Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৩

মণিপুরের ‘৮ রত্ন’কে পাঁচ লাখ পুরস্কার

অনেক লড়াই ও দারিদ্রতাকে হারিয়ে জাতীয় দলে পৌঁছানো আট কিশোরের অনেকেই ভাবতে পারেনি ফুটবল চালিয়ে যাবে। নিংথোইনগাংবার বাবা দুধ বিক্রি করে পাঁচ জনের সংসার অতি কষ্টে চালাতেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৭ ০১:২১
Share: Save:

উত্তর-পূর্বে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাস এই রাজ্যে। রয়েছে আফস্পার সমস্যা। ভুয়ো সংঘর্ষ লেগেই থাকে নিত্যদিন। যে রাজ্যে অলিম্পিক্সে পদক জেতার পরেও মেরি কমকে পদোন্নতি আর সরকারি প্রতিশ্রুতি পূরণে অপেক্ষায় থাকতে হয় বছর দেড়েক। রাজ্যে একমাত্র স্টেডিয়াম বলতে খুমান লাম্পাক। দারিদ্র-অনুন্নয়ন-নাশকতা-দুর্নীতির সঙ্গে ঘর করা সেই রাজ্যেরই আট ‘রত্ন’ ফের মুখ উজ্জ্বল করল মণিপুরের। অনুর্দ্ধ ১৭ যুব বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে যে ২১ জনকে বাছা হয়েছে তার মধ্যে আট জনই এই পাহাড়ি রাজ্যের। দেশের আর কোনও রাজ্য থেকেই এত ফুটবলার সুযোগ পাননি লুইস নর্টন দে মাতোসের দলে। শুধু তাই নয়, বছর ষোলোর অমরজিৎ সিংহ কিয়ামকে তো আবার বেছে নেওয়া হয়েছে অধিনায়ক! অখ্যাত মিজোরামের আইজল এফসি গতবারই আই লিগ জিতে চমকে দিয়েছিল। তেমনই ভারতীয় দলে আট মণিপুরি কিশোরের অন্তর্ভুক্তিও বড় চমক। খেলার মাঠে মেরি কম, সরিতা দেবী, কুঞ্জরানি দেবী, ডিংকো সিংহ-র উজ্জ্বল উদাহরণের পাশে যুব বিশ্বকাপের অমরজিতরাও তাই যেন পিছিয়ে পড়া রাজ্যে নতুন আলো এনে দিয়েছেন। এবং বিশ্ব মঞ্চে এই প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই মণিপুর সরকার আট ফুটবলারকে পাঁচ লাখ টাকা করে পুরস্কৃত করার কথা জানিয়েছে শনিবার। শুধু তাই নয়, ক্রীড়ামন্ত্রী লেটপাও হাওকিপ ব্যক্তিগতভাবে দশ হাজার টাকা দেওয়া কথা ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, প্রত্যেক ফুটবলারের বাড়ির দু’জন করে সদস্যকে ভারতের খেলা দেখাতে নিয়ে যাবেন তিনি। যাওয়া-আসা এবং টিকিটও দেবেন।

কিন্তু কী ভাবে ওটা সম্ভব হল? খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেটাও হয়েছে অদ্ভুতভাবে। দু’বছর আগে ২০১৫-তে নিকোলাই অ্যাডাম জাতীয় যুব দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর সহকারী কোচের দায়িত্বে থাকা মণিপুরের এন জি বিতান সিংহ তাঁকে উত্তর-পূর্বে নিয়ে আসেন ফুটবলার খোঁজার জন্য। কারণ বিতান সিংহের বিশ্বাস ছিল উন্নয়ন-পরিকাঠামো না থাকলেও দেশের সেরা ফুটবল প্রতিভাদের আঁতুড়ঘর এখানেই। কিন্তু মেঘালয়, সিকিম, মিজোরাম, মণিপুরের ফুটবলারদের কম উচ্চতার কারণ দেখিয়ে জন্য বাতিল করেন অ্যাডা ম। আট মাস পরে বিতান ফের অ্যাডামকে মণিপুর নিয়ে আসেন। এ বারে খালি হাতে ফেরেননি অ্যাডাম। তিনি চাকরি ছাড়লেও তাঁর হাতে তৈরি মণিপুরের সেই ছেলেরাই মাতোসের বর্তমান দলের চালিকাশক্তি। জাতীয় যুব দলে মণিপুরের যে ফুটবলাররা রয়েছেন তারা হলেন, ধীরাজ সিংহ মইরাংথেম, বরিস সিংহ থংজাম, সুরেশ সিংহ ওয়াংজাম, কে নিংথোইনগাংবা মেইতেই, অমরজিৎ সিংহ কিয়াম, জিকসন সিংহ থৌনাওজাম, মহম্মদ শাহজাহান, নোংদাংমা নাওরেম।

অনেক লড়াই ও দারিদ্রতাকে হারিয়ে জাতীয় দলে পৌঁছানো আট কিশোরের অনেকেই ভাবতে পারেনি ফুটবল চালিয়ে যাবে। নিংথোইনগাংবার বাবা দুধ বিক্রি করে পাঁচ জনের সংসার অতি কষ্টে চালাতেন। দু’মাস আগে তাঁর মৃত্যু হয়। ভেঙে পড়লেও পরিবারের উৎসাহে মাঠে ফেরে নিংথোইনগাংবা। দিদি সানা জানায়, ভাইয়ের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ায় অনেকদিন পরে আমরা হাসলাম। শাহজাহানের বাবা দর্জি। বরিসের বাবা বিভিন্ন রকম কাজ করে ছেলের ফুটবল বুট কেনার টাকা জোগাড় করেন।

ফুটবলারদের ভোটে দলের অধিনায়ক হওয়া থৌবালের ছেলে অমরজিৎ সিংহের মা মাছ বিক্রি করেন। বাবা কখনও চাষ করেন, কখনও কাঠের কাজ। স্কুল দলে ভাল খেলতে থাকা অমরজিতকে চণ্ডীগড় ফুটবল অকাদেমিতে পাঠানোর জন্য বিমানের টিকিট কাটতে সঞ্চয় ভেঙে ৬০০০ টাকা দিয়েছিলেন বাবা। অ্যাডামের চোখে পড়াটাকেই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করে অমরজিৎ। জার্মানি-স্পেনে গিয়ে সেখানকার দলের সঙ্গে খেলা ও অনুশীলন করার আকাশ-পাতাল ফারাকটা এখনও তার পরিবারের কাছে স্বপ্ন মনে হয়। অমরজিতের মা আসাংবি এখন গর্বের সঙ্গে ইম্ফলের বাজারে মাছ বিক্রি করার ফাঁকে খদ্দেরদের কাছে গল্প করেন, তাঁর ছেলে ভারতের অধিনায়ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE