Advertisement
E-Paper

স্যার নেই, আর কে মিষ্টি খাওয়াবে

সকাল আটটা নাগাদ এল টেক্সট মেসেজটা। তখন আমরা টিম বাসে। লাহলি থেকে সবে বেরিয়েছি। জয়দীপদার (মুখোপাধ্যায়) টেক্সট। আমাদের ক্রিকেট অপারেশনস ম্যানেজার।

মনোজ তিওয়ারি

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৪
প্রয়াত সমীর দাশগুপ্তকে শেষ শ্রদ্ধা লক্ষ্মীরতন শুক্লর। বুধবার। -শঙ্কর নাগ দাস

প্রয়াত সমীর দাশগুপ্তকে শেষ শ্রদ্ধা লক্ষ্মীরতন শুক্লর। বুধবার। -শঙ্কর নাগ দাস

সকাল আটটা নাগাদ এল টেক্সট মেসেজটা। তখন আমরা টিম বাসে। লাহলি থেকে সবে বেরিয়েছি। জয়দীপদার (মুখোপাধ্যায়) টেক্সট। আমাদের ক্রিকেট অপারেশনস ম্যানেজার।

‘সমীরদা ইজ নো মোর’।

মাথাটা যেন ঝনঝন করে উঠল।

কষ্টে বুজে আসা চোখের অন্ধকারে ভেসে উঠল সমীরদার মুখটা। আমাদের রাজকোট থেকে লাহলি যাওয়ার মাঝপথে মুম্বই এয়ারপোর্টে বিদায় নেওয়ার সময় স্যারের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল— ‘গুড বাই রে বাবু । টেক কেয়ার।’

তখনও কি ভাবতে পেরেছি, সেই হবে আমাকে বলা সমীরদার শেষ কথা? সেই আমাদের শেষ দেখা?

বহু টিমে তো বহু ম্যানেজার পেয়েছি। তাঁদের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু সমীরদার মধ্যে যে ব্যাপারটা ছিল, সেটা কারও মধ্যে পাইনি। সবসময় টিপটপ। কোট-প্যান্ট-টাইয়ে। দেশ বিদেশের নানা রকমের টাই। কখনও এক রকম টাই পরতে দেখিনি ওঁকে। ওগুলো নিয়ে বলতেন, নানা রকমের টাই সংগ্রহ করাটা ওর নেশা। সাতশোর উপর নাকি টাই আছে ওঁর কাছে, বলেছিলেন একবার। আরও অনেক স্মারক ওঁর সংগ্রহে ছিল নাকি।

ম্যানেজার নন, উনি ছিলেন আমাদের বন্ধুর মতো, দাদার মতো। বাইরে খেলতে গিয়ে কম আবদার করিনি ওঁর কাছে। সব আবদার মেটাতেন হাসিমুখে। মিষ্টি খাওয়াতেন আমাদের প্রায়ই। এমনকী অন্য শহরে গিয়েও। কলকাতা থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যেতেন পাঁচ-ছ’রকমের। সেই মিষ্টি আমাদের ডেকে ডেকে খাওয়াতেন। তখন আমি দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে আইপিএলে খেলি। আমরা এলাম কলকাতায়। টিমমেটরা আমাকে ধরল কলকাতার মিষ্টি খাওয়াতে হবে। আর মিষ্টির কথা শুনেই মনে পড়ল স্যারের কথা। ফোন করলাম। সন্ধ্যাবেলাতেই চার রকমের মিষ্টি নিয়ে উনি হাজির। আমার টিমের বন্ধুরাও খুশি।

আড্ডাও মারতেন আমাদের সঙ্গে। সচিন তেন্ডুলকর একবার কলকাতায় এসে ওঁর বাড়িতে যেতে চেয়েছিল, সেই গল্পও শুনিয়েছিলেন। সচিনের ইচ্ছা শুনে সমীরদা নাকি বলেছিলেন, ওঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে হলে যা নিরাপত্তার প্রয়োজন, তা উনি পাবেন কোথায়? সচিন ওঁকে বলেছিল, রাত বারোটায় ওঁর বাড়ি যাবে। তা হলে সিকিউরিটি লাগবে না। মাঝরাতেই সে দিন কী ভাবে সচিনকে ওবেরয় গ্র্যান্ড থেকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই গল্প শুনিয়েছিলেন আমাকে। এ রকম আরও কত গল্প। সব বলতে গেলে হয়তো পুরো পাতাটাই লেগে যাবে। সমীরদা ছিলেন এমন একটা চরিত্র যে মাঠে না নেমেও ক্রিকেটারদের মতোই জনপ্রিয়। শুধু বাংলায় না, সারা দেশে। ইন্ডিয়া এ টিমের সঙ্গে একবার খেলতে গিয়েছিলাম। তখন প্রবীন আমরে, লালচাঁদ রাজপুতরাও বলতেন সমীরদার কথা। এ রকম ক্রিকেট কর্তা আর দেখিনি।

এ বার রঞ্জিতে রাজকোটেই প্রথম স্যারকে দেখে একটু অন্য রকম লাগল। কম খাচ্ছিলেন, বেশি চলাফেরা করছিলেন না। দোতলায় আমাদের ড্রেসিংরুমে উঠে আসতে পারছিলেন না। নীচে মাঠে বসেই অল্পস্বল্প খেয়ে নিচ্ছিলেন। তখনই মনে হয়েছিল ওঁর শরীরটা বোধহয় ভাল নেই। আমি আর আমাদের কোচ সাইরাজ বারবার জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি ভাল আছেন তো?’ বারবার উত্তর দিয়েছেন, ঠিক আছেন। ঠিক যে ছিলেন না, তা এত দিনে বুঝলাম।

বারবার একটা আক্ষেপের কথা বলতেন আমাদের। ম্যানেজার হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটের সব ট্রফি জেতা হয়ে গিয়েছে ওঁর। শুধু রঞ্জি ট্রফিটা বাকি। বলতেন, ‘এ বার আমার জন্য অন্তত রঞ্জিটা জিতে দেখা।’ উনি আমাদের এত ভালবাসা দিলেন, অথচ ওঁর এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারলাম না। সরি সমীরদা। পারলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।

লেখাটা শেষ করার সময় এখনও কানে বাজছে সমীরদার বলা সেই শেষ কথাগুলো ‘গুড বাই রে বাবু। টেক কেয়ার’।

টেক কেয়ার স্যার। যেখানেই থাকুন, ভাল থাকবেন।

Laxmi Ratan Shukla Samir dasgupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy