চলছে উদ্বোধন।
কে যে কাকে চমকালো সেটাই বড় কথা হয়ে দাঁড়াল শেষমেষ। এর আগে বড় টুর্নামেন্টের অভিজ্ঞতা বলতে ছিল রাজ্যের বায়োডাটায় সাউথ এশিয়ান গেমস। সদ্য শেষ হওয়া বরদলৈ ট্রফিকে নবরূপ দেওয়ার চেষ্টা হলেও তা আসলে আইএসএসের জৌলুসের কাছে শিশু। আইএসএলের মতো মহাযজ্ঞের উদ্বোধন উত্তর-পূর্বে করার জন্য ঘরোয়া দল এনইইউএফসির মালিক বিস্তর চাপাচাপি করলেও পুরো অনুষ্ঠানের ভার বহনের সামর্থ্য গুয়াহাটির থাকবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় ছিল জন শিবির এবং আইএসএল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় যে উন্মাদনা, যে পেশাদারিত্ব, যে প্যাশন নিয়ে তৃতীয় আইএসএল গুয়াহাটিতে শুরু হল- তা দেখে খোদ আইএসএস চেয়ারপার্সন নীতা অম্বানি, কেরল ব্লাস্টার্সের মালির সচিন তেন্ডুলকর, চেন্নাইয়ের মালিক মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ও অভিষেক বচ্চনরা শিহরিত। ‘ধীরে চলো’র রাজ্য, সন্ত্রাসের ভয়ে ভীত রাজ্য, বন্ধ-অবরোধের সঙ্গে ঘর করা রাজ্য নয়, আইএসএলের উদ্বোধনে গত দু’বারের কলকাতা-চেন্নাইকে রীতিমতো টক্কর দিল অসম তথা গুয়াহাটি। যে শব্দব্রহ্ম সরুসজাইয়ের ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়ামে ঘরের দলের জন্য শোনা গেল, তা ডেসিবেলের নিরিখে যুবভারতী বা ইডেনকেও সমানে টক্কর দেবে।
টিকিটও শেষ দু’দিনেই। চেয়েও পাস জোগাড় করতে পারছেন না নেতা-বিধায়ক, এমনকী মন্ত্রীরাও! কালোবাজারির অভিযোগে স্টেডিয়ামের সামনে বিক্ষোভ। খামখেয়ালি আবহাওয়া। তুমুল যানজট। আগের তিন দিন বরদলৈ ট্রফিতে খেলা চলার সময় বেশ কয়েকবার ফ্লাডলাইট বন্ধ হয়ে কেলেঙ্কারি। খেলার শুরু আগে আমন্ত্রণ না পেয়ে প্রাক্তন মু্খ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের গোঁসা- এই নানারকম নেতিবাচককে পাশ কাটিয়ে ইন্দিরা গাঁধী স্টেডিয়ামে যেন বিকেল থেকে অন্য জগৎ। যদিও টুর্নামেন্ট ফুটবলের, তবু তার হাত ধরে আগে কখনও বলিউড আর ক্রিকেটের এমন চাঁদের হাট আগে দেখেনি শহর। সবার আগে মাঠে ঢোকেন সচিন ও মাহি। আগের লম্বা চুল ছেড়ে নেড়াপ্রায় মাথায় হালকা স্পাইক করা মাহিকে দেখেই জয়ধ্বনি। পিছনে, দলের জার্সি পরা সচিনের দিকে চোখ পড়ল অনেক পরে। মাঠের ভিতরে তখন কখনও পাকা পেশাদারি মেজাজে দলের মালিকের ভূমিকায় জন, কখনও আবার অতিথি আপ্যায়নে একেবারে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা।
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ৫টায় জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজের নাচে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। এরপর মোটরবাইকের কনভয় নিয়ে মাউন্টেন বাইক চেপে জনের প্রবেশ। মঞ্চে ডাকলেন গতবারের আয়োজক তথা চ্যাম্পিয়ন দলের মালিক অভিষেক বচ্চনকে। এরপর প্রবেশ ধোনির। তিনজনের মধ্যে কাপ ধরে রাখা আর কেড়ে নেওয়া নিয়ে খুনসুটির মধ্যেই আলোর হাতি চেপে মাঠে ঢোকেন সচিন। জয়ধ্বনি তখন আরও তুঙ্গে। ধোনি-অভিষেক এবারও জেতা নিয়ে আশাবাদী, সেখানে সচিনের কথায় জোর ছিল ফেয়ার প্লে-র উপরে। পরের অংশে মঞ্চ কাঁপানোর ভার নেন আলিয়া ভট, বরুণ ধবন, জ্যাকলিনরা। বলিউডি নাচের পরে গারো ওয়াংগালা, মণিপুরি ঢুলিয়াদের তালে নাচল কানায় কানায় ভরা স্টেডিয়াম। জাতীয় সঙ্গীতে শিলং চেম্বার কয়্যার।
আরও পড়ুন: হর্ষের সেরা ভারতের টেস্ট একাদশ নিয়ে তুমুল বিতর্ক
আইএসএল কিক অফের বল নিয়ে যে কালো মেয়েটি মঞ্চে এল গত বছর সাউথ এশিয়ান গেমসের সময়ও সে এখানে এসে গিয়েছে। একেবারে নীরবে। কারও তেমন পাত্তা না পেয়ে। কিন্তু এত তারকার মধ্যেও এ দিন অলিম্পিকে রুপোজয়ী সেই পি ভি সিন্ধুই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উষ্ণতা পেলেন। সিন্ধু বলেন, “গত কয়েক সপ্তাহে জীবন বদলেছে। পদকের গৌরব দায়িত্ব বাড়িয়েছে আরও। আর এই মাঠে দর্শকদের উচ্ছ্বাস ও সমর্থন দেখে দারুণ লাগছে।”
সব দেখে মুগ্ধ নীতা অম্বানি বলেন, “এত দিন জনের কাছে এখানকার খেলা পাগল মানুষের কথা শুনতাম। আজ দেখে মুগ্ধ, অবাক! মেরি কম, বাইচুং, দীপা কর্মকারদের উত্তর-পূর্বে আইএসএল শুরু করতে পেরে দারুণ লাগছে। এবার আরও সফল, আরও চমকপ্রদ হবে আইএসএল।” গত বারের মতোই এবারও তৃণমূল স্তরের ফুটবল প্রতিভা বিকাশে আট দলের মতে সেরার পুরস্কার পেল মুম্বই সিটি এফসি। দলের মালিক রণবীর কপূরও মানলেন, “জনের কাছে এতদিন শুনেছি। এখানকার মানুষের পাগলামি দেখে আমি অবাক।” একই মত সচিনেরও। উত্তর-পূর্ব তথা অসমকে এভাবে আলোকবৃত্তে টেনে আনায় জনকে ধন্যবাদ জানান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। তিনি জানান, গুয়াহাটিকে দেশের খেলার রাজধানী করে তুলতে চান তিনি। তাই চা বাগানগুলিতে শুরু করেছেন ফুটবল প্রতিযোগিতা। জন বলেন, “নিজে খেলোয়াড় বলে মুখ্যমন্ত্রী খেলার গুরুত্ব বুঝে এমন সাহায্য করেছেন। আমার সবচেয়ে বড় ভরসা এই মাঠ, এই জনতা, এই অদম্য প্যাশন। ওঁদের সম্মানেই আমার দল আরও ভাল খেলবে।”
মঞ্চের পিছনে শুরু হল আতসবাজির বাহার। কোথা থেকে সেলফি স্টিক বের করে ফেললেন আলিয়া। এর পর? একেবারে ম্যাডক্স স্কোয়ারোচিত কায়দায় মঞ্চের উপরে তাবড় সেলিব্রিটিরা যে ভাবে গ্রুপফি তোলায় মগ্ন হয়ে পড়লেন- সেই ছবিটাই এককথায় গুয়াহাটির স্টার মার্কস পাওয়ার সার্টিফিকেট। জন আব্রাহাম এবং মুম্বই-গুয়াহাটি মিলিয়ে উদ্বোধন সফল করতে রাতদিন খেটে চলা দলটা তত ক্ষণে প্রথম ঘাম মুছে হাসছে। তারাদের সামলানো শেষ। রাজ্য-শহর-স্টেডিয়াম-মঞ্চ সব মিলিয়ে মাঠের বাইরের খেলাটায় বুক ঠুকে সফল গুয়াহাটি। এবার তো আসল খেলা মাঠে। লেট্স ফুটবল।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy