Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ন’ঘণ্টা ব্যাটিংয়ের নেপথ্যে রোজ ছয় কিলোমিটার দৌড়

স্মৃতির পুরনো নথি, সাল-তারিখ বহু দিন পরেও হুবহু মনে রেখে দেওয়ার অভ্যেসটা শিবানন্দের পুরনো। ঠিক কবে আট বছরের ‘উন্নি’ বাবার স্কুটি থেকে কোরামঙ্গলা ক্রিকেট অ্যাকাডেমির গেট থেকে নেমেছিল, আজও বলে দিতে পারেন। ২৮ মার্চ, ২০০১। ‘উন্নি’-কে নেটে প্রথম ব্যাটিংয়ের পারমিশনের দিনটাও মনে আছে, বলে দিতে পারেন দ্রুত।

ছবি:পিটিআই

ছবি:পিটিআই

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৯
Share: Save:

স্মৃতির পুরনো নথি, সাল-তারিখ বহু দিন পরেও হুবহু মনে রেখে দেওয়ার অভ্যেসটা শিবানন্দের পুরনো। ঠিক কবে আট বছরের ‘উন্নি’ বাবার স্কুটি থেকে কোরামঙ্গলা ক্রিকেট অ্যাকাডেমির গেট থেকে নেমেছিল, আজও বলে দিতে পারেন। ২৮ মার্চ, ২০০১। ‘উন্নি’-কে নেটে প্রথম ব্যাটিংয়ের পারমিশনের দিনটাও মনে আছে, বলে দিতে পারেন দ্রুত। ৬ জানুয়ারি, ২০০২। বেছে-বেছে কপিল দেবের জন্মদিন ছিল যে, এর পর ভোলা যায়?

শিবানন্দ আরও একটা ছবি দেখতে পান। স্যর গ্যারি সোবার্স, ববি সিম্পসনদের গ্রহে আদরের ‘উন্নি’-র ঢুকে পড়ার দিনে পুরনো ছবিটা স্মৃতির দেরাজ হাট করে খুলে বেরিয়ে আসে। সময়-টময় সমেত।

কোরামঙ্গলা ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্র্যাকটিস সে দিন ছিল ভোর ছ’টা কুড়ি থেকে। গুরুর সেই কঠোর সময়সীমা পার করে ফেলেছিল ‘উন্নি’, বাবার স্কুটার থেকে নামতে-নামতে ছ’টা চল্লিশ বেজে গিয়েছিল। রেগে গিয়ে অ্যাকাডেমির কোচ শিবানন্দ নির্দেশ দিয়েছিলেন, সামনের রাস্তায় আগে দৌড়োও, পরে ব্যাট-বলে হাত দেবে! কথা বাড়ায়নি ‘উন্নি’, নির্দেশ পালনে চলে গিয়েছিল, গুরুরও আর খেয়াল ছিল না। ঘণ্টা তিনেক পরে প্র্যাকটিস চুকেবুকে যাওয়ার পর আর এক ছাত্র মনে করিয়ে দেওয়ায় খেয়াল হয়। এবং ছাত্রকে খুঁজতে রাস্তায় গিয়ে দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধবাক হয়ে যান কোচ।

ছেলেটা তখনও দৌড়োচ্ছে!

‘‘লোকে আজ ওর সাড়ে পাঁচশো মিনিট ব্যাট করার কথা বলছে। কিন্তু উন্নির ধৈর্যের ভিতটা সে দিনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল,’’ বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে বলছিলেন শিবানন্দ। ‘উন্নি’র কোচ।

এবং ‘উন্নি’ কে, নতুন করে বলার প্রয়োজনও নেই সম্ভবত।

নায়ার, করুণ নায়ার!

জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি যাঁর ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়ে থাকল। যে কীর্তি তাঁর আগে আছে শুধু দু’জনের। গ্যারি সোবার্স এবং ববি সিম্পসন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম। এবং করুণ নায়ারের মাঠের পৃথিবীটাকে যদি রোমাঞ্চকর লাগে, নাটকীয় মনে হয়, নেপথ্যটাও তাই।

‘‘ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে দিন, কেন এখনও দৌড়োচ্ছিস। উত্তরটা আজও ভুলিনি। বলল, আপনি থামতে বলেননি তো,’’ বলে চলেন শিবানন্দ। শোনা গেল, একদিনের সেই শাস্তি তার পর থেকে দৈনন্দিন রুটিন হয়ে গিয়েছিল করুণের। ক্রিকেট ব্যাট ছোঁয়ার আগে দৌড়। শাস্তি নয়, ধৈর্য বাড়ানোর জন্য। শাসন নয়, স্ট্যামিনা বাড়ানোর জন্য।

এক-আধ কিলোমিটার নয়। রোজ কম করে ছ’কিলোমিটার!

‘‘আজ পর্যন্ত আমার সামনে অন্তত কয়েক হাজার কিলোমিটার ও দৌড়েছে,’’ বলতে থাকেন করুণের প্রথম কোচ। যাঁকে শুধুমাত্র ‘প্রথম কোচ’ করে রেখে দেননি করুণ। ভারতীয় জার্সির প্রচারের ঝাড়বাতির তলায় দাঁড়িয়েও ভোলেননি। নিয়মিত কথা হয়। এখনও প্রথম ক্রিকেট-গুরুর কাছে পথনির্দেশ চান। রবিবার রাতেও কথা হয়েছে ফোনে। কথোপকথন এ রকম:

‘‘স্যর, কী বুঝছেন?’’

‘‘বড় মারবি।’’

‘‘কী বলছেন?’’

‘‘বলছি শোন। তোর খেলা আজ থেকে দেখছি না। বড় রান আসছে।’’

‘‘তাই বলে তিনশো হবে, জানতাম না,’’ কথাপোকথন তুলে ধরে হাসেন শিবানন্দ। অবশ্য জীবনের প্রথম ডিভিশন ম্যাচেই যাঁর স্কোর ১৬৪, তাঁর পক্ষে তিনশো করা অসম্ভব কিছু নয়। নতুনও নয়। রঞ্জি ফাইনালেই একটা আছে। প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থার মহাকর্তা ব্রিজেশ পটেল ফোনে বলছিলেন, ‘‘কর্নাটক এমন ব্যাটসম্যান এই প্রথম দিল না। কেএল আছে। মণীশ পাণ্ডে আছে। এর পিছনে আমাদের জুনিয়র ক্রিকেট প্রোগ্রাম। যেখানে শেখানো হয়, হাফসেঞ্চুরিকে কী করে সেঞ্চুরিতে পাল্টাতে হবে। সেঞ্চুরিকে, ডাবল সেঞ্চুরিতে।’’

কিন্তু শুধু শিখলে হয় না, প্রয়োগ ক্ষমতাও লাগে। শোনা গেল, নায়ারের ক্রিকেটজীবন নাকি অনেকটাই পাল্টে দিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। ভারতীয় ‘এ’ টিমে তো বটেই, আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালস এবং দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, দু’জায়গাতেই রাহুলের টিপস পেয়েছেন করুণ। কোন পরিস্থিতিতে কী ভাবে ব্যাট করতে হবে, মানসিকতা কী হবে, মাথা ঠান্ডা রাখবে কী ভাবে— এ সব নাকি দ্রাবিড়ের গুরুকুলে শিখেছেন করুণ। শিবানন্দ বলেও দিলেন, ‘‘দ্রাবিড়ের প্রভাব ওর জীবনে বিশাল। দেখেছি তো কতটা পাল্টে দিয়েছে।’’

শুধু একটা জিনিস পাল্টায়নি। শেখার ইচ্ছে। নিজেকে আরও অদম্য করে তোলার লক্ষ্যে অনন্ত রগড়ানি। ক্রিকেটের বই-টই নাকি পড়েন না, কিন্তু শোনা গেল, ক্রিকেটের বাইরের সময়টুকু প্লে-স্টেশন খেলুন বা যা-ই করুন, আসল ফোকাসটা ঠিক রেখে দেন।

ঠিকই আছে। করুণ নায়ারকে কেউ থামতে বলেনি তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Karun Nair
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE