Advertisement
E-Paper

বোর্ডের মসনদে এক বছর পূর্তি সৌরভের

বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে আজ, ২৩ অক্টোবর, এক বছর পূর্ণ হচ্ছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছেন বাইশ গজে প্রাক্তন সতীর্থ, ক্রীড়া প্রশাসনে সঙ্গী, প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বন্ধু...বোর্ড প্রেসিডেন্টের বার্তা— দু’তিনটে দিন ধৈর্য ধরে দেখা যাক। থরহরিকম্প বাঁধিয়ে তো সুরাহা হবে না!

সঞ্জয় দাস

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৩১
স্মরণীয়: এক বছর আগে বোর্ড প্রধানের চেয়ারে বসার মুহূর্তে সৌরভ। 

স্মরণীয়: এক বছর আগে বোর্ড প্রধানের চেয়ারে বসার মুহূর্তে সৌরভ। 

এক বছর আগের ২৩ অক্টোবর। হোটেলের তেত্রিশ তলার ঘরে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। পিছনে আরব সাগরের মনোরম ঢেউ খেলছে। সে দিকে তাকিয়ে নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, ‘‘কী রে মনে পড়ে সেই দিনটা? এই ওয়াংখেড়েতেই তুই আর আমি এসেছিলাম অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের ট্রায়াল দিতে।’’

মনটা তখন সত্যিই দৌড়চ্ছিল কৈশোরে। প্রায় একত্রিশ বছর আগের কথা। ওয়াংখেড়েতে ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলাম আমি আর সৌরভ (গঙ্গোপাধ্যায়)। সামনেই জুনিয়র এশিয়া কাপ। পাকিস্তানে হবে। সেই সময়ে কে ভাবতে পেরেছিল, বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভের সঙ্গী হয়ে এক দিন ফিরব ওয়াংখেড়েতে!

অনূর্ধ্ব পনেরোর সময় থেকে সৌরভের সঙ্গে একসঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি। শুরুর সেই দিনগুলোতে আমাদের আরও দুই বন্ধু ছিল। সচিন তেন্ডুলকর আর বিনোদ কাম্বলি। সকলে একসঙ্গে কৈলাস ঘাটানির দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছি। তখন কে জানত, খেলোয়াড়-অধিনায়কের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে আমাদের এক জনের মাথায় উঠবে ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোত্তম মুকুট!

আরও পড়ুন: ধোনিদের মরণ-বাঁচন ম্যাচে নজরে তাহির

আজ সৌরভের বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক বছর পূর্তির দিন। প্রশাসক হিসেবে কতটা সফল হল, তা বিচার করবেন বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষকেরা। আমি বন্ধু হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ক্রিকেটার বা অধিনায়ক হিসেবে যে আগ্রাসী, নাছোড় আর হার-না-মানা সৌরভকে দেখতাম, তাকেই যেন দেখতে পেয়েছি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে।

আরও পড়ুন: নতুন বল হাতে পেয়ে দুরন্ত সিরাজ, কৃতজ্ঞ বিরাট ভাইয়ের কাছে​

যেমন, বোর্ডের সিংহাসনে বসার আগের দিন, অর্থাৎ ২২ অক্টোবর। আমরা কলকাতা থেকে মুম্বই গেলাম। মুম্বই নেমে সোজা বিমানবন্দর থেকে বোর্ডের অফিসে চলে গেল। তত ক্ষণে জেনে গিয়েছি, ওর সঙ্গী হয়েছে লর্ডসের সেই অভিষেক টেস্টের ব্লেজ়ার। অভিষেকের সময় আমি লন্ডনে হাজির ছিলাম। প্রেসিডেন্ট সৌরভের অভিষেক লগ্নেও থাকলাম। সেই একই রকম জেদ যেন দেখতে পেলাম— পরীক্ষায় হারা চলবে না।

অভিষেক টেস্টের ব্লেজ়ার নিয়ে বলল, ‘‘আমি মনে করি ক্রিকেটার হিসেবে আমার প্রাপ্তিই বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে আমাকে বসাচ্ছে। প্রথম টেস্টটা না থাকলে এত দূর কাহিনি গড়াতই না। ওই ইন্ডিয়া ব্লেজ়ার আমার কাছে সব কিছু। ওটা পরেই আমি প্রথম দিন বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসব।’’

ওয়াংখেড়েতে বোর্ডের সদর দফতরে ঢুকে পদাধিকারী থেকে শুরু করে কর্তা, কর্মী, সকলের সঙ্গে কথা বলে নিজের কাজটা বোঝা শুরু করে দিল। যেন এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। যে ভাবে ম্যাচের আগের দিন প্রস্তুত হত, ঠিক সে রকম। বোর্ডের অফিস থেকে বেরোল সন্ধে পেরিয়ে। নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্টের মন তত ক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে ক্রিকেটীয় অভিনবত্বের খোঁজে। ভারতে যে গোলাপি বলে দিনরাতের টেস্ট ম্যাচ করতে হবে, সেই রাতেই মনস্থির করে ফেলেছিল সৌরভ। তখনও বিরাট কোহালিরা দিনরাতের টেস্ট খেলা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। নতুন প্রেসিডেন্ট বলে দিল, ‘‘ঠিক বুঝিয়ে নেব। বিরাট কোহালির মতো চ্যাম্পিয়ন ফাঁকা মাঠে খেলবে, এটা হতে দেওয়া যায় না।’’

বাংলাদেশের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ চূড়ান্ত হল। তক্ষুনি প্রেসিডেন্ট নেমে পড়ল দিনরাতের প্রকল্প নিয়ে। সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে রাখল। এর পরে আর ওদের ক্রিকেটারেরাই বা আপত্তি তোলে কী করে? বিরাটকে আলাদা করে ডেকে বোঝাল, দেশের মাঠে টেস্ট ম্যাচে লোক আনাটা কেন জরুরি। আর তার জন্য গোলাপি বল, দিনরাতের টেস্টই সেরা দাওয়াই। এর পর ইডেনের সেই মহাযজ্ঞ।

প্রশাসক সৌরভ শুধু ক্রিকেটের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে দর্শকদের জন্য বিনোদন উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ওর বক্তব্য হচ্ছে, সম্পূর্ণ একটা প্যাকেজ দিতে হবে দর্শকদের। তবেই না লোক মাঠে আসবে। কে ভুলতে পারবে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানোর সেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার মুহূর্ত! দেশের প্রথম দিনরাতের টেস্টেও চাঁদের হাট বানিয়ে ফেলল। দুই বাংলার আবেগের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজির, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন। সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, বীরেন্দ্র সহবাগ, সানিয়া মির্জা, পিভি সিন্ধু— কে ছিল না তারা ঝলমলে ইডেনে!

অতিমারির হানায় আইপিএল যখন ঘোর অনিশ্চিত, তখনও দেখেছি সৌরভ ক্রমাগত নজর রেখে যাচ্ছে পরিস্থিতির উপরে। সকলকে বলছে, ‘‘আমরা প্রস্তুতিটা সেরে রাখি, হোক না হোক পরে দেখা যাবে।’’ পরীক্ষার জন্য সদা তৈরি থাকো— এটা বহু পুরনো সৌরভীয় মন্ত্র! অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকার বাউন্সি পিচে খেলতে যাওয়ার আগে যে কারণে সিএবি ইন্ডোরে বালতি ভর্তি ভেজা বল নিয়ে এসে ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকত।

আইপিএলের নানা রকম সূচি তৈরি করে রাখা হয়েছিল। যখন দেখা গেল, দেশের মাটিতে আইপিএল হওয়া কার্যত অসম্ভব, বিদেশে নিয়ে যেতেই হল। আইপিএল থেকে আসা অর্থে শুধু যে বোর্ডের কোষাগার ভরে বা বর্তমান ক্রিকেটারেরা টাকা পান, তা নয়। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের আর্থিক অনুদান, বেনেভোলেন্ট ফান্ড, রাজ্য সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যে পরিকাঠামো তৈরি, ক্রিকেটারদের অবসরোত্তর জীবন সুরক্ষিত করা— এ সবও করা হয়। সেই কারণে আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছিল, যদি বাতিল না করে বিদেশে টুর্নামেন্ট করা যায়।

তিন-চারটে দেশের কথা আলোচনা হচ্ছিল। নিউজ়িল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, শ্রীলঙ্কা। সেই সময়ে সৌরভকে দেখতাম, প্রত্যেকটা দিক খুঁটিয়ে দেখছে। নিউজ়িল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজে হলে সময়ের ব্যবধান বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। শ্রীলঙ্কায় নিভৃতবাস পর্ব কম কিন্তু সব কেন্দ্রে যথেষ্ট পরিমাণে ভাল হোটেল, চিকিৎসা কেন্দ্র আছে তো? আমিরশাহির কর্তাদের সঙ্গে ফোনে সারাক্ষণ আলোচনা করে যাওয়া। কী ভাবে জৈব সুরক্ষা বলয় তৈরি করা হবে? স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নিরাপত্তা কোন দেশে বেশি? সব দেখেশুনে আমিরশাহির দিকেই পাল্লা ঝুঁকল। বোর্ড প্রেসিডেন্ট কখনও উদ্বিগ্ন, কখনও আশ্বস্ত। সব কিছু নিজে খতিয়ে দেখে নিশ্চিত করতে চায়, কোথাও যেন ফাঁকফোকর না থাকে।

চেন্নাই সুপার কিংসে ১৩ জনের করোনা ধরার পরে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। টুর্নামেন্ট নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে। সূচি তৈরি করা যাচ্ছে না। বোর্ড প্রেসিডেন্টের বার্তা— দু’তিনটে দিন ধৈর্য ধরে দেখা যাক। থরহরিকম্প বাঁধিয়ে তো সুরাহা হবে না! দ্রুতই আতঙ্ক দূর হয়ে আইপিএল ঘোষিত দিনে শুরু হল। চেন্নাই সুপার কিংসও প্রথম ম্যাচে খেলল। মরুঝড় তুলে ৩৩ রজনী অতিক্রান্ত। এখনও বাকি ১৯ দিন।

সৌরভের মন্ত্র? টেস্ট ক্রিকেটের মতো এক-একটা দিন ধরে এগিয়ে যাও। প্রত্যেকটা দিন নতুন শুরু, নতুন পরীক্ষা। আত্মতুষ্টিতে ভোগার জায়গা নেই। শেষ পর্যন্ত সফল ভাবে আইপিএল শেষ করা গেলে দিনরাতের টেস্টের মতোই এক বছরের মধ্যেই আর একটা সফল অভিযান লেখা থাকল বোর্ড প্রেসিডেন্টের নামের পাশে।

শুধু আইপিএল নয়, প্রেসিডেন্টের মাথায় ঘুরছে ঘরোয়া ক্রিকেট কী ভাবে শুরু করা যায়। বরাবর টেস্ট ক্রিকেটের ঘরানাকে সর্বোচ্চ সম্মান করা সৌরভ ভাবছে রঞ্জি ট্রফিহীন মরসুম কী ভাবে সম্ভব? সেই সঙ্গে চিন্তাভাবনা চলছে সামনের বছরের টি-টোয়েন্টি ও মেয়েদের বিশ্বকাপ নিয়ে। আরও একটা টি-টোয়েন্টি এবং অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ আছে ২০২২-এ।অতিমারির মধ্যেই পরের লক্ষ্য স্থির হয়ে গিয়েছে— মিশন বিশ্বকাপ!

President of BCCI Sourav Ganguly BCCI IPL 2020
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy