Advertisement
E-Paper

জীবনের ইনিংস খেলল বলছে সিমন্স পরিবার

ভারতের কাপ-স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে মুম্বইয়ের ‘ঘরের ছেলে’ পরিবার থেকে কী পাচ্ছেন? শুধু নাকি লাভ অ্যান্ড হাগ! রাত সাড়ে বারোটার ওয়াংখেড়ে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৯
মাঠে বিজয়োৎসব সিমন্সদের।

মাঠে বিজয়োৎসব সিমন্সদের।

ভারতের কাপ-স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে মুম্বইয়ের ‘ঘরের ছেলে’ পরিবার থেকে কী পাচ্ছেন?

শুধু নাকি লাভ অ্যান্ড হাগ!

রাত সাড়ে বারোটার ওয়াংখেড়ে। বিশালাকায় ক্লাইভ লয়েডের সঙ্গে এই মাত্র যিনি এমসিএ লাউঞ্জ ছেড়ে বেরোলেন, পরিচয়ে তিনি জেস সিমন্স। বৃহস্পতিবারের ভারত-বধকারী লেন্ডলের কাকিমা। যাঁকে ম্যাচ শেষের ঘণ্টাখানেক বাদেও মোহাবিষ্ট দেখাচ্ছে। “কী খেলল লেন্ডল, উফ!” বলতে বলতে মুহূর্তে জেস যোগ করে দেন, “আমার তো মনে হয় জীবনের সেরা ইনিংসটা ও আজ খেলে ফেলল। ভারতের মাঠে ভারতকে হারানো, স্রেফ ভাবা যায় না!”

শুনলে যে কোনও ভারতবাসীর কষ্ট লাগবে। যে মাঠ এত দিন ছিল বিশ্বজয়ের মাঠ। যে মাঠ এ দিনও প্রথম ইনিংস পর্যন্ত ২ এপ্রিলের মায়াবী স্মৃতি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল বিরাট-ধোনির হাত ধরে। যে মাঠে বৃহস্পতিবার শুধুমাত্র লেখালেখি হওয়ার কথা ছিল বিরাট কোহালির ব্যাটিং-ঐশ্বর্য নিয়ে, মাত্র দেড়টা ঘণ্টা আর একটা লোক সেই উৎসবের ওয়াংখেড়েকে কি না শ্মশান বানিয়ে চলে গেল।

আর সেই লোক আর কেউ নয়, মুম্বইয়েরই ঘরের ছেলে।

পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে যখন লেন্ডলের কাকিমা কথা বলে চলেছেন, আচমকাই দেখা গেল পাশ দিয়ে কর্ডন করে মুকেশ অম্বানীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মহামূল্য ‘কোট’ পাওয়া দূরস্থান, কাছে ঘেঁষারই কোনও সম্ভাবনা নেই। নিঃসন্দেহে আজ যিনি দেশের দুঃখীতম চরিত্র। লেন্ডল সিমন্স তো আর দিন সাতেকের মধ্যে নামবেন তাঁরই টিমের জার্সিতে। তাঁর টিম মুম্বই ইন্ডিয়ান্স জার্সিতে!

এবং এ হেন ঘরের ছেলের হাতে দেশের স্বপ্নভঙ্গের প্লটকে যদি নাটকীয় মনে হয়, তা হলে সিমন্সের সোজাসুজি কাপ সেমিফাইনাল খেলতে নেমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটকে কী বলা সম্ভব? চোট লেগে ফ্লেচার বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে না গেলে সিমন্সের খেলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। অতি সংক্ষিপ্ত নোটিশে তাঁকে মুম্বই উড়ে আসতে হয় দেশের নির্বাচক প্রধান ক্লাইভ লয়েডের ‘এসওএস’-এ। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে পুরোটাই এসেছেন ঘুমোতে-ঘুমোতে। মুম্বই ঢুকেও যে সামান্য সময় পেয়ছেন, পুরোটা নাকি কাটিয়েছেন ঘুমিয়ে! “তার পর তো এই ইনিংসকে রূপকথা বলতে হয়, তাই না?” বলে দিলেন জেস।

আর সিমন্স তিনি নিজে কী বলছেন?

ভারত-বধের নায়ক বললেন, তিনি ম্যাচে যথেষ্ট চাপে ছিলেন। বললেন, “ভাগ্য আজ আমার সঙ্গে ছিল। মনে হচ্ছিল দিনটা আজ আমার হতে যাচ্ছে।” বললেন যে, আইপিএল তাঁকে হাতে ধরে মুম্বই উইকেটের চরিত্র বুঝতে শিখিয়েছে। “অনেক সুবিধে হয়ে গিয়েছিল এখানে সেমিফাইনাল পড়ায়। আমি তো জানতাম উইকেট কেমন হবে। তবে ভারতীয় বোলিং দেখেও আজ মনে হচ্ছিল, ওরা পারবে না। দু’টো পেসার আছে ওদের। কিন্তু বাড়তি গতি কারও নেই। আর আমাদের এতগুলো পাওয়ার হিটার!”

রাতের দিকে ম্যাচ দেখতে আসা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকরকে ফোনে ধরা হলে, তিনিও ভারতীয় বোলারদের সে ভাবে কোনও দোষ দিলেন না। বরং পুরো কৃতিত্বটাই সিমন্স ও তাঁর দশ সহযোদ্ধাকে দিয়ে গেলেন। ওয়াংখেড়েও তো দেখা গেল, শেষ পর্যন্ত কোনও রাগ পুষে রাখল না ‘ঘরের ছেলের’ উপর। আন্দ্রে রাসেল যখন বিশাল ছক্কায় ম্যাচটা শেষ করে দিলেন, সচিন তেন্ডুলকর স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেল পুরো গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে! জয়ী নায়ককে অভিবাদন জানাচ্ছে, টিম বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে, তবুও! দেখলে বিশ্বাস হবে না, মিনিট কুড়ি আগেও সিমন্স ছক্কা হাঁকানোয় এই একই দর্শকপুঞ্জ ধাক্কা মেরে বার করে দিয়েছে খাবার বিক্রেতাকে! বিশ্বাস হবে না, এই একই দর্শকপুঞ্জ সমানে চরম তুকতাক করে যাচ্ছিল প্রত্যেক বল পিছু। ‘ওরে সিমন্স হেলমেট খুলে খেলছে, দ্যাখ এ বার যাবে’, ‘আরে তুই এখানে দাঁড়া, তা হলে উইকেট পড়বে’ ইত্যাদি, ইত্যাদি।

আসলে কেউ ভাবতেই পারেনি বিরাট কোহালির আরও এক ব্যাটিং-বিস্ফোরণের পর নতুন কোনও পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ওয়াংখেড়েতে বিকেল থেকে যা চলছিল, দেখলে মনে হবে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেমিফাইনাল-যুদ্ধ নেহাতই নিমিত্ত মাত্র। আকর্ষণের এক ও একমাত্র জায়গা কোহালি। দিল্লিনিবাসী এক পরিবার পাওয়া গেল, যাঁরা তেরঙ্গা পাগড়ি পরে কপাল থেকে ঠোঁট পর্যন্ত বিরাট লিখে ওয়াংখেড়েতে ঢুকছেন। আবার বেঙ্গালুরুনিবাসী এক জন থাকলেন, যাঁকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি মুম্বই ছুটে আসা থেকে। ক্রিকেটমহল থেকে বোর্ডকর্তা সবাই তখন বিরাট প্রত্যাশায় অপেক্ষমান। ওয়াড়েকর থেকে লালচাঁদ রাজপুত, অনুরাগ ঠাকুর কে বাদ গেলেন? শেন ওয়ার্ন যে শেন ওয়ার্ন, তিনি পর্যন্ত বিরতিতে বলে গেলেন, “সচিনের সঙ্গে তুলনায় যাব না। কিন্তু দু’জনেই গ্রেট। কী খেলছে ছেলেটা!”

মধ্যরাতের আরব সাগর তীরে দাঁড়ালে মনে হবে, ও সব বোধহয় গত জন্মে ঘটেছিল। মুম্বই বাড়ি ফিরছে, মুখে ভারতীয় বোলারদের আদ্যশ্রাদ্ধ। একটু আগে ভারতীয় জয়োচ্ছ্বাসের বদলে যাঁদের ক্যারিবিয়ান গ্যাংনাম দেখতে হয়েছে। আসলে আজকের পর বিশ্বকাপটাই তো শেষ। ইডেনে এর পর বিশ্বকাপ ফাইনাল থাকবে, কিন্তু ভারত থাকবে না। ক্রিস গেইল থাকবেন, বিরাট কোহালি থাকবেন না।

কোনও এক ফিল সিমন্সের ভ্রাতুষ্পুত্র সব কেড়ে নিয়ে গেলেন।

ছবি: উৎপল সরকার।

wt20
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy