Advertisement
E-Paper

বাবাকে লুকিয়ে স্বপ্নপূরণ জবির

কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে ষণ্মুখম বিচের কাছেই মৎসজীবীদের পাড়ায় বাড়ি জবির। লাল-হলুদ স্ট্রাইকারের বাবাও পেশায় মৎস্যজীবী। তিনি চাকরি সূত্রে থাকতেন পশ্চিম এশিয়ায়। বছরে এক বার ছুটিতে বাড়িতে ফিরলেও নৌকা নিয়ে চলে যেতেন আরব সাগরে মাছ ধরতে।

শুভজিৎ মজুমদার

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৪১
স্নেহ: অনুশীলনে ছুটি। রবিবার সকালে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে রঙিন মাছের জার হাতে জবি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

স্নেহ: অনুশীলনে ছুটি। রবিবার সকালে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে রঙিন মাছের জার হাতে জবি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

জবির জগতে স্বাগত!

সল্টলেকে করুণাময়ী আবাসনের চার তলার ফ্ল্যাটে ঢুকলেই চোখে পড়বে পর পর সাজানো রয়েছে ফুটবল বুট। দেওয়ালে লাল-হলুদ স্কার্ফ ঝুলছে। দাঁড় করিয়ে রাখা প্রিয় সাইকেল। খাটের পাশে ড্রেসিং টেবলে কাচের জারে রঙিন মাছ (ফাইটার)। অথচ জবির খেলার কোনও ছবি নেই!

জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়া প্রতিশ্রুতিমান স্ট্রাইকার এখনও যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন!

কেরলের রাজধানী তিরুঅনন্তপুরমে ষণ্মুখম বিচের কাছেই মৎসজীবীদের পাড়ায় বাড়ি জবির। লাল-হলুদ স্ট্রাইকারের বাবাও পেশায় মৎস্যজীবী। তিনি চাকরি সূত্রে থাকতেন পশ্চিম এশিয়ায়। বছরে এক বার ছুটিতে বাড়িতে ফিরলেও নৌকা নিয়ে চলে যেতেন আরব সাগরে মাছ ধরতে। বাবা বাড়ি ফিরলেই মন খারাপ হয়ে যেত জবির। বাবার ফিরে আসা মানেই তো ফুটবল বন্ধ। তিনি চাইতেন, তিন ছেলেই লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হোক। বড় ও ছোট ছেলে মন দিয়ে লেখাপড়া করত। কিন্তু মেজো ছেলে জবির চোখে শুধুই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। পাশে পেয়েছিলেন শুধু মাকে। কারণ, দাদা আর ছোট ভাইও চাইত না যে, জবি ফুটবল খেলুন।

ডার্বির সাত দিন আগে, রবিবার সকালে নিজের ফ্ল্যাটে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে বসে জবি বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন শৈশবে। শোনালেন তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠার আশ্চর্য কাহিনি। বললেন, ‘‘আমাদের বাড়ির কাছেই বিনু জোস, জেরি থমাস-সহ অনেকে ফুটবলার থাকতেন। ওঁদের দেখেই ফুটবলের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ে। ঠিক করলাম, আমাকেও ফুটবলার হতে হবে। তখন আমার আট বছর বয়স। শুনলাম, তিরুঅনন্তপুরমে স্টেট ব্যাঙ্কের অ্যাকাডেমি রয়েছে। এক দিন একাই চলে গেলাম ভর্তি হতে। ভাগ্যিস, বাবা সেই সময় বিদেশে ছিলেন।’’ জবি যোগ করলেন, ‘‘আমার দুই ভাইও বাবার মতো মনে করত, ফুটবল খেললে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই আমার ফুটবল খেলা ওরা একদম পছন্দ করত না। বারবার মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বলত।’’

বাবা ও দুই ভাইয়ের আপত্তি সত্ত্বেও জবি লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। কারণ, মা সব সময়েই তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়। কোনও দিন স্বামীকে বলেননি যে, মেজো ছেলে স্টেট ব্যাঙ্কের অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়েছেন। হাসতে হাসতে জবি বলছিলেন, ‘‘বাবা জানতেন, আমি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গেই শুধু খেলি। আমি স্টেট ব্যাঙ্কের জুনিয়র দলে সুযোগ পেয়েছি, স্কুলের হয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলেছি, কোনও খবরই বাবার কানে পৌঁছতে দেননি মা।’’

সমস্যা হল খেলার সরঞ্জাম কেনার সময়। বুট, জার্সি কেনার টাকা কী ভাবে জোগাড় হবে? বাবা তো টাকা দেবেনই না, উল্টে খেলাই বন্ধ করে দেবেন। তা হলে? জবি বললেন, ‘‘কেরলে সেভেন-আ-সাইড প্রতিযোগিতা খুব জনপ্রিয়। অনেক বড় বড় ফুটবলারই টাকার বিনিময়ে খেলে। আমিও বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে শুরু করলাম। মাসে পাঁচ-সাত হাজারের মতো টাকা পেতাম। পুরোটাই মায়ের হাতে তুলে দিতাম। মা সব চেয়ে খুশি হতেন সেরা ফুটবলারের ট্রফি নিয়ে বাড়ি ফিরলে।’’

ট্রফি দেখে বাবার কী প্রতিক্রিয়া হত? লাল-হলুদ স্ট্রাইকার বললেন, ‘‘বাবা ধরে ফেলেছিলেন যে, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ফুটবল খেলছি। তখন মাকে বলতেন, ফুটবল না-খেলে জবিকে লেখাপড়ায় মন দিতে বলো। মা অবশ্য আমাকে কোনও দিনই খেলা বন্ধ করতে বলেননি। বরং উৎসাহ দিতেন ভাল খেলার জন্য।’’

জবির জীবন বদলাতে শুরু করল টাইটেনিয়ামে সই করার পর থেকে। সতীর্থ উবেইদ কাদাবত ও মির্শাদ কোটাপুন্নার পাশে বসে তিনি বললেন, ‘‘ক্লাস টুয়েলভে পড়ার সময় টাইটেনিয়াম আমার সঙ্গে চুক্তি করে। সেখানে খেলতে খেলতেই কেরল বিশ্ববিদ্যালয় দলে সুযোগ পাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে আমরা রানার্স হয়েছিলাম। এই সময় কেরল রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ চুক্তিতে ফুটবলার নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। আমি আবেদন করি। ট্রায়ালে নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছরের চুক্তিতে সই করি।’’

বাবা, ভাইয়েদের লুকিয়ে ফুটবল শেখা। অর্থের জন্য বিভিন্ন জায়গায় খেপ খেলতে খেলতে কেরল রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের চাকরি। জবির জীবনকাহিনির প্রতিটি বাঁকেই চমক। যে লাল-হলুদ স্ট্রাইকার আই লিগে সাত গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন, তিনি শুরুতে ছিলেন ডিফেন্ডার! তার পরে খেলতেন মাঝমাঠে। কেন? লিয়োনেল মেসি ও আই এম বিজয়নের ভক্ত জবি বলছেন, ‘‘স্টেট ব্যাঙ্কের জুনিয়র দলের কোচ আমাকে উইং ব্যাক পজিশনে খেলাতেন। টাইটেনিয়ামের কোচ বললেন মাঝমাঠে খেলতে হবে।’’ তা হলে স্ট্রাইকার কবে হলেন? জবি বললেন, ‘‘কেরল বিদ্যুৎ পর্ষদে যাওয়ার পরে আমি স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে শুরু করি। সেখান থেকেই ইস্টবেঙ্গলে খেলার ডাক পাই।’’

গুরু বিজয়নের পরামর্শে গত মরসুমে ইস্টবেঙ্গলে সই করেন জবি। কিন্তু সে-ভাবে সুযোগ পাননি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, এই মরসুমেও যদি খেলার সুযোগ না-পান, তা হলে ফিরে যাবেন তিরুঅনন্তপুরমে। অফিস দলের হয়ে কেরল প্রিমিয়ার লিগেই শুধু খেলবেন। কিন্তু নাটকীয় ভাবে ছবিটা বদলে গিয়েছে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে আই লিগের প্রথম ডার্বিতে। অ্যাক্রোবেটিক ভলিতে বিস্ময় গোল করে জবি এখন লাল-হলুদ সমর্থকদের নয়নের মণি। যদিও জবির জীবন একই রকম রয়ে গিয়েছে। গাড়ি নেই। সাইকেল চালিয়ে যুবভারতীতে অনুশীলন করতে যান।

অনেকে বলছেন, মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ফিরতি লড়াই কঠিন হতে চলেছে ইস্টবেঙ্গলের কাছে। প্রতিপক্ষ শিবিরে ফিরছেন সনি নর্দে। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই জবির হুঙ্কার, ‘‘তাতে কী হয়েছে। ওদের সনি থাকলে আমাদের দলেও এনরিকে থাকবে।’’

ডার্বি-দামামা বাজিয়ে দিলেন জবি।

Football I League 2018-19 East Bengal Jobby Justin
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy