খবরযোগ্য কিছু ঘটলে টিভির সান্ধ্য শো-এ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যাঁরা এক চ্যানেল থেকে আর এক চ্যানেলে ছোটাছুটি করেন, তার একটা কোড নাম আছে।
পুরোহিতগিরি।
ব্যস্ত পুরুতকে যেমন ছুটে ছুটে তাঁর যজমানদের সার্ভিস দিতে হয়, এঁরাও নিজেদের চাহিদা-সুবাদে একটা শো শেষ করেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটেন পরের স্টুডিওয়। দৌড়তে দৌড়তে লেপেল পরতে হয়, কারণ নতুন শো যে শুরু হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি-বিনোদন-ক্রিকেট-ফুটবল— সবেতেই বিশিষ্ট এমন পুরুতরা আছেন যাঁদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে একাধিক চ্যানেল প্রবল ভাবে চায়।
তা মঙ্গলবার ভারতীয় ক্রিকেটের রিখটার স্কেলে এত বড় ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার পরেও আশ্চর্য কাণ্ড— দেশজুড়ে ক্রিকেট-পুরুতের সংখ্যা বাড়েনি। লোঢা কমিশন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে সিএসকে আর রাজস্থানকে দু’বছরের নির্বাসনে পাঠাল। গুরুনাথ মইয়াপ্পন ও রাজ কুন্দ্রাকে আজীবন নির্বাসনে পাঠাল। অথচ হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা-মরাঠি চ্যানেলে মোটামুটি সেই এক মুখ।
কাহিনির সারমর্ম খুব সহজ— সন্ত্রাসের ক্রিকেট প্রশাসন এমন যুগান্তকারী রায়ের পরেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসেনি। এখনও সিস্টেমের মধ্যে থাকা লোকেরা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে— সাহসিকতা দেখাতে গিয়ে এই বুঝি বেঘোরে প্রাণ যায়। আজকের দিনে যাঁর সবচেয়ে প্রফুল্ল থাকার কথা যে, শ্রীনি-জমানার বিরুদ্ধে তাঁর একক লড়াই পূর্ণতা পেল, সেই শশাঙ্ক মনোহর পর্যন্ত মুখ খুলতে চাইছেন না।
শশাঙ্কের অবশ্য সাহসের অভাব ঘটেনি। কোনও কালে ছিলও না। তিনি সম্ভবত বীতশ্রদ্ধ। নতুন জমানায় যে সংস্কার দেখবেন ভেবেছিলেন, তার আবির্ভাবের কোনও চিহ্ন নেই। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি যে চোদ্দো বছর পর সেই আজহারউদ্দিনকে শাস্তি দেওয়া-পরবর্তী অধ্যায়ের সবচেয়ে ঐতিহাসিক হাতুড়ির ঘা মেরেছেন, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ওই যে বহু প্রচলিত কথা— স্যাকরার ঠুকঠাক, কামারের এক ঘা। বিচারপতি মুদগলের অনুসন্ধানী কমিটি যদি স্যাকরা হয়ে থাকে, বিচারপতি আর এম লোঢার কমিটি তা হলে কামার।
কিন্তু তার ‘এক ঘায়ে’ও কি সংস্কার হবে? বোর্ডের নতুন জমানার কেউ কেউ আম ক্রিকেট দর্শকের মতোই বলেছেন, ‘‘আহা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় দিন!’’ সত্যিই কি তাঁরা এটা মনে করেন? তা হলে তো শাস্তি দেওয়ার জন্য কেলেঙ্কারির আড়াই বছর বাদে সুপ্রিম কোর্টকে ব্যস্ত হতে হতো না। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন নিশ্চয়ই হালফিল বোর্ডের সবচেয়ে কলঙ্কিত মুখ। কিন্তু তিনি কি একাই দোষী?
১৩৪ দিন হল বোর্ড মসনদে শ্রীনি-রাজ নেই। বোর্ডের কোনও কাজকর্মে কি এখনও অবধি তা বোঝা গিয়েছে? মাইনে করা তিন উচ্চপদস্থ কর্মচারী আছেন বোর্ড প্রশাসনে। শ্রীধর, রত্নাকর শেঠি এবং সুন্দর রামন। এঁরা আগের বোর্ড প্রধানের বাছাই করা এবং ধরেই নেওয়া যায়, নতুন প্রশাসনে সরকারি আমলাদের মতো আক্রান্ত হতে পারেন।
একেবারেই না। এঁরা তিন জনই বহাল তবিয়তে আছেন। ইস্তফা দিয়েছেন একমাত্র কোনও রকম সাতে-পাঁচে না থাকা বোর্ডের মিডিয়া ম্যানেজার দেবেন্দ্র প্রভুদেশাই। শোনা যাচ্ছে, যে কোনও নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরের মিনিটেই প্রথম খবর পৌঁছে যাচ্ছে শ্রীনির কাছে। ক্ষমতা হারিয়েও যদি এত ক্ষমতা থাকে, তা হলে আর জমানা বদলাল কোথায়?
আরও বিস্ময়কর, সুন্দর রামন যিনি শ্রীনির ডান হাত বলে পরিচিত এবং আইপিএল পরিচালনার দায়িত্বে, তাঁকে এই সে দিন বার্বেডোজ ঘুরিয়ে আনল জগমোহন ডালমিয়ার বোর্ড। তিনি গিয়েছিলেন আইসিসি-র বৈঠকে ভারতীয় বোর্ডের প্রতিনিধিত্ব করতে। সারা দেশ জুড়ে আর কোনও পাত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষে কি না সুন্দর রামন! লোঢা-রিপোর্ট দেখলেই বেরোবে, সুন্দর সম্পর্কে যথেষ্ট তির্যক মন্তব্য সেখানে রয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর কাজকর্ম নিয়ে আরও তদন্ত হবে। এই লোক সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে ভারতীয় বোর্ডের হয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য আইসিসি-র সামনে প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন। তা হলে কোন জমানা শাস্তি পেল? একা শ্রীনির? নাকি নতুন জমানাও?
জগমোহন ডালমিয়া ব্যক্তিগত ভাবে পরিচ্ছন্ন প্রশাসন চান। আগে হলে একাই ময়দানে নেমে পড়তেন। কিন্তু এখন তিনি প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রী-তুল্য ক্ষমতা নিয়েও হয়ে গিয়েছেন সতর্ক রাষ্ট্রপতি। এই বুঝি প্রকরণে ভুল হয়ে গেল! এর পুরো সুযোগ নিয়ে পুরনো জমানার মৌতাত অব্যাহত। শোনা যাচ্ছে, বিজেপি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী অতীতে যেমন ‘নির্বিকল্প’ সাহায্য করেছেন শ্রীনিকে, আজও তা-ই করে চলেছেন। তিনি নাকি চাইছেন একটা রফা করিয়ে দিতে যে, তুমি থাকো আইসিসি নিয়ে, এরা করুক বোর্ড। কেউ কাউকে বিরক্ত কোরো না।
ললিত মোদীকে নিয়ে সুষমা স্বরাজ-বসুন্ধরা রাজের উপাখ্যান মিডিয়ায় আখ্যা পেয়েছে ‘ললিতগেট’ বলে। শ্রীনি এবং তাঁর প্রভাবশালী প্রশ্রয়দাতাদের কাহিনি যদি বিচারপতি লোঢার দ্বিতীয় রিপোর্টের পর প্রকাশ্যে আসে, আরও রোমাঞ্চকর হতে পারে। অবশ্য কোনও কিছু উদ্ঘাটিত হওয়ার আগেই এটা ‘শ্রীনিগেট’।
শ্রীনি চাইছেন যে কোনও মূল্যে তাঁর আইসিসি পদ আঁকড়ে থাকতে। ওটা চলে গেলে আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধরেও কিছু হবে না। তাই এ দিন রাজনৈতিক নেতাদের সর্বকালীন মিথ্যে ভাষণের রেকর্ডকেও ভেঙে দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেন? সিএসকে-র সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’’
শ্রীনি তাঁর মতো যাচ্ছেতাই বলতেই পারেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী জমানার ভারতীয় বোর্ড যে মঙ্গলবার সন্ধে অবধি ঠিক করতে পারেনি, বর্তমান আইসিসি চেয়ারম্যানকে নতুন মনোনয়ন থেকে আটকাবেই! একজন সদস্যও প্রেসিডেন্টকে ফোন করে বলেননি যে, এই লোকটা আমাদের বোর্ডের লজ্জা। যে কোনও মূল্যে ওকে সেপ্টেম্বরের বার্ষিক সাধারণ সভায় সরান।
বোর্ডের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, শ্রীনিকে সরিয়ে নতুন প্রতিনিধি নিয়োগ করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতারও দরকার নেই। সিম্পল মেজরিটিতে ১৬-১৫ হলেই চলবে। কিন্তু একে আর বিশ্ব দরবারে আমাদের হয়ে পাঠিও না, এটা বলার মতো সাহস সঞ্চয়কারী কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ঠিক এই জন্যই টিভি চ্যানেলে ক্রিকেট-পুরোহিতের সংখ্যা মঙ্গলবারের যুগান্তকারী রায়ে বাড়েনি। আর ঠিক এই জন্যই লোঢা কামারের আর এক ঘা লাগবে সেপ্টেম্বরের বৈঠকের আগে।
একমাত্র তখনই পিছনে ফিরে বলা যাবে, ১৪ জুলাই ২০১৫ একটা ঐতিহাসিক দিন ছিল ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy