো বিশ্বসেরা কোচরাও তো একই নীতিতে বিশ্বাসী।
কলকাতার চিফ কোচ আসার মিনিট পনেরো-কুড়ি পর বোর্ডিং গেটের সামনে দেখা গেল তাঁর টিমের। বোরহা ফার্নান্দেজ থেকে গ্যাভিলান— সবাই এক-এক করে লাগেজ নিয়ে ঢুকছেন। যেমন গুরু, তেমনই শিষ্যরা। সবাই হালকা মেজাজে। হোয়াটসঅ্যাপে একে অপরে ছবি শেয়ার করছেন। কী কী গান স্টকে আছে দেখাচ্ছেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে গোটা দলের দিকে হাবাস চোখ রেখে চলেছেন। কোচের কাছে কোনও ফুটবলার ঘেঁষছিলেন না।
ফুটবলাদের ভিড়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মুখ সেই ইয়ান হিউম-ই। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক-হিরোর মুখের হাবভাবেই স্পষ্ট, চব্বিশ ঘণ্টা আগের রাগ এখনও কমেনি। কানে বড় হেড সেট গুঁজে মোবাইলে ‘জিউক বক্স’ ঘাঁটছিলেন। ইংরেজি গানের ভক্ত হিউম কোন গানটা শুনবেন সেটা ঠিক করতেই যেন ব্যস্ত। আশপাশে দাঁড়ানো যাত্রীরা ততক্ষণে আবদার শুরু করে দিয়েছেন। কেউ হিউমের সঙ্গে সেলফি তুলতে চান। কেউ তাঁর সই নেবেন। হিউম সবেতেই রাজি। এক বাঙালি যাত্রী তো আবার সেলফি তুলতে তুলতেই বলে দিলেন ‘‘কেরল ম্যাচটায় আমাদের রক্ষা কোরো বাবা।’’ হিউমও পাল্টা বললেন, ‘‘আরে, গত কালের চেয়েও খারাপ রেফারিং দেখেছি আমি। তবে পরের ম্যাচ না জিতে আমাদের কোনও উপায় নেই।’’
কিছুক্ষণের মধ্যেই টিম এটিকে কোচিগামী বিমানের পেটে। হাবাস-ই প্রথম। কোচের পর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। বেশির ভাগেরই কানে হেড সেট। সাড়ে চার ঘণ্টার সফরে সঙ্গী বলিউড আর ইংরেজি গান। কেউ কেউ স্যান্ডউইচ, কফি খেলেন। হাবাস অবশ্য জ্যাকেট গায়ে অধিকাংশ সময়টা ঘুমিয়েই কাটালেন। বেঙ্গালুরুতে বিমান যখন কিছুক্ষণের জন্য নামল, তখনই যা স্প্যানিশে কোচিং স্টাফের সঙ্গে একটুআধটু ঠাট্টা করলেন।
কেরল ম্যাচে হাবাসের টোটকা কি তা হলে বিন্দাস মেজাজ? মহাচাপের ম্যাচে কোনও চাপ না নিয়ে খেলাটা উপভোগ করতে বলবেন নিজের ছেলেদের? তবে ফ্লাইটেই এক এটিকে ফুটবলার বলছিলেন, ‘‘কোচকে আলাদা করে কিছু বলতে হবে না। আমরা জানি, টিমের এই অবস্থায় কী করতে হবে।’’
কোচি পৌঁছে বিমানবন্দরেই সচিন তেন্ডুলকরের কেরল ব্লাস্টার্সের একটা ঢাউস পোস্টার চোখে পড়ল। সেটার দিকে আড় চোখে দেখতে দেখতে আটলেটিকো কলকাতা ফুটবলাররা টিমবাসের দিকে এগোলেন। তার মধ্যেই দলের নবতম সংযোজন, যিনি গত বার ফাইনালে এই কেরলের বিরুদ্ধেই গোল করে ট্রফি কলকাতায় এনেছিলেন, সেই রফিক বললেন, ‘‘এই অবস্থা থেকেও উঠে দাঁড়ানো কিছু কঠিন নয়। আমাদের জিততে হবে, ব্যস!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy