Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘হুদহুদ’ আছড়ে পড়ল ভারতীয় ফুটবলেও

বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিনেমার মেরি কম প্রিয়ঙ্কা চোপড়া গ্যালারিকে প্রশ্ন করলেন, “কলকাতা কি ফুটবলকে ভালবাসে?” যুবভারতীর হাজার পঁয়ষট্টি দর্শক কী উত্তর দেন, তা শোনার জন্য দু’সেকেন্ডও অপেক্ষা করলেন না বলিউডের অন্যতম গ্ল্যামার কুইন। নিজেই বলে দিলেন, “কলকাতার লোক ফুটবল খায়। পান করে। স্বপ্ন দেখে। আইএসএলের গালা উদ্বোধন এখানে ছাড়া আর অন্য কোথায় হতে পারত!” পেলের খেলা দেখেছে কলকাতা। মেসি খেলে গিয়েছেন। অলিভার কানের অবসরের ম্যাচ হয়েছে এই শহরেই।

মহাধামাকার রংমশালে রঙিন। রবিবাসরীয় যুবভারতী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

মহাধামাকার রংমশালে রঙিন। রবিবাসরীয় যুবভারতী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিনেমার মেরি কম প্রিয়ঙ্কা চোপড়া গ্যালারিকে প্রশ্ন করলেন, “কলকাতা কি ফুটবলকে ভালবাসে?”

যুবভারতীর হাজার পঁয়ষট্টি দর্শক কী উত্তর দেন, তা শোনার জন্য দু’সেকেন্ডও অপেক্ষা করলেন না বলিউডের অন্যতম গ্ল্যামার কুইন। নিজেই বলে দিলেন, “কলকাতার লোক ফুটবল খায়। পান করে। স্বপ্ন দেখে। আইএসএলের গালা উদ্বোধন এখানে ছাড়া আর অন্য কোথায় হতে পারত!”

পেলের খেলা দেখেছে কলকাতা। মেসি খেলে গিয়েছেন। অলিভার কানের অবসরের ম্যাচ হয়েছে এই শহরেই। দেখেছে দিয়েগো মারাদোনা, ববি মুর, লোথার ম্যাথাউস, গার্ড মুলার, ফোরলানদের মতো মহাতারকাদের।

কিন্তু আটলেটিকো দে কলকাতা-র গোলের পর গ্যালারিতে এ রকম মেক্সিকান ওয়েভ দেখেছে কি? দেখেছে কি মুখে সাদা-লাল রং লাগিয়ে আট থেকে আশিকে এ ভাবে রঙিন হয়ে মাঠে আসতে? সুন্দরী সঙ্গী নিয়ে, সম্ভ্রান্ত পরিবার একসঙ্গে উত্‌সব উদযাপনের সাক্ষী হতে?

আর এ রকম উদ্বোধনের উপাচার!

রং, আলো। বারুদ থেকে চলকে ওঠা আতসবাজির রোশনাই। অভাবনীয় তারকা সমাবেশ। নিখুঁত উপস্থাপনা যুবভারতীতে গত বছরের ক্রিকেট আইপিএলের উদ্বোধনকে ছাপিয়ে গেল কি না তা নিয়েও তর্ক ধাক্কা খেয়ে ফিরছিল স্টেডিয়ামের আনাচে-কানাচে। ভারতীয় ফুটবলকে বহু দশক খুব কাছ থেকে চাক্ষুষ করা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্ফারিত চোখে দেখছিলেন অনুষ্ঠান। “আইপিএল তো বটেই, ক্রিকেট বিশ্বকাপকেও হার মানিয়ে দিল মনে হচ্ছে। অসাধারণ। এত সেলিব্রিটি। এ বার ফুটবলের কিছু হবেই এ দেশে।”

গ্যালারির উপরে লাগানো স্ক্রিনে মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেখানো হল ’৫১ থেকে ’৬২-র ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ। এদেশের ফুটবলের জীবন্ত দুই কিংবদন্তির এক জন চুনী গোস্বামী আমন্ত্রণপত্র না পাওয়ায় মাঠে আসেননি। আর পিকে জানাচ্ছেন, ভিভিআইপি বক্সে বসেও দেখতে পাননি স্বর্ণযুগের ক্লিপিংস। গ্যালারির বেশিরভাগ দর্শকেরও একই অবস্থা।

আইএসএলের হাত ধরে এ দেশের ফুটবলে স্বর্ণযুগ ফিরবে কি না সেটা সময়ই বলবে। তবে ফিফা বিশ্বকাপের আদলে সাইড লাইনে ইলেকট্রনিক বিলবোর্ড থেকে স্কোরবোর্ড, ফুটবলের আদলে টানেল তৈরি করে আন্তর্জাতিক আবহে ভেসে যাওয়া যুবভারতীতে রবিবার যা হল, তা অবশ্য বাংলার কোনও খেলায় কখনও হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জাপান সফরে আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ব্যস্ততার জন্য যেতে পারেননি বিশ্বের অন্যতম ধনী শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী। কিন্তু এ দিন তিনি-ই ফুটবলের জন্য স্টেডিয়ামের চেয়ারে বসে রইলেন টানা পাঁচ ঘণ্টা। হাততালি দিলেন। গোল দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন। তাঁর পাশেই বসে ছিলেন ‘বিগ বি’। অমিতাভ বচ্চন জন্মদিনের পরের সকালেই কলকাতায় হাজির হওয়া শুধু ফুটবল দেখতে। হাজির টুর্নামেন্টের চেয়ারপার্সন নীতা অম্বানীর শাশুড়ি কোকিলাবেন। এঁদের মাঝখানে বসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি ভিআইপি বক্সে নিজের চেয়ারে দু’মিনিট বসে মিনিট খানেকের মধ্যে প্রোটোকল ভেঙে চলে গিয়েছিলেন অম্বানী-অমিতাভদের সঙ্গ দিতে। সেখানে ফুটবলের প্রতিনিধি শুধু ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল।

টিম মালিক হিসাবে সচিন তেন্ডুলকর, অভিষেক বচ্চন, রণবীর কপূর, হৃতিক রোশন, জন আব্রাহাম একই মঞ্চে। সঙ্গে সবারই নিজের ফ্র্যাঞ্চাইজির আইকন ফুটবলার দেল পিয়েরো, রবার্ট পিরেস, লুই গার্সিয়া, ত্রেজেগুয়েরা। ঘোষিকা প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার ডাকে দলের ফুটবলার নিয়ে মঞ্চে ওঠার সময় কেউ ছোট্ট স্প্রিন্ট টানলেন। কেউ নাচতে নাচতে এগোলেন। কেউ সেলিব্রিটি ঘোষিকাকেই কোলে তুলে আদর করছেন। তাদের একে একে পাঠাচ্ছিলেন মুকেশ জায়া নীতা। উত্‌সবের এ রকম রঙিন রোশনাই কলকাতা কখনও দেখেনি। স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বিগ বি-কে মাঠের ভিতর না আনার জন্য আফসোস থাকতেই পারে। কিন্তু আট রাজ্যের আট সুরের মূর্চ্ছনা, একসঙ্গে ১৬০ বাদকের যন্ত্রের অনুরণন এই সামান্য হতাশাও যেন ভুলিয়ে দিয়েছে আজ। বাজনার সঙ্গে নৃত্যরত ছেলে-মেয়েদের ক্রমাগত জামা বদলে যাওয়া, বিভিন্ন রাজ্যের নাচও তো বিশ্বের অন্যতম বড় স্টেডিয়াম এই প্রথম দেখল!

সময়ের সঙ্গে তাল রাখতে শেষ মুহূর্তে কিছু পরিবর্তন হয়েছিল সূচিতে। ফুটবল আইকন ভাইচুং ভুটিয়াকে দেখা যায়নি কোথাও। তাঁর তো মুখ্যমন্ত্রীকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি ব্যস্ত থাকলেন ধারাভাষ্য দিতে। সেই খামতি অবশ্য পুষিয়ে দিয়েছে প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার চারটি সিনেমার চারটি গানের সঙ্গে পারফরম্যান্স। শেষটি তো মেরি কম ছবির সেই গানসালাম ইন্ডিয়া। গাইলেন সেই সেলিম মার্চেন্ট-ই।

‘লেটস ফুটবল’ স্লোগান নিয়ে এ দেশের ফুটবল চালচিত্র বদলে দেওয়ার জয়যাত্রাকে আরও নিখুঁত করেছে উদ্বোধনী ম্যাচের প্রথম দু’টো আন্তর্জাতিক মানের গোল। যা আবার কিনা ঘরের মাঠে আটলেটিকো দে কলকাতার ছেলেদের পা থেকে এল।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আটলেটিকোর ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকার ফিকরু এবং স্প্যানিশ ডিফেন্সিভ মিডিও বোরহা ফার্নান্দেজের গোল চোখ ধাঁধিয়ে দিল। যেন বিশ্বের কোনও বড় লিগের গোল! বিদেশিদের সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন করা ভারতীয়রাও অসাধারণ খেললেন। কলকাতার কিপার শুভাশিস রায় চৌধুরী দু’টো দুর্ধর্ষ সেভ করলেন তাঁর দলের ৩-০ জয়ের ম্যাচেও।

দেল পিয়েরো, লুই গার্সিয়া, ডেভিড জেমস, মাতেরাজ্জিদের মতো বিগত যৌবনা ফুটবলারদের আনায় আইএসএল দর্শকদের কতটা মাঠে টানবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু প্রথম দিনের পর মনে হচ্ছে, এ রকম গোল হলে বা গোল বাঁচানো দেখলে টুর্নামেন্টটা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হবে। হয়তো জমেও যাবে। আর কলকাতা পরপর জিতলে তো কথাই নেই। আর সেটা হলে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের সমর্থকদের আবেগেও কিন্তু ভাঁটা পড়বে। আরও অন্ধকার দেখাবে দু’টো টিমকেই। শুধু ঐতিহ্য ভেঙে বাঁচার দিন আর নেই সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ঝকঝকে যুবভারতীর পরিবেশ। বিপণনের ধামাকা। স্পনসরদের ঢেউ।

উদ্বোধনী ম্যাচের প্রতিটি গোলের পর আইপিএলের আদলে বেজে উঠছিল টুর্নামেন্টের থিম সং। চিয়ার গার্লের অভাব পূরণ করতে চারদিক থেকে আকাশে উঠছিল আতসবাজির রোশনাই। সঙ্গে চিত্‌কার, ‘চক দে কলকাতা’, ‘চক দে আটলেটিকো’। এ রকম ‘চক দে...’ যদি বেজে ওঠে চেন্নাই, কোচি, দিল্লি, গুয়াহাটিতেও, তা হলে আইএসএল কিন্তু জমে উঠবে।

অনেকেই আশঙ্কায় ছিলেন, হুদহুদ-হানায় ভেস্তে না যায় এ রকম একটা মেগা ইভেন্ট। শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় এল যুবভারতীতে। তবে সেটা ভারতীয় ফুটবলে! অন্য হুদহুদের ধাক্কায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE