Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বিরাটের দুরন্ত সেঞ্চুরিতেও রুদ্ধশ্বাস পরিণতি, হারলেও কুর্নিশ রাসেলকে

অবিশ্বাস্য ছক্কা বৃষ্টি, তীরে এসে তরী ডুবল নাইটদের

শেষ ওভারে বিরাট কোহালির হাতে স্পিন ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না। যুজবেন্দ্র চহাল তত ক্ষণে তিন ওভারে ৪৫ রান দিয়ে বসে আছেন। বাকি দুই স্পিনার মইন আলি এবং পবন নেগি।

হুঙ্কার: ৫৮ বলে ১০০। ইডেন মাতালেন বিরাট। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

হুঙ্কার: ৫৮ বলে ১০০। ইডেন মাতালেন বিরাট। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

কৌশিক দাশ
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫৮
Share: Save:

অবিশ্বাস্য শব্দটাকে ক্রিকেটীয় অভিধান থেকে প্রায় মুছে দিচ্ছিলেন তিনি।

অলৌকিক শব্দটা আর ব্যবহার করা উচিত কি না, প্রশ্নটা উঠেই গিয়েছিল শুক্রবারের ইডেনে।

উঠিয়ে দিয়েছিলেন সেই ‘অতিমানব’ আন্দ্রে রাসেল!

স্কোরবোর্ড বলছে, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ১০ রানে হারিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্সকে। কিন্তু এটা বলছে না, রাসেল (২৫ বলে ৬৫, দুটি চার, ন’টি ছয়) নামক কালবৈশাখী কী তাণ্ডব তুলে দিয়েছিল ক্রিকেটের নন্দনকাননে। আরসিবির ২১৩ রান তাড়া করতে নেমে শেষ পাঁচ ওভারে কেকেআরের দরকার ছিল ৯৩ রান। পরের চার ওভারের রান যথাক্রমে ১৭, ১৫, ১৮, ১৯। শেষ ১০ বলে দরকার ছিল ৩৬। মার্কাস স্টোয়নিসের করা ১৯তম ওভারের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ বল গ্যালারিতে ফেলে দিয়ে রাসেল হিসেবটা নামিয়ে আনেন ৬ বলে ২৪ রানে।

শেষ ওভারে বিরাট কোহালির হাতে স্পিন ছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না। যুজবেন্দ্র চহাল তত ক্ষণে তিন ওভারে ৪৫ রান দিয়ে বসে আছেন। বাকি দুই স্পিনার মইন আলি এবং পবন নেগি। হয়তো বাঁ হাতি নীতীশ রানাকে (৮৫ ন.আ.) স্ট্রাইকে দেখে অফস্পিনার মইনের হাতেই বলটা তুলে দেন কোহালি। মইনের প্রথম দুটো বলে স্ট্রাইক নিয়ে মাত্র এক রান তুললেন রানা। বাকি চার বলে রাসেল চারটে ছয় মারতে পারলে ‘অসম্ভব’ শব্দটা হয়তো সত্যি তুলেই দিতে হত অভিধান থেকে।

ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার ব্রায়ান ক্লোজ এক বার গল্পটা তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছিলেন। ১৯৫২ সালে হে়ডিংলিতে ফ্রেডি ট্রুম্যান তখন আগুন ঝরাচ্ছেন। ভারত শূন্য রানে চার। ওই সময় এক ভারতীয় ব্যাটসম্যান নাকি আম্পায়ারকে এসে বলেন, সাইটস্ক্রিনটা একটু সরাতে হবে। আম্পায়ার জানতে চান, কোথায় রাখতে চান সাইটস্ক্রিন? ব্যাটসম্যানের জবাব ছিল, আমার ও বোলারের মাঝে!

‘কিং কোহালি’ আর ‘মাসল রাসেল’-এর তাণ্ডব দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, দু’দলের বোলাররা এ দিন একটু ঘুরিয়ে আবেদনটা করতেই পারতেন আম্পায়ারদের কাছে— ‘‘স্যর, কোহালি আর রাসেল যখন ব্যাট করবে, সাইটস্ক্রিনটা যদি ব্যাটসম্যান আর বোলারদের মাঝে রাখার একটু ব্যবস্থা করেন, ভাল হয়!’’

আরসিবি শেষ ৫ ওভারে তুলল ৯১ রান। কেকেআর ৮২। দু’দলের শেষ ৬ ওভারের হিসেব ধরলে রান উঠল মোট ২০৫! আইপিএল ছেড়ে দিন, কস্মিনকালে কোনও টি-টোয়েন্টি ম্যাচে যা ওঠেনি। দু’দলের ব্যাটসম্যানরা মোট ছয় মারলেন ২৬টি! এর পরে বোলারেরা যদি সাইটস্ক্রিনের নিরাপত্তা দাবি করেন, অন্যায় কোথায়। কোহালি (১০০) সেঞ্চুরি করলেন ৫৮ বলে, মইন ৬৬ করলেন ২৮ বলে! কিন্তু ২১৩ রানের লক্ষ্যও টপকে যেতে পারত কেকেআর। পারল না কয়েকটি কারণের জন্য।

প্রথমেই থাকবে দীনেশ কার্তিকের অধিনায়কত্ব। বোলিংয়ের সময় বারেবারে অহেতুক ফিল্ডিং বদলালেন। এক বার থার্ডম্যানকে তুলে আনলেন বৃত্তের মধ্যে। কোহালির মিসহিট পুল ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে থার্ডম্যানেই পড়ল। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন, এত বড় রান তাড়া করতে নেমেও কার্তিক কেন রাসেলকে চারে পাঠালেন না?

রাসেল নামলেন সেই ছয়ে। আর গোটা দুয়েক বল তিনি বেশি পেলে কেকেআরের ইডেনে টানা তিন নম্বর ম্যাচ হারতে হয় না।

দ্বিতীয় কারণ, কচ্ছপকে হার মানিয়ে দেওয়া উথাপ্পার ব্যাটিং। এই রকম পিচে, আস্কিং রেট যেখানে ১৪-১৫, সেখানে উথাপ্পা করলেন ২০ বলে ৯। রাসেল যখন নামলেন, স্কোর ১১.৫ ওভারে ৭৯।

তিন নম্বর কারণ, কুলদীপ যাদবের বোলিং। চায়নাম্যান বোলার চার ওভারে দিলেন ৫৯। তার মধ্যে একটা ওভারে মইন নিলেন ২৬ রান।

এ দিন ব্যাটিংয়ের উত্তরমেরু-দক্ষিণমেরু দর্শন করল ইডেনের ষাট হাজার দর্শক। কোহালির ব্যাটিং যদি টাইমিং আর শিল্পের মেলবন্ধন হয়, তা হলে রাসেলেরটা ছিল পেশিশক্তির বিচ্ছুরণ। যেখানে মিসহিট বলে কোনও শব্দ নেই, যেখানে ফুটওয়ার্ক বস্তুটা ডাগআউটে ফেলে এলেও চলে। কিন্তু কোথাও একটা শব্দ যেন মিলিয়ে দিয়ে গেল শুক্রবারের দুই নায়ককে— ফিটনেস।

স্কোরকার্ড
আরসিবি ২১৩-৪ (২০)
কলকাতা নাইট রাইডার্স ২০৩-৫ (২০)

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর
পার্থিব ক রানা বো নারাইন ১১ ১১
কোহালি ক শুভমন বো গার্নি ১০০ ৫৮
আকাশদীপ ক উথাপ্পা বো রাসেল ১৩ ১৫
মইন ক প্রসিদ্ধ বো কুলদীপ ৬৬ ২৮
স্টোয়নিস ন. আ. ১৭ ৮
অতিরিক্ত ৬
মোট ২১৩-৪ (২০)
পতন: ১-১৮ (পার্থিব, ৩.২), ২-৫৯ (আকাশদীপ, ৮.৫), ৩-১৪৯ (মইন, ১৫.৬), ৪-২১৩ (কোহালি, ১৯.৬)।
বোলিং: হ্যারি গার্নি ৪-০-৪২-১, সুনীল নারাইন ৪-০-৩২-১, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ ৪-০-৫২-০, আন্দ্রে রাসেল ৩-০-১৭-১, কুলদীপ যাদব ৪-০-৫৯-১, পীযূষ চাওলা ১-০-১০-০।

কলকাতা নাইট রাইডার্স
লিন ক কোহালি বো স্টেন ১ ২
নারাইন ক পটেল বো সাইনি ১৮ ১৬
শুভমন ক কোহালি বো স্টেন ৯ ১১
উথাপ্পা ক নেগি বো স্টোয়নিস ৯ ২০
রানা ন. আ. ৮৫ ৪৬
রাসেল রান আউট ৬৫ ২৫
কার্তিক ন. আ. ০ ০
অতিরিক্ত ১৬
মোট ২০৩-৫ (২০)
পতন: ১-৬ (লিন, ০.৬) ২-২৪ (নারাইন, ৩.৫), ৩-৩৩ (শুভমন, ৪.৬), ৪-৭৯ (উথাপ্পা, ১১.৫), ৫-১৯৭ (রাসেল, ১৯.৫)।
বোলিং: ডেল স্টেন ৪-০-৪০-২, নবদীপ সাইনি ৪-০-৩১-১, মহম্মদ সিরাজ ৪-০-৩৮-০, মার্কাস স্টোয়নিস ৪-০-৩২-১, যুজবেন্দ্র চহাল ৩-০-৪৫-০, মইন আলি ১-০-১৩-০।

কোহালির জিমে কোথাও রাখা আছে মেশিনটা। বছর দুয়েক আগে নিয়েছিলেন। এই মেশিন শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গা প্রায় চর্বিহীন করে তুলতে পারে। শরীরকে নির্মেদ করে তোলার অর্থ হল রিফ্লেক্স মারাত্মক বেড়ে যাওয়া। এতটাই দ্রুতগতিতে নড়াচড়া করেন কোহালি যে, বাকি ব্যাটসম্যানদের থেকে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বলের কাছে পৌঁছতে পারেন। যেটা তফাত হয়ে যায় মিসহিট ও অনিন্দসুন্দর টাইমিংয়ের মধ্যে।

রাসেলের ফিটনেসটা একটু অন্য ধরনের। তিনি দ্রুত ছোটেন না, কিন্তু কার্ডিয়ো এবং ওয়েটলিফ্টিং করে নিজেকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন, সেখানে তাঁর টেকনিক নিয়ে আর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন না।

আরসিবি ম্যাচের আগের দিন যখন তাঁর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, হোটেলে গভীর রাতে নিজেকে ফিটনেস রুটিনে ডুবিয়ে রেখেছিলেন রাসেল। বৃহস্পতিবার রাত দুটো নাগাদ তাঁর ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, এক মনে সাইক্লিং করে চলেছেন এই ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার। সঙ্গে একটি বার্তাও— ‘‘ফোকাস। তোমরা সবাই যখন ঘুমিয়ে, আমি ডুবে পরিশ্রমে।’’ রাসেল তাঁর পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন। কিন্তু কুলদীপ পাচ্ছেন কোথায়? আরসিবি ম্যাচের আগে নিজের ছোটবেলার কোচ কপিল দেব পাণ্ডের সঙ্গে কথা হয় কুলদীপের। ম্যাচ শুরুর আগে এ দিন কানপুর থেকে ফোনে কপিল পাণ্ডে বলছিলেন, ‘‘কুলদীপ মনে করছে, ইডেনে পিচে ব্যাটসম্যানরা খুব সুবিধে পাচ্ছে। কিন্তু আমি বলেছি, ফ্লাইট আর স্পিন ঠিক করে করতেই হবে। আরও বলেছি, ব্যাটসম্যানকে কভার অঞ্চল দিয়ে খেলানোর চেষ্টা কর।’’

কুলদীপ সেই কাজটা করতে গিয়েছিলেন। ফ্লাইট দিয়ে শুরু করেন কোহালির বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই বলটা ইউসেইন বোল্টের দ্রুততায় বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়ার পরে বোধ হয় আত্মবিশ্বাস টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

শাহরুখহীন ইডেনে বাদশার মুকুট শেষ পর্যন্ত উঠল কোহালি মাথাতেই। কিন্তু পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারছেন কি তিনি? তাঁর জাতীয় দলের দুই রিস্টস্পিনার (কুলদীপ এবং চহাল) মিলে ৭ ওভারে দিলেন ১০৪ রান!

আরসিবি অধিনায়ক হাসতে পারেন, ভারত অধিনায়ক কি হাসছেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

KKR RCB Andre Russell IPL 2019
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE