Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শরীর মন্দির, পেশি কারুকার্য

জয় বাবা ফেলুনাথ-এ জটায়ুকে মনোতোষ রায় বলেছিলেন, ‘শরীর হচ্ছে ওয়র্ক অব আর্ট। এটা মন্দির। আর পেশিগুলো তার মধ্যে কারুকার্য।’ সে কথা মনে রেখেছেন খুব কম লোকই। কোচবিহারের এক যুবক ছোটবেলা থেকেই শরীরের সেই যত্ন নিয়েছেন। কষ্টও স্বীকার করেছেন। সুরজিৎ রায়-এর সঙ্গে কথা বললেন অনিতা দত্ত।জয় বাবা ফেলুনাথ-এ জটায়ুকে মনোতোষ রায় বলেছিলেন, ‘শরীর হচ্ছে ওয়র্ক অব আর্ট। এটা মন্দির। আর পেশিগুলো তার মধ্যে কারুকার্য।’ সে কথা মনে রেখেছেন খুব কম লোকই। কোচবিহারের এক যুবক ছোটবেলা থেকেই শরীরের সেই যত্ন নিয়েছেন। কষ্টও স্বীকার করেছেন। সুরজিৎ রায়-এর সঙ্গে কথা বললেন অনিতা দত্ত।

সুরজিৎ রায়।

সুরজিৎ রায়।

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:৩১
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনি কবে থেকে শরীর চর্চা শুরু করেন?

উত্তর: ২০১১ সাল থেকে। তার আগে ফুটবল খেলতাম।

প্রশ্ন: ফুটবল ছেড়ে শরীর চর্চায় এলেন কেন?

উত্তর: হেসে) অতিরিক্ত মোটা হয়ে গিয়েছিলাম! শরীরের উচ্চতা অনুযায়ী ওজন খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল। মাঠে দৌড়োদৌড়ি করতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ব্যায়াম চর্চা, শরীর চর্চা শুরু করি, যাতে ওজন কমানো যায়।

প্রশ্ন: বাড়িতে কেউ খেলাধুলো করতেন?

উত্তর: না। বাবার দিকে বা কেউ করতেন না। তবে মামার বাড়িতে খেলাধুলার পরিবেশ ছিল। মামারা খেলতেন। মামা, মাসি বেঙ্গল টিমের ভলিবল প্লেয়ার ছিলেন।

প্রশ্ন: ফুটবল কি শখে খেলতেন?

উত্তর: না, মন দিয়েই খেলেছি। কোচবিহার জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে খেলেছি। হুগলিতে খেলতে গিয়েছি। ডিফেন্সে খেলতাম। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলো করতাম। তখন মামা-মাসিদের দেখে উৎসাহিত হতাম। সাত-আট বছর বয়স থেকেই ফুটবল খেলতাম। জেলার মাঠে ফুটবলের প্রশিক্ষণও নিয়েছি।

প্রশ্ন: ব্যায়াম চর্চা করেন কখন? কোথায় করেন?

উত্তর: কোচবিহারের দীপনারায়ণ ব্যায়ামাগারে সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত।

প্রশ্ন: ব্যায়াম চর্চা শুরু করেন কী ভাবে?

উত্তর: আমার প্রশিক্ষক রাজা ফারুক সেলিম আমায় প্রথমে পাওয়ার লিফটিং বা ভারোত্তোলনে উৎসাহ দেন। অনুশীলন করতে করতেই ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় অংশ নিই ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। সেখানে ‘স্ট্রংম্যান অব কোচবিহার’ হই।

প্রশ্ন: কোন কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন?

উত্তর: ভারোত্তোলনে তিন বার রাজ্যস্তরে ‘স্ট্রংম্যান’ হই। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক স্তরে লখনউয়ে পঞ্চম স্থান পাই।

প্রশ্ন: তাহলে আপনি ভারোত্তোলন এবং বডি বিল্ডিং— দু’য়েরই চর্চা করছেন?

উত্তর: না। ভারোত্তোলন ছেড়ে দিয়েছি ২০১৫ সালে। এখন শুধুই ব্যায়ামের চর্চাই করি।

প্রশ্ন: ভারোত্তোলন ছাড়লেন কেন?

উত্তর: ভারোত্তোলন বা পাওয়ার লিফটিংয়ে তেমন কোনও সুযোগ মিলছিল না আসলে!

প্রশ্ন: আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?

উত্তর: আমার বাড়ি কোচবিহা-২ ব্লকের খাগরাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সোনার বাংলা কলোনিতে। মা, বাবা দাদা আছেন।

প্রশ্ন: বাবা কী করেন?

উত্তর: বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।

প্রশ্ন: বডি বিল্ডিং করতে গেলে তো প্রচুর পুষ্টিকর খাদ্যের দরকার হয়। সেই খরচ বহন করেন কী ভাবে?

উত্তর: খুবই অসুবিধে হয়। বাবাকে সংসার সামলে আমায় আলাদা করে দেখভাল করতে হচ্ছে। রোজ দেড় কিলোগ্রাম করে মুরগির মাংস খেতে হয়। আমার খাবার তালিকায় রয়েছে প্রতিদিন ২৫টি করে ডিমও। এ ছাড়া, আপেল, লেবু আর মরসুমি ফল তো আছেই। প্রয়োজনীয় কিছু প্রোটিনও রয়েছে, যা প্রতিদিনই দরকার হয়।

প্রশ্ন: বডি বিল্ডিং বা দেহসৌষ্ঠবে আপনার সাফল্য কেমন?

উত্তর: ২০১৫ সালে শুধু বডি বিল্ডিংয়েই মনোনিবেশ করি। ২০১৫ সালে ‘কোচবিহারশ্রী’ হই। ওই বছরই নিজস্ব বডিওয়েট বিভাগে ‘নর্থবেঙ্গলশ্রী’ হই। ২০১৬ সালে কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নিইনি। ২০১৭ সালে আবারর ‘নর্থবেঙ্গলশ্রী’ নির্বাচিত হই। ২০১৮ সালে ‘কোচবিহারশ্রী’। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া আয়োজিত ফেডারেশন কাপে তৃতীয় স্থান পাই। সেখান থেকে জাতীয় স্তরে নির্বাচিত হই। ২০১৮ সালে গুয়াহাটিতে ‘সিনিয়র মিস্টার ইন্ডিয়া’ হলাম নিজস্ব বডিওয়েট বিভাগে। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিই জার্মানির হামবুর্গে। সেখানে ২৯টি দেশ অংশ নিয়েছিল। আমার বিভাগটি ছিল শর্ট বিভাগ। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতের উচ্চতা হবে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি, ওজন হবে ৬৫ কিলোগ্রাম। সেই বিভাগে ৭৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে আমি ষষ্ঠ স্থান লাভ করি।

প্রশ্ন: কী কী প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

উত্তর: আমার বাড়ি কোচবিহার শহর থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে। দিনে ১৮ কিলোমিটার সাইকেলে যাতায়াত করি শীতে, গ্রীষ্মে, বর্ষায়। বাড়ির অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন! আর্থিক অবস্থা আমাদের তেমন স্বচ্ছল নয়। বাবা অনেক কষ্ট করে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে আমায় উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। দীপনারায়ণ ব্যায়ামাগার থেকে যাবতীয় সাহায্য পাই। নিখরচায় ব্যায়ামাগারে শরীর চর্চার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছি। আর হ্যাঁ, আমার প্রশিক্ষক রাজা ফারুক সেলিম আমায় বিনাপয়সায় প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি সাহায্যের খুব প্রয়োজন।

প্রশ্ন: জার্মানি যাতায়াতের খরচ কী ভাবে বহন করলেন?

উত্তর: দীপনারায়ণ ব্যায়ামাগার, জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং জেলার কিছু ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ আর্থিক সাহায্য করেন।

প্রশ্ন: কত দূর পড়াশোনা করেছেন?

উত্তর: উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বি টি অ্যান্ড ইভনিং কলেজ থেকে ২০১৩ সালে স্নাতক হই।

প্রশ্ন: কোনও আলাদা পেশা আছে আপনার?

উত্তর: আমি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করি। তাতে কোনও মতে হাত খরচটুকু চলে, এই আর কী!

প্রশ্ন: ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো বডি বিল্ডিং তো তেমন জনপ্রিয় নয়। তা হলে আপনি এটা বাছলেন কেন?

উত্তর: আমার প্রশিক্ষক রাজা ফারুক সেলিমকে দেখেই অনুপ্রাণিত হই! তিনিই আমার আদর্শ!

প্রশ্ন: নতুন প্রজন্ম কি এতে উৎসাহী?

উত্তর: হ্যাঁ, আমায় দেখে অনেকে এগিয়ে এসেছেন। খুবই উৎসাহ নিয়ে শিখছেন।

প্রশ্ন: আপনি নিজে কি তাঁদের সাহায্য করেন?

উত্তর: অবশ্যই! দশ-বারোজনকে বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।

প্রশ্ন: উত্তরবঙ্গে বডি বিল্ডিংয়ের ভবিষ্যত কেমন?

উত্তর: এখানে অনেক প্রতিভাবান বডি বিল্ডার আছেন। সরকার থেকে যদি সাহায্য পাওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্র থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য মিলতে পারে।

প্রশ্ন: আপনার স্বপ্ন কী?

উত্তর: ২০২০ সালে ‘মিস্টার ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছে আছে। তবে সরকার পাশে দাঁড়ালে তবেই সেটা সম্ভব হতে পারে।

প্রশ্ন: সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন?

উত্তর: হ্যাঁ, ড্রিস্টিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর ও অন্যান্য সরকারি দফতরেও আবেদন জানিয়েছি। এখনও পর্যন্ত কোনও সাড়া পাইনি। যেমনই হোক, একটা চাকরি পেলে ভাল হয়!

প্রশ্ন: উত্তরবঙ্গে বডি বিল্ডিংয়ের পরিকাঠামো কেমন?

উত্তর: আগের চেয়ে পরিকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে। আগে চর্চা করার জন্য ভাল সরঞ্জাম ছিল না। এখন বডি বিল্ডাররা অনেক উন্নত মানের সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারছেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষকও ছিল না আগে। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকেরা আছেন। দরকার শুধু একটু সরকারি সাহায্যের। উত্তরবঙ্গ থেকে তা হলে আগামিদিনে আমরা ভাল ফল করতে পারব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Body Building Bodybuilder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE