ফুটবলের ময়দান থেকে অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক। যে দু’পায়ের গোলার মতো শটে একটা সময় জাল কাঁপাতেন, তাতে এখন হরিণের গতি। তিনি— ভারতের ‘ইউসেন বোল্ট’ অনিমেষ কুজুর।
ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে রবিবারই প্রথম বিশ্ব কন্টিনেন্টার টুরে ১০০ ও ২০০ মিটারে সোনা জিতেছেন। সময় করেছেন ১০.১৮ ও ২০.৭৭ সেকেন্ড। আদর্শ বোল্টের ভঙ্গিতে উৎসবে মাতলেও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আশ্চর্যজনক ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বছর বাইশের অনিমেষ। তাঁর লক্ষ্য যে ১০ সেকেন্ডের কম সময়ে ১০০ মিটার দৌড় শেষ করা। আর ২০০ মিটার শেষ করতে চান ২০ সেকেন্ডের কম সময়ে। লক্ষ্যপূরণ না হওয়ায় বিষাদের সুর অনিমেষের কণ্ঠে। সোমবার ভুবনেশ্বর থেকে আনন্দবাজারকে এই মুহূর্তে ভারতের দ্রুততম পুরুষ বললেন, ‘‘এখনও লক্ষ্যপূরণ হয়নি আমার। তবে আশা করছি, খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। কারণ, এ বছর একবার ২০.২ সেকেন্ডে আমার প্রিয় ইভেন্ট ২০০ মিটার দৌড় শেষ করতে পারায় আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে। আমাকে পারতেই হবে।’’ ২০০৯ সালে ১৯.১৯ সেকেন্ডে ২০০ মিটার দৌড় শেষ করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন বোল্ট। ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিক্সে ২০০ মিটারে বতসোয়ানার লেটসিলি টোবোগো সোনা জিতেছিলেন ১৯.৪৬ সেকেন্ড সময় করে।
অনিমেষের জীবনের অভিধানে অসম্ভব শব্দটাই নেই। আছে শুধু হার না মানা লড়াই। ছত্তীসগঢ়ের জাসপুরে জন্ম অনিমেষের। বাবা ছিলেন অ্যাথলিট। মা বাস্কেটবল খেলতেন। কিন্তু কলেজ পর্যায়ের পরে আর খেলা চালিয়ে যাননি। যোগ দেন পুলিশের চাকরিতে। চেয়েছিলেন অনিমেষ লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি করবে। এই কারণেই একমাত্র ছেলেকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন সৈনিক স্কুলে। কিন্তু অনিমেষের মন পড়ে থাকত মাঠে। স্ট্রাইকার হিসেবে বেশ নামও করেছিলেন। কিন্তু টানা ১২-১৩ বছর ফুটবল খেলার পরে এক দিন সিদ্ধান্ত নিলেন অ্যাথলিট হওয়ার।
কেন? অনিমেষ শোনালেন আশ্চর্য কাহিনি, ‘‘ফুটবলে আমার সতীর্থেরা সবসময় বলত, তোর উচ্চতা খুব ভাল। প্রচণ্ড গতিতে দৌড়তেও পারিস। সামনেই রাজ্য অ্যাথলেটিক্স। তুই নেমে পড়। ওদের উৎসাহেই অংশ নিই রাজ্য অ্যাথলেটিক্সে। সেই সময় অ্যাথলেটিক্স সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার ছিল না। ঠিক করলাম, ১০০ মিটার দৌড়ের পাশাপাশি অংশ নেব শট পাটেও। আমার সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ, কোনও অ্যাথলিটকে একই সঙ্গে এই দু’টি বিভাগে অংশ নেয় না। শট পাটের ইভেন্ট শেষ করেই দৌড়ে ছিলাম ১০০ মিটারে নামার জন্য।’’
ফুটবল ছাড়লেন কেন? অনিমেষের জবাব, ‘‘ফুটবলে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তা ছাড়া ফুটবল দলগত খেলা। লড়াই অনেক বেশি কঠিন। অ্যাথলেটিক্সে ব্যক্তিগত দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ অনেক বেশি পাওয়া যায়। ফুটবলের জনপ্রিয়তা প্রচার অনেক বেশি হলেও অ্যাথলেটিক্সে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটাই আমাকে আকর্ষিত করেছিল। যদিও খেলোয়াড় হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া একেবারেই সহজ ছিল না। বাবা আমার পাশে থাকলেও আপত্তি ছিল মা ও মাসির।’’
কী ভাবে রাজি করালেন মাকে? অনিমেষ বললেন, ‘‘আমার বাবা, মা দু’জনেই পুলিশে চাকরি করেন। এখন ওঁরা ডিএসপি। আমি ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম খেলোয়াড় হওয়ার। প্রথমে ফুটবলার। তার পরে অ্যাথলিট। কিন্তু বাবাকে সরাসরি কখনও বলতে পারিনি। বলেছিলাম, মেসোমশাইকে। তিনি বাবাকে বলেছিলেন, আমার স্বপ্নের কথা। বাবা এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মা ও মাসির আপত্তি ছিল। আসলে আমাদের পরিবারের কেউ খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি কখনও। এই কারণেই ওঁদের মনে সংশয় ছিল। ভেবেছিলেন, আমিও হয়তো ব্যর্থ হব। তাই বলতেন, মন দিয়ে লেখাপড়া করো। কিন্তু আমি লক্ষ্যে স্থির ছিলাম।’’
অ্যাথলেট হওয়ার পথ কতটা কঠিন ছিল? অনিমেষের কথায়, ‘‘অ্যাথলেটিক্স জগতটা সম্পর্কে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। আমার নিজের রাজ্য ছত্তীসগঢ়ে অ্যাথলেটিক্সের কোনও পরিকাঠামো ছিল না। ফলে শুরুর দিকে প্রচুর সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। আমার প্রথম কোচ দীনেশ তান্ডি সেই সময় ভীষণ ভাবেই সাহায্য করেছেন। অনূর্ধ্ব-২৩ অ্যাথলেটিক্সে ছত্তীসগঢ়ের হয়ে ভাল পারফরম্যান্স করায় ডাক পাই ওড়িশায় রিল্যায়্যান্সের হাইপারফরম্যান্স সেন্টারে। তার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওড়িশায় আসার পরেই উপলব্ধি করলাম ক্রীড়া সংস্কৃতি, পরিকাঠামো কী। ওড়িশা সরকার প্রচণ্ড গুরুত্ব দিচ্ছে ক্রীড়ার উন্নয়নে।’’
তিন বছর পরেই লস অ্যাঞ্জেলেসে অলিম্পিক্স। অনিমেষকে ঘিরে পদকের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ভারতবাসী। আপনি কি প্রত্যাশাপূরণ করতে পারবেন? অনিমেষ বলছিলেন, ‘‘আমি ধীরে ধীরে এগোতে চাই। আগামী বছর এশিয়ান ও কমলওয়েলথ গেমসে ভাল ফল করতে চাই। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এখন আমি ৪২ নম্বরে। এর আগে ৩২-এ ছিলাম। কিন্তু ইউরোপের প্রতিযোগিতাগুলিতে ভাল ফল করতে না পারায় র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে গিয়েছি। অভিজ্ঞতার অভাবই সমস্যায় ফেলেছিল। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোই লক্ষ্য। এই সমস্ত প্রতিযোগিতা থেকে যত বেশি সম্ভব পয়েন্ট অর্জন করতে চাই। লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সে কাজে লাগবে।’’ এর পরেই যোগ করলেন, ‘‘র্যাঙ্কিং নয়, আমার লক্ষ্য সময়ের মাপকাঠিতেই ২০২৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জন করা।’’
২০২৮ সালের অলিম্পিক্সে শুধু যোগ্যতা অর্জন নয়, অনিমেষের পাখির চোখ পদক। সময় নষ্ট না করে এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন তিনি। বলছিলেন, ‘‘আমার কোচ মার্টিন্স ওয়েন্সই অনুশীলনের রূপরেখা প্রস্তুত করছেন। আগামী বছরের জানুয়ারিতে সুইৎজ়ারল্যান্ড ও ফ্রান্সে ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ৬০ মিটার দৌড়ের ট্রেনিং নিতে যাব। এই ধরনের অনুশীলনের আসল উদ্দেশ্য হল, দৌড়ের শুরুটা ভাল করা।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)