কেকেআর ডাগ-আউটে না থাকলেও কাতর শোনাচ্ছে তাঁর গলা। মাত্র ১০৭ রানে অলআউট হয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে ছয় উইকেটে হেরে ফাইনালের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে নাইটদের। তিনি— ওয়াসিম আক্রম ম্যাচের স্কোরকার্ডের মতোই বিস্মিত নাইটদের প্রথম একাদশ নির্বাচন নিয়েও।
‘‘বুঝলাম না ইউসুফ পাঠান আর কুলদীপ যাদবকে কেন খেলাল না কেকেআর? ওরা কি পুরো ফিট ছিল না?’’ নাইটদের বিদায়ের পরের সকালে পাকিস্তান থেকে ফোনে আনন্দবাজারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে চান আক্রম। গলায় অপার বিস্ময়। তাঁকে বলা গেল, দু’জনকে বাদই দেওয়া হয়েছিল। ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্টই দু’জনকে বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
শুনে কেকেআরের প্রাক্তন বোলিং পরামর্শদাতার প্রশ্ন, ‘‘কিন্তু কেন? দু’জনেই নিজেদের প্রমাণ করেছে অনেক বার। কয়েকটা ম্যাচ ভাল যায়নি বলেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।’’ এ বারও টিমের সঙ্গে থাকলে যে ইউসুফদের খেলানোর পক্ষে সওয়াল করতেন, কথাবার্তায় পরিষ্কার। চিন্নাস্বামীর মন্থর পিচে চায়নাম্যান কুলদীপকে খেলাবে না কেকেআর, অনেকের মতো তিনিও ভাবতে পারেননি। মুম্বইয়ের কর্ণ শর্মাকে খেলতে পারেননি কেকেআর ব্যাটসম্যানরা। চার উইকেট নিয়ে লেগব্রেক-গুগলি বোলারই ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জেতেন। চায়নাম্যান কুলদীপ থাকলে তাঁকেও খেলা রোহিত শর্মাদের পক্ষে কঠিন হতো বলে মনে করেন আক্রম।
যদিও সব সময় যে কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্ট তাঁর কথা শুনেছে, এমন নয়। মহম্মদ শামিকে নিয়েই যেমন। কেকেআরে শামিকে খেলানোই হতো না। আক্রম বারবার বলেও টিম ম্যানেজমেন্টকে মানাতে পারেননি। উল্টে শামিকে তিনি যত্ন করে তৈরি করার পর তাঁকে নিলামে ছেড়েও দেয় কেকেআর। ভারতীয় দলের হয়ে চমকপ্রদ অভিষেক ঘটিয়ে ফেলা শামিকে তুলে নেয় দিল্লি। আক্রম তাতে খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। একা শামি নন, উমেশ যাদব থেকে শুরু করে বাংলার মিডিয়াম পেসার বীরপ্রতাপ সিংহ— অনেকেই তাঁর পেস-মন্ত্রে দীক্ষিত।
এখনকার কেকেআর টিমে তাঁর খুব প্রিয় দুই শিষ্য ইউসুফ পাঠান ও কুলদীপ যাদব। যাঁদের বেঙ্গালুরুতে বসিয়ে দেওয়া হল। আর এক প্রিয় ক্রিকেটার মণীশ পাণ্ডে চোটের জন্য খেলতে পারলেন না। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকেও ছিটকে গিয়েছেন। মণীশকে নিয়ে আক্রম বললেন, ‘‘দারুণ মানসিকতা ছেলেটার। খুব ভাল ক্রিকেটার। আশা করব, চোট সারিয়ে দ্রুত ফিরে আসবে।’’
ইউসুফ এ বারে ১৫ ম্যাচে মাত্র ১৪৩ করেছেন। একটিই ম্যাচ জেতাতে পেরেছেন। গড় ১৭.৮৭। তবুও তাঁর পাশেই দাঁড়াচ্ছেন আক্রম। বললেন, ‘‘ইউসুফ ম্যাচউইনার। যখনই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, ওকে একটাই কথা বলতাম— নিজের দক্ষতার ওপর ভরসা রাখো। ইউসুফ সেটা করে গিয়েছে। বারবার খারাপ সময় কাটিয়ে ফিরে এসেছে। বড় ম্যাচ বের করার বিশেষ ক্ষমতা আছে ওর।’’
এ বছরের সবচেয়ে বড় বিস্ময় ব্যাটসম্যান সুনীল নারাইনের ওপেনার হিসেবে বিক্রম দেখে অবশ্য একেবারেই অবাক নন আক্রম। বলে দিলেন, ‘‘নারাইনের মনের জোর সাংঘাতিক। আর ওর ব্যাটিং প্রতিভার কথা বরাবরই আমি জানতাম। নেটে যখনই ঢুকত, খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে ব্যাট করতে দেখতাম। তাই একেবারেই অবাক হইনি। নারাইন দারুণ উন্নতি করেছে ব্যাটিংয়ে।’’ সন্দেহজনক বোলিং অ্যাকশন নিয়ে নারাইন যখন বিভ্রান্ত তখন তাঁর সঙ্গে মেন্টর হিসেবে ছিলেন আক্রম। বিস্ময় স্পিনারকে নিয়ে তিনিই গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর অ্যাকাডেমিতে পরীক্ষা দিতে।
সেই প্রসঙ্গ টেনে আক্রমের ব্যাখ্যা, ‘‘কেরিয়ারের ও রকম একটা কঠিন সময়ে যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলেছিল নারাইন, তা থেকেই বুঝেছিলাম ও কতটা আত্মবিশ্বাসী ক্রিকেটার। বিনা লড়াইয়ে কিছু ছাড়বে না ও।’’ পাকিস্তান সুপার লিগে নারাইন লাহৌরের দলের হয়ে খেলছেন দু’বছর ধরে। আক্রম আবার ইসলামাবাদ দলের মেন্টর। পাকিস্তান লিগেও ক্যারিবিয়ান স্পিনারের কামাল দেখছেন তিনি। জানালেন, পিএসএলেও নারাইনের ব্যাটিং প্রতিভার কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
সামনের বছর কি তাঁকে আবার দেখা যেতে পারে নাইট রাইডার্স শিবিরে? আক্রম এক্ষুনি জানেন না আইপিএলে তিনি ফিরবেন কি না। আপাতত পাকিস্তানে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন টিভি তারকা হিসেবে। তিনি এবং শোয়েব আখতার শুরু করেছেন একটি বিশেষ শো। দুই বিখ্যাত ফিল্মি চরিত্রের সাজে দেখা যাবে পেস বোলিং জুটিকে। ‘‘শো নিয়ে আগ্রহ খুব ভাল। রমজান মাসে চলবে,’’ বলছিলেন আক্রম। এই শো করার জন্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির কমেন্ট্রি বক্স থেকেও ছুটি নিয়েছেন তিনি।
সামনের বার আইপিএলে ফিরুন বা না-ফিরুন, কলকাতা নিয়ে বলতে গিয়ে ফোনের ও প্রান্তে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘‘কলকাতার ভক্তদের বলতে চাই, বরাবর আপনাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালবাসা পেয়েছি। কলকাতায় যেখানে যখন গিয়েছি, সকলের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়েছি।’’ যোগ করলেন, ‘‘আমি কেকেআরের টিম মিটিংয়ে বারবার বলতাম, কলকাতার মতো সমর্থন কোথাও পাওয়া যাবে না। মানুষের সেই সমর্থনের উপহার দিতে হবে আমাদের। চলো ট্রফিটা জিতি আর উৎসর্গ করি কলকাতার মানুষদের।’’
কলকাতাকে উপহার দেওয়ার আশা জাগিয়েও পারলেন না গম্ভীর-রা। কেকেআর বোলিং কোচ মনে হল আইপিএলে না থেকেও নাইটদের ডাগ-আউটে বসে স্বপ্নভঙ্গের সেই মুহূর্ত দেখছেন। যখন বলে উঠলেন, ‘‘কলকাতার মানুষদের জন্য খারাপ লাগছে। ট্রফিটা ওঁরা পেলেন না!’’