Advertisement
E-Paper

যত বুড়ো, তত ধারালো বুফন

ইতালির ইউরো দলটা যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, সবাই বলেছিল, আবার ওই জিয়ানলুইগি বুফন-কে কেন নেওয়া হল। এই বুড়োকে দিয়ে আর কত দিন চালাবে ইতালি। নামের জন্যই শুধু সুযোগ পায়।

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৬ ০৪:১৪
জিয়ানলুইগি বুফন

জিয়ানলুইগি বুফন

ইতালির ইউরো দলটা যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, সবাই বলেছিল, আবার ওই জিয়ানলুইগি বুফন-কে কেন নেওয়া হল। এই বুড়োকে দিয়ে আর কত দিন চালাবে ইতালি। নামের জন্যই শুধু সুযোগ পায়।

তখন আমার একটু হলেও রাগ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, আরে কেউ নাম ভাঙিয়ে কি ৩৮ বছর অবধি আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলে যেতে পারে? ইউরোতে ইতালির পারফরম্যান্স দেখার পরে মনে হচ্ছে আমার ধারণা মোটেও ভুল ছিল না। আন্তোনিও কন্তের কাউন্টার অ্যাটাক ছকের প্রশংসা করতেই হবে। সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে ইতালির গোলপোস্টের মাঝখানে বুড়ো লোকটাও দেশের এই চমক লাগানো পারফরম্যান্সের পিছনে অন্যতম কারণ। মাঠের বাইরে যদি ইতালির কোচ হন কন্তে, তা হলে মাঠের মধ্যের কোচের নাম বুফন। শুধু দুর্দান্ত গোলকিপিংটাই করছে না। পিছন থেকে পুরো টিমটাকে নেতৃত্বও দিচ্ছে।

এই ইউরোয় বুফন প্রমাণ করে দিয়েছে, নামের জোরে ও দলে সুযোগ পায়নি। ওর রিফ্লেক্স এখনও যে কোনও তরুণ গোলকিপারের মতোই তীক্ষ্ণ। গ্রিপিং এখনও বিশ্বমানের। বলটা চুম্বকের মতো গ্লাভসে লেগে থাকে।

দিনো জফ, প্যাট জেনিংস থেকে অলিভার কান। হ্যারল্ড শুমাখার থেকে ইকের কাসিয়াস। এদের খেলা আমি দেখেছি। আর দেখে মনে হয়েছে, যত বয়স বেড়েছে, তত যেন এদের গোলকিপিংয়ের ধারটাও বেড়েছে। বুফনও এই তালিকায় খুব উপর দিকেই থাকবে।

ইতালির এই বুড়ো গোলকিপারের মতো পেশাদার বিশ্বফুটবলে খুব কম আছে। কোনও কোনও গোলকিপারের বয়স হলে ফিটনেসে মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দেয়। বল দেখতে সমস্যা হয়। কিন্তু বুফন ঠিক উল্টোটা। ওর যত বয়স বাড়ছে ততই যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এত সুন্দর নিজেকে ফিট রেখেছে। দেখলে মনে হয় বয়স আটত্রিশ হলেও ওর মধ্যে এখনও কোনও কুড়ি বছরের তরুণের তাগিদ রয়েছে। যে আজও গোলের মাঝখানে দাঁড়ালে দুর্ভেদ্য হয়ে যায়। কেউ তো আর শুধু নামের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবলে এ রকম ভাবে চুটিয়ে খেলে যেতে পারে না।

বুফনের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সিক্স ইয়ার্ড বক্সের মধ্যে ও সব সময় ডিফেন্সকে গাইড করে। স্পেন ম্যাচেও দেখেছিলাম কন্তে যেমন ডাগআউট থেকে বারবার চিৎকার করছে, বুফনও সমানতালে রক্ষণের পজিশনিংটা ঠিক করে যাচ্ছে। সেট পিসের সময় সবাইকে আঙুল দেখিয়ে সঠিক পজিশনে থাকতে বলছে। গোলকিপারকে সব সময় লিডার হতে হয়। শান্ত বাচ্চার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে চলে না। গোলকিপাররা পিছন থেকে গোটা খেলাটা দেখছে। আক্রমণে থাকা ফুটবলাররা কোন পজিশন দিয়ে উঠতে পারে, আগেভাগেই ডিফেন্ডারদের সতর্ক করে গোলকিপার। বুফন সেই স্টাইলের গোলকিপার, যে কখনও একটা জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে না। সব সময় কিছু না কিছু বলছে ডিফেন্সকে। সব সময় নড়াচড়া করছে।

শনিবার রাতে বুফনের উল্টো দিকের গোলে যে থাকবে, সেই ম্যানুয়েল ন্যয়ার কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের গোলকিপার। অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না। গোলকিপারের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে অনেকটা। হয়ে উঠেছে সুইপার কিপার। যেন দলের একটা বাড়তি সেন্টার ব্যাক। বয়স কম থাকায় ওর গতি আছে। এ জন্য যতবারই কোনও বল ক্লিয়ার করতে বক্স থেকে বেরোয়, বিপক্ষ ফুটবলারের আগে বলের কাছে পৌঁছে যায়।

ন্যয়ারের বয়সটা কম হওয়ায় ও অনেক বেশি ক্ষিপ্র, কিন্তু অভিজ্ঞতা বুফনের হাতে অন্য এক অস্ত্র তুলে দিয়েছে— দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। শটের পর শট যখন তোমার দিকে বুলেটের মতো আসছে খুব তাড়াতাড়ি ঠিক করতে হবে কোন দিকে ডাইভ দিলে সুবিধা হবে। বা সেট পিসের সময়েও বলটা ফিস্ট করবে না গ্রিপ। বুফনের মধ্যে এই দ্রুত ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা আছে। ওর অনুমানক্ষমতা এমনিতেই দারুণ। সেট পিসের সময় অযথা ফিস্ট না করে ফুটবলারদের ভিড়ের মধ্যে থেকে বলটা গ্রিপ করে নেয়। এতেই বোঝা যায় ওর গেম রিডিং আর আত্মবিশ্বাস কোন জায়গায়।

আমি নিজেও ৩৫ বছর অবধি খেলেছি। পেশাদার গোলকিপার ছিলাম বলে জানি যত বয়স বাড়তে থাকে বলগুলো দেখতে সমস্যা হতে পারে। গ্রাউন্ডে সেভ করতেও সমস্যা হয়। নিজেকে ফিট রাখতে আমি খুব বেছে বেছে এক্সারসাইজ করতাম। সাধারণত জিমন্যাস্টরা যে শিডিউল মেনে চলে সেই ব্লু প্রিন্টটাই ধার করতাম। স্পটজাম্প বেশি করতাম। স্ট্রেচিং করতাম। ডাইভিং সেভগুলো বেশি প্র্যাকটিস করতাম। আর সেখানে বুফন তো ইতালির মতো দলে এক নম্বর গোলকিপার। তার উপরে জুভেন্তাসের হয়েও সব ম্যাচ খেলে। ওর ফিটনেস শিডিউল তো আরও নিষ্ঠুর হতে বাধ্য।

বুফনের রিফ্লেক্স নিয়ে নতুন করে আর কী বলব। স্পেনের বিরুদ্ধে সবাই সেটার নমুনা দেখেছে। পিকের শটটা নিশ্চিত গোলে ঢুকে যাওয়ার কথা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মাটি ঘেঁষে শরীর ফেলে দিয়ে বলটা বাঁচিয়ে দেয়। এতেই তো বোঝা যায় কী দুর্দান্ত রিফ্লেক্স। সঙ্গে ওর বল ডিস্ট্রিবিউশনও আক্রমণ তৈরি করতে পারে। বেলজিয়াম, সুইডেনের মতো ম্যাচেই সেটা দেখা গিয়েছে।

এক জনের বয়স ৩৮। অন্য জন ৩০। এক জন শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ায় উঠেছে, তো অন্য জন কিপিংটাই পাল্টে দিচ্ছে। কাল, ইউরোয় আমরা বুঝে যাব, গোলকিপিংয়ে চিরাচরিত অভিজ্ঞতা না বৈপ্লবিক দর্শন— কার জয় হবে।

Buffon
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy