Advertisement
E-Paper

ভুলের পুনরাবৃত্তি হল, হারেরও

বিস্ফারিত চোখ দু’টো অবাক দৃষ্টিতে মাঠে বিদ্ধ, দাঁতের অত্যাচারে হাতের নখ প্রায় উঠে যাওয়ার অবস্থা। কেকেআর অধিনায়ককে কেমন বিহ্বল, নিথর প্রস্তর মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ম্যাচ শেষ হয়েছে মিনিট পাঁচেক। শিষ্টাচার মেনে এর পর উঠে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০৩:২৩

দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ১৮৬-৮ (২০ ওভারে)
কলকাতা নাইটরাইডার্স ১৫৯ (১৮.৩ ওভার)

বিস্ফারিত চোখ দু’টো অবাক দৃষ্টিতে মাঠে বিদ্ধ, দাঁতের অত্যাচারে হাতের নখ প্রায় উঠে যাওয়ার অবস্থা। কেকেআর অধিনায়ককে কেমন বিহ্বল, নিথর প্রস্তর মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। ম্যাচ শেষ হয়েছে মিনিট পাঁচেক। শিষ্টাচার মেনে এর পর উঠে প্রতিপক্ষ যোদ্ধাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়। কিন্তু কেকেআর ক্যাপ্টেনের অবসন্ন শরীর উঠতে চাইলে তো। সতীর্থদের ডাকাডাকিতে শেষ পর্যন্ত উঠলেন বটে, হাত-টাতও মেলালেন, কিন্তু আনুষাঙ্গিক মিটিয়ে কোটলা-দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতে পনেরো মিনিটও লাগল না।

কেকেআর ক্যাপ্টেন থেকে করতেনও বা কী? কী লাভ থেকে? দিল্লি ক্রিকেটে তাঁকে নিয়ে একটা প্রচলিত মতবাদ আছে যে, বাকি সব ঠিক আছে। কিন্তু কোটলায় আইপিএল যুদ্ধে হার গৌতম গম্ভীর কোনও দিন নিতে পারেন না। অহংয়ে নাকি লাগে মারাত্মক। লাগবেই। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের যেমন ইডেন ছিল, গম্ভীরের তেমন কোটলা। এই মাঠের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গাঁটছড়া জন্মলগ্ন থেকে, এই মাঠ তাঁর ক্রিকেটজীবনের ধাত্রীভূমি। বছরে দশ মাস এ মাঠে এখনও মুকুটহীন সম্রাট তিনি, এ মাঠে কলকাতার টিম নিয়ে আসা মানে একসঙ্গে দু’টো যুদ্ধ তাঁকে বরাবর লড়তে হয়। একটা ক্রিকেটের, একটা সম্মানের।

সেই কোটলা, কেকেআর ক্যাপ্টেনের অতি পরিচিত কোটলা তাঁকে কি না আজ এত বড় অপমান দিয়ে গেল? এতটা ঠকিয়ে গেল?

দিল্লি রঞ্জি টিমের ক্যাপ্টেন তিনি। অথচ গৌতম গম্ভীর কি না শনিবার কোটলা পিচ বুঝতেই পারলেন না! ব্যাটিং-সর্বস্ব পিচে তিন-তিন জন স্পিনার নামিয়ে দিল কেকেআর। মর্নি মর্কেলকে বসিয়ে রেখে কি না নামিয়ে দেওয়া হল প্রায় দু’মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিজার্ভ বেঞ্চে কাটিয়ে দেওয়া জেসন হোল্ডারকে। মুম্বই হার থেকে শিক্ষালাভ দূরে থাক, কোটলা প্রেসবক্সকে বিস্ময়ে নির্বাক করে তিন নম্বরে পাঠিয়ে দেওয়া হল পীযূষ চাওলাকে!

গৌতম গম্ভীর এ সবের পর কোটলায় আর পড়ে থাকবেন কেন, ম্যাচ জিতবেনও কী ভাবে?

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, দিল্লি ডেযারডেভিলসের কাছে এই হারে টিমের প্লে অফ ভবিষ্যতে পূর্ণগ্রাস গ্রহণ লেগে গেল, এমন নয়। সাত ম্যাচে জয় চারটেয়, লিগ টেবলে দুই থেকে নেমে আপাতত তিন। পরিসংখ্যান হিসেবে খারাপ নয়। বিশেষ করে ঘরের মাঠে মে মাস থেকে যখন পরপর ম্যাচ আছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, এমন ভুল প্রতিনিয়ত চললে, এমন দুমদাম হার ঘটতে থাকলে পরবর্তীকালে নির্ঘুম রাত যে আসবে না, তার গ্যারান্টি নেই। কে বলতে পারে, ডেয়ারডেভিলস ম্যাচে হারকেই কাঠগড়ায় তোলা হবে না তখন?

সবচেয়ে ভয়ের, ভুলের রোগ কিছুতেই যাচ্ছে না। কোনও ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুরেফিরে রোজ আসছে এবং টিমকে শয্যাশায়ী করে চলে যাচ্ছে। শনিবার সন্ধেয় দিল্লি ক্রিকেট সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল যে, গম্ভীর ডুয়েলটা যে এ ভাবে হারবেন সত্যিই ভাবা যায়নি। এঁদের বক্তব্য— রঞ্জি মরসুমে দিল্লি অধিনায়ক বনাম দিল্লি কিউরেটর এখন আর কোনও খবর নয়। প্রায় রোজ নাকি লাগে। কিন্ত ‘প্রতিশোধস্পৃহায়’ কোটলা পিচ থেকে যে এতটা দয়ামায়াহীন ভাবে স্পিন-সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হবে, ভাবা যায়নি।

গল্প রসালো, কিন্তু যুক্তিটা নয়। শনিবারের কে-কে-হার চিত্রনাট্যে কোটলার বাইশ গজ বড়জোর প্রধান পার্শ্বচরিত্র, কিন্তু কোনও ভাবে মুখ্য খলনায়ক নয়। কোটলার সাইড বাউন্ডারি বেশ ছোট। ঠিকঠাক টাইম হলেই গ্যালারিতে উড়ে যাবে। ১৮৭ টি-টোয়েন্টি পৃথিবীতে কঠিন টার্গেট ঠিক, কিন্তু অসম্ভব নয়। ওঠে, উঠবেও। তা ছাড়া উইকেটে স্পিন না থাকতে পারে, কিন্তু খেলার অযোগ্য তো ছিল না। বরং অসাধারণ ব্যাটিং-ট্র্যাক, যেখানে ভাল কেকেআর ব্যাটিং ‘ট্রিট টু ওয়াচ’ হওয়া উচিত। শুরুতে ব্যাটম্যান-রবিন। মধ্যে সূর্য-রশ্মি। লোয়ার অর্ডারে ‘হিটম্যান’ রাসেল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এত হিরে-জহরত একসঙ্গে আর কোথায়?

মুশকিল হল, ঠিকঠাক কাটার উপর যেমন হিরের দাম নির্ভর করে, ব্যাটিং-বিস্ফোরণ নির্ভর করে তেমনই ব্যাটিং অর্ডারের উপর। বিরাট কোহালিকে যে কারণে এগারো নম্বরে নামালে জীবনে কাজ হবে না, পীযূষ চাওলাকে তিনে তুললেও তাই। বোধগম্য হল না, ওয়াংখেড়েতে সাকিবকে তিনে পাঠিয়ে ডোবার পরেও কেন আবার নাম্বার থ্রি পজিশনকে কেমিস্ট্রি ল্যাব করে তুলতে চাইল টিম। তা-ও আবার কাকে দিয়ে? না, পীযুষ চাওলা! রবিন উথাপ্পা পরে বলে গেলেন, পিসি (চাওলাকে এ নামেই ডাকে টিম) ব্যাট ধরতে পারেন না এমন তো নয়। ঠিক। কিন্তু তিনি তো পিসি সরকারও নন যাঁকে তিন নম্বরে পাঠালে ১৮৭ উঠে যাবে। চাওলা টিকলেন পাঁচ বল, ব্যাটিংয়ের চেয়ে নাচলেন বেশি এবং ৮ করে বিদায়। লাভ কী হল? পাওয়ার প্লে-তে গোটা চল্লিশ উঠতে না উঠতে দু’টো বেরিয়ে গেল আর তিনে প্রমাণিত সূর্যকুমার যাদব পাঁচ নম্বরে এসে দেখলেন, আস্কিং রেট বারো-সাড়ে বারোর মাল্টিস্টোরিডে উঠে বসে আছে।

তবু কেকেআর জিততে পারত। দিল্লিকে প্রথম ওভারে ২-২ করে অমিতব্যয়ী মনোভাব দেখানো কেকেআর জিততে পারত। রবিন উথাপ্পা অসাধারণ খেলছিলেন। কিন্ত আবার ওই যে, মর্মান্তিক ব্যাটিং অর্ডার নির্বাচন। আন্দ্রে রাসেলের সঙ্গে উথাপ্পার পার্টনারশিপ হল প্রায় পঞ্চাশ রান। কিন্তু সেটা আরও বাড়তে পারত ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেও প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া আর সতীশকে বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডারের আগে না পাঠালে। ৬ বলে ৭ করলেন সতীশ। প্রয়োজনের সময় একটা গোটা ওভার রান রেটকে নিস্তেজ রেখে দিলেন। কে বলতে পারে, রাসেল ওই ছ’টা বল পেলে আস্কিং রেট ধর্তব্যের মধ্যে আসত না?

একটা সময় শেষ চার ওভারে ৫১ দরকার ছিল কেকেআরের। রাসেল-উথাপ্পা সেটাকে ১৯ বলে ৩৬-এ নামিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু দু’জনেই জানতেন, কেউ একজন চলে গেলে ম্যাচ অর্ধেক শেষ। রাসেলের আউটটা দুর্ভাগ্যজনক। ধরতে না পারলে অমিত মিশ্রর মুখ ফেটে রক্তারক্তি হতে পারত। রবিন চলে গেলেন নিঃসঙ্গ হয়ে। চালাতে গিয়ে শেষ। আর কেকেআর শেষ হয়ে গেল প্রায় দেড় ওভার বাকি থাকতে।

ম্যাচ শেষে গম্ভীর বলে গেলেন, পনেরো থেকে কুড়ি রান বেশি দিয়েছে বোলাররা। আরও স্মার্ট হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আগে তো স্মার্ট চিন্তাভাবনা দরকার। মর্কেল যে হোল্ডারের চেয়ে যে কোনও দিন কাম্য, শিশুও বোঝে। যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকান ফিট। যে পিচে মরিস-জাহিররা ঘর্মাক্ত করে দিলেন কেকেআর ব্যাটসম্যানদের, সেখানে হোল্ডার দিলেন চার ওভারে চল্লিশের কাছাকাছি। দোষ তাঁর নয়, দোষ টিম ম্যানেজমেন্টের।

শোনা গেল, মণীশ পাণ্ডে বেঙ্গালুরুতে টিমের সঙ্গে ফিরবেন। যদি চিন্নাস্বামীতে সম্ভব হয় তো ওখানে। নইলে হয়তো কলকাতায় টিমে ঢুকবেন কর্নাটকী। যত দ্রুত সেটা হয়, তত ভাল। উথাপ্পা আরও বললেন যে, বেঙ্গালুরু ম্যাচটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওখানে জিততে পারলে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। টিম ফিরে আসবে চেনা মেজাজে।

শুনতে ভালই লাগছে। দুর্মূল্য প্রশ্ন হল, কেকেআর পারবে তো? ওখানে তো এক-আধটা স্যাম বিলিংস বা ব্রেথওয়েট দাঁড়িয়ে নেই, একসঙ্গে তিন-চার জন দাঁড়িয়ে। ওখানে কিন্তু ভিকে-এবি একসঙ্গে দাঁড়িয়ে রে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর: দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ১৮৬-৮ (নায়ার ৬৮, বিলিংস ৫৪, ব্রেথওয়েট ৩৪। রাসেল ৩-২৬, নারিন ১-২২)। কেকেআর ১৫৯ (উথাপ্পা ৭২, জাহির ৩-২১)।

IPL 2016 kkr delhi dare devils
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy