Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কার্ফুর মধ্যে রোজ ৫০ কিমি দৌড়ে জাতীয় দলে

মণিপুরের আওয়াং লেইকাই গ্রাম থেকে ইম্ফলের খুমান লাম্পাক স্টেডিয়ামের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বাসে করে এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়।

অকুতোভয়: জীবনযুদ্ধে জিতে ভারতীয় ফুটবল দলে মিলন (ডান দিকে)।

অকুতোভয়: জীবনযুদ্ধে জিতে ভারতীয় ফুটবল দলে মিলন (ডান দিকে)।

শুভজিৎ মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৭ ০৪:০৮
Share: Save:

মণিপুরের আওয়াং লেইকাই গ্রাম থেকে ইম্ফলের খুমান লাম্পাক স্টেডিয়ামের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বাসে করে এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু রিকশাচালক বাবার সন্তানের কাছে শৈশবে বাসে চড়া ছিল স্বপ্নের অতীত। তাই ২৫ কিলোমিটার দৌড়েই প্র্যাক্টিস করতে যেতেন। ক্লান্ত শরীরে একই ভাবে ২৫ কিলোমিটার দৌড়ে দৌড়ে ফিরতেন গ্রামে।

তিনি, এই মুহূর্তে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার— মিলন সিংহ।

গত পাঁচ বছরে অবশ্য মিলনের জীবন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। আর্থিক সঙ্কট দূর হতেই বাবা শ্যাম সিংহের রিকশা চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। মিলন বলছিলেন, ‘‘আমার বাবাও ভাল ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু অভাবের জন্য খেলা ছেড়ে বাধ্য হয়ে রিকশা চালাতেন। তবে স্বপ্ন দেখতেন আমাদের পাঁচ ভাইকে ফুটবলার বানানোর।’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘আমাদের গ্রামে কোনও অ্যাকাডেমি না থাকায় ইম্ফলের থাংমেইব্যান্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু ২৫ কিমি দূরে রোজ প্র্যাক্টিস করতে যাব কী করে? বাবার পক্ষে যাতায়াতের বাসভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। অগত্যা দৌড়েই যাতায়াত করতাম। তার জন্য অবশ্য বহুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছি।’’

কী ভাবে? ২৪ বছর বয়সি ভারতীয় দলের মিডফিল্ডারের কথায়, ‘‘আমাদের ছোটবেলায় মণিপুরে বিকেল থেকেই কার্ফু জারি হয়ে যেত। চলত পরের দিন সকাল পর্যন্ত। আর প্র্যাক্টিস শুরু হতো সকাল সাতটায়। তাই ভোর চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তাম। অন্ধকারের মধ্যে দৌড়তে দৌড়তেই শুনতে পেতাম গম্ভীর গলায় হুকুম— হল্ট! দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘিরে ধরতেন সেনাবাহিনীর জওয়ানরা।’’ মিলন বলে চলেন, ‘‘মণিপুরের পরিস্থিতি সেই সময় অগ্নিগর্ভ ছিল। তাই আমি যে ফুটবল খেলতে যাচ্ছি, সেটা ওঁরা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না। যে কোনও মুহূর্তে গুলিতে আমার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারত।’’

বছরখানেকের মধ্যে থাংমেইব্যান্ড অ্যাথলেটিক ক্লাবের অ্যাকাডেমি থেকে জুনিয়র দলে সুযোগ পান মিলন। থাকতেন অ্যাকাডেমির হস্টেলেই। তাঁর কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বৃত্তির ১৭৫০ টাকা! হাত খরচের জন্য ৭৫০ টাকা রেখে বাকিটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।

মণিপুরের ক্লাব থেকেই টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে সুযোগ পান মিলন। সেখান থেকে ২০১০ সালে ইস্টবেঙ্গলে। কিন্তু ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের কোচিংয়ে তাঁর লাল-হলুদ জার্সিতে মাঠে নামার স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল। মরসুমের মাঝপথেই ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের দল ইন্ডিয়ান অ্যারোজে। মর্গ্যান বলছিলেন, ‘‘মিলন খুব প্রতিভাবান মিডফিল্ডার। কিন্তু সেই সময় মাঝমাঠে ওকে খেলানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।’’

ফ্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের ভক্ত মিলনের পুনর্জন্ম ঘটে আইএসএলে দিল্লি ডায়নামোজে সই করার পর। মিলন বলছিলেন, ‘‘আলেজান্দ্রো দেল পিয়েরো, রবের্তো কার্লোস ও জিয়ানলুকা জামব্রোতার কোচিংয়ে খেলে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।’’ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর মিলনের লক্ষ্য এ বার কলকাতা ময়দানে প্রত্যাবর্তন ঘটানো। ‘‘অবসর নেওয়ার আগে অন্তত একটা বছর ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের হয়ে খেলতে চাই’’, বলছেন ভারতের দুঃসাহসিক মিডফিল্ড জেনারেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Milan Singh midfielder Indian Team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE