Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Ravi Shastri

বলটা তুলে দিয়ে বলল, প্রাণ খুলে বোলিং কর রাজা

শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি প্রার্থনা, আমাদের মতো তরুণকে যেমন অধিনায়ক হিসেবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনই এগিয়ে নিয়ে চলুক এই প্রজন্মের ভারতীয় দলকে।

ঐতিহাসিক: ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজ চূর্ণ। অভিষেকেই নায়ক হিরোয়ানিকে নিয়ে উল্লাস অধিনায়ক শাস্ত্রীর।

ঐতিহাসিক: ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজ চূর্ণ। অভিষেকেই নায়ক হিরোয়ানিকে নিয়ে উল্লাস অধিনায়ক শাস্ত্রীর। ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র হিরোয়ানি
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২১ ০৫:১৫
Share: Save:

আমার অভিষেক টেস্টের অধিনায়কের ৫৯তম জন্মদিনে মন ছুটছিল তেত্রিশ বছর আগের এক ফ্লাইটে।

১৯৮৮ সালের জানুয়ারি। মুম্বই থেকে ফ্লাইটে করে চেন্নাই যাচ্ছি। একই ফ্লাইটে বসা আমার অস্থায়ী অধিনায়ক। মাঝ আকাশেই আমাকে যে বলে দেবে, তুই চেন্নাই টেস্টে খেলছিস!

সেই অধিনায়কের নাম? রবি শাস্ত্রী। যাঁর ৫৯তম জন্মদিন গেল বৃহস্পতিবার। শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি প্রার্থনা, আমাদের মতো তরুণকে যেমন অধিনায়ক হিসেবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনই এগিয়ে নিয়ে চলুক এই প্রজন্মের ভারতীয় দলকে। রবি শাস্ত্রী বরাবরই তরুণদের কাছ থেকে সেরা খেলা বার করে এনেছে। সাইরাজ বাহুতুলেদের মতো নতুন মুখদের নিয়ে মুম্বইকে রঞ্জি জেতানো কে ভুলতে পারবে!

তেমনই চেন্নাই টেস্টের তিন-চার দিন আগেই এক নবাগতকে বলে দিয়েছিল, তুই খেলছিস! এটা যে কতটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে পারে, মুম্বই-চেন্নাই আকাশপথেই বুঝে গিয়েছিল এক তরুন লেগস্পিনার। সে দিনের নরেন্দ্র হিরোয়ানির তখনই মনে হচ্ছিল, বল করা শুরু করে দিই। এতটা টগবগে আর কখনও লাগেনি। তরুণ খেলোয়াড়ের মনে সব চেয়ে বেশি করে ঘোরে কয়েকটি প্রশ্ন। আমি কি এই টেস্টে খেলব? না কী বাইরে বসে থাকতে হবে? খেললে কখন আমাকে বলা হবে? নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, অনেক আগেই আমাকে খেলার কথা জানিয়ে দিয়েছিল অধিনায়ক। তাতেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম আমি। বুক চওড়া হয়ে গিয়েছিল যে, অধিনায়ক আস্থা রাখছে। আমি ঠিক পারব। ব্যর্থ হয়ে ফিরব না।

সেই টেস্টে ১৬ উইকেট নিয়ে সফল অভিষেকের জন্য অনেকে আমার কথা বলে। কিন্তু আজও আমি ভুলিনি কী ভাবে অধিনায়ক আমার মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিপক্ষে দুর্ধর্ষ সব নাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখনও বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করছে। অধিনায়কের নাম ভিভিয়ান রিচার্ডস। সারা বিশ্বের বোলারদের কাছে ত্রাস। অভিষেক টেস্টে তার মতো শাসকের সামনে পড়া। তবু মুহূর্তের মধ্যে যেন চাপ হাল্কা হয়ে গিয়েছিল ফ্লাইটের মধ্যে রবি ভাইয়ের আশ্বাসে। আর সেটা ছিল শুধু শুরু। এর পরে টেস্টের আগে হোটেলের রুমে, চলতে-ফিরতে, টেস্ট চলাকালীন মাঠের মধ্যে নানা ভাবে আরও দুঃসাহসী করে তুলেছিল আমাদের অধিনায়ক। ভিভকে নিয়ে বলেছিল, ‘‘নিজের সেরাটা দিবি ব্যস। মনে রাখবি সবাই মানুষ, সবাই ভুল করে। কেউ অতিমানব নয়।’’ রবি ভাই জানত, ভিভ আক্রমণ করবে বোলারদের। তাই বলে দিয়েছিল, ‘‘নিজের উপর আস্থা রেখে লাইন-লেংথে বল করবি। নিজের রণনীতি থেকে সরে যাবি না।’’

প্রথম ইনিংসে তবু ভিভ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দিনের শেষে নট আউট ছিল। তখন টেস্ট ক্রিকেটে ‘রেস্ট ডে’ ছিল। বিরতি দিনের পরে এসে ভিভকে আমি ফ্লিপারে বোল্ড করি। অধিনায়ক উচ্ছ্বসিত। ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘‘রাজা, ক্যায়া বল ডালা তু নে!’’ সেই টেস্টে সারাক্ষণ আমাকে ‘রাজা-রাজা’ বলে ডেকে গিয়েছিল। তাতে যেন আরওই রক্ত ফুটে উঠছিল। আমি তখন উনিশ বছরের তরুণ। জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নামছি। রবি শাস্ত্রী ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গ্ল্যামার বয়’। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জেতা দলের তারকা অলরাউন্ডার। চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স হয়ে আউডি জিতে এসেছে। ভয়ে ভয়ে ফ্লাইটে উঠেছিলাম। কিন্তু কাঁধে হাত রেখে সেই যে বলে দিল, তুই খেলছিস, তাতেই সমস্ত জড়তা কেটে গিয়েছিল আমার। এখনকার ক্রিকেট দুনিয়ায় হয়তো অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সিনিয়র-জুনিয়র ব্যবধান অনেক মিটেছে। কিন্তু ১৯৮৮-তে দাঁড়িয়ে এমন খোলামেলা চিন্তাভাবনা খুব বেশি দেখা যেত না। এই কারণেই আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, রবি শাস্ত্রী আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হতে পারত। খুব বেশি নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পায়নি, কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছে, সফল হয়ে দেখিয়েছে।

যেমন চেন্নাইয়ের সেই স্মরণীয় টেস্টেই দিলীপ বেঙ্গসরকর আহত ছিল বলে রবি ভাই অধিনায়কত্ব করছিল। চার দিনে আমরা টেস্ট জিতে নিই ২৫৫ রানে। ৯টি মরসুম পরে সেটা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়। অনেক পরে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছি জুনিয়র দলের কোচ হিসেবে, ভিভ তখনও বলেছে চেন্নাই টেস্টে সেই হারের কথা। গর্ডন গ্রিনিজ বলেছে, বেঁচে গিয়েছিলাম সেই টেস্টে ছিলাম না। গ্রিনিজ ছিল না। কিন্তু জেসমন্ড হেনেস ছিল। সঙ্গী ওপেনার ফিল সিমন্স। আর মিডল অর্ডার ছিল এ রকম: রিচি রিচার্ডসন, ভিভিয়ান রিচার্ডস, গাস লোগি, কার্ল হুপার, জেফ দুজোঁ। ফাস্ট বোলিংয়ে প্যাটট্রিক প্যাটারসন, কোর্টনি ওয়ালশ, উইন্সটন ডেভিস। দুর্ধর্ষ ক্যারিবিয়ান দল। আর আমাদের দলে তিন জনের অভিষেক ঘটেছিল সেই টেস্টে। আমি, অজয় শর্মা, ডব্লিউ ভি রামন। তরুণ দল নিয়েই সকলকে চমকে দিয়েছিল শাস্ত্রীর ভারত। আমার মতে, ওই টেস্ট জয়ের সব চেয়ে বেশি কৃতিত্ব ২ জনের। এক জন অবশ্যই অসাধারণ অধিনায়কত্ব করা রবি শাস্ত্রী। অন্য জন কপিল দেব। প্রথম ইনিংসে কপিল দেবের দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি না থাকলে জানি না, টেস্টটা অত একপেশে হতো কি না।

বোলারদের জন্য সেরা অধিনায়কদের এক জন রবি শাস্ত্রী। ওর অধিনায়কত্বে খেলা যে কোনও বোলারকে জিজ্ঞেস করুন, সকলে একবাক্যে স্বীকার করবে স্বপ্নের ক্যাপ্টেন ছিল। বোলারকে দারুণ আত্মবিশ্বাস দিত রবি ভাই। পুরো চাপমুক্ত করে দিত, সেটাই ছিল সব চেয়ে বড় ব্যাপার। সে সঞ্জীব শর্মা হোক কী নরেন্দ্র হিরোয়ানি, সকলে শাস্ত্রীর নেতৃত্বে বোলিং দারুণ উপভোগ করত। হাতে বল তুলে দিয়ে বলত, ‘‘তু রাজা হ্যায়। যত চাস বোলিং কর। কোনও চিন্তা নেই।’’ কারও মনের মধ্যে যদি চাপ একশো থাকে, রবি ভাই সেটাকে শূন্য করে দিত। শারজায় আমি ওয়ান ডে-তে সিরিজে সেরা বোলিং করেছিলাম শাস্ত্রীর অধিনায়কত্বে। ওখানে আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, ‘‘তুই রানের কথা ভাবিস না। উইকেট তোল।’’ আমি রিস্টস্পিনার। বেশি ইতিবাচক বল করতে গেলে মার খেতে পারি। সেটা মাথায় রেখে প্রথমেই সাহস দিয়ে রেখেছিল। খেলোয়াড় হিসেবে নিজেও যে ডাকাবুকোই ছিল। দশ নম্বর ব্যাটসম্যান ওপেন করার দুঃসাহসই শুধু দেখায়নি, পাকিস্তানে ইমরান-সরফরাজদের বিরুদ্ধে রান করে দেখিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুই প্রজন্মের সেরা পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধে দু’টি টেস্ট সেঞ্চুরি আছে। শুধু একটাই আফসোস থেকে গিয়েছে। ভারত তার অন্যতম সেরা অধিনায়ককে সে ভাবে পেলই না।

শুভ জন্মদিন ক্যাপ্টেন। একই ভাবে তরুণদের কাঁধে হাত রেখে যাও!

(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cricket Ravi Shastri Narendra Hirwani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE