Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জাতীয় সঙ্গীত বিতর্কের জবাব ওজিল দিচ্ছেন সিংহগর্জনে

মেসুট ওজিলকে নিয়ে শনিবার রাত থেকে ‘গানার্স’-রা এক কথায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছেন। প্রায় বিকারগ্রস্ত অবস্থা। ওজিল ইতালির বিরুদ্ধে একটা গোল করেছেন, একশো কুড়ি মিনিট ধরে দাপুটে ফুটবল খেলে গিয়েছেন, জার্মান টিমে গত রাতে তিনিই সেরা। অথচ তার পরেও যে জার্মান মিডিফিল্ডার একটা পেনাল্টি নষ্ট করেছেন।

বোর্দো-যুদ্ধে জার্মানিকে এগিয়ে দেওয়ার পর। ছবি: রয়টার্স

বোর্দো-যুদ্ধে জার্মানিকে এগিয়ে দেওয়ার পর। ছবি: রয়টার্স

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

মেসুট ওজিলকে নিয়ে শনিবার রাত থেকে ‘গানার্স’-রা এক কথায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছেন। প্রায় বিকারগ্রস্ত অবস্থা। ওজিল ইতালির বিরুদ্ধে একটা গোল করেছেন, একশো কুড়ি মিনিট ধরে দাপুটে ফুটবল খেলে গিয়েছেন, জার্মান টিমে গত রাতে তিনিই সেরা। অথচ তার পরেও যে জার্মান মিডিফিল্ডার একটা পেনাল্টি নষ্ট করেছেন। কিন্তু আর্সেনাল সমর্থকরা সে সব শুনলে তো?

সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কটা চোখের জার্মানকে নিয়ে বরং যে উত্তেজনার লাভাস্রোত তৈরি হয়েছে তা এ রকম:

ওজজজিল....ম্যাচের ফার্স্ট গোল আমাদের ওজিলই দিল!

প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট ওজিল ছাড়া কাউকে ভাবতে পারছি না। জাস্ট কাউকে ভাবতে পারছি না। সত্যি বলতে, আমি এখন কাঁদছি!

বিশ্ব কবে বুঝবে, মেসুট ওজিল দুর্ধর্ষ ডাকাত ছাড়া আর কিছু নয়। ও এ ভাবেই সবার রুটি-রুজি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ইতালি, তোমার কেমন লাগছে?

গুগল সার্চে ফেললে অসম্ভব প্রতিভাবান জার্মান মিডফিল্ডারকে নিয়ে প্রচুর খবরাখবর বেরিয়ে আসে। কেউ ওজিল নিয়ে ব্যক্তিগত ‘উইশলিস্ট’ পোস্ট করেছেন। যেখানে লেখা, ওজিলের থেকে তিনি ফুটবলের কোন কোন স্বর্গীয় জিনিসগুলো দেখতে চান। যেমন, ওজিল তুমি তোমার অসাধারণ বাঁ পা দিয়ে প্যাকড ডিফেন্স তছনছ করে দাও। তুমি ফ্রিকিক বা কর্নার আরও বেশি নাও। কেউ কেউ আবার আবেগের তাড়নায় লিখে ফেলে, ওজিল, আমি একা হয়ে পড়লে তুমি আমার সঙ্গে থেকো। আমি বাইরে গেলে তুমি আমার ‘পাগ’-কে দেখো— অদ্ভুতুড়ে নানা আব্দার। তাঁর ফুটবল-জীবনের নানা ঘটনাবলীও পাওয়া যায়। তাঁর ফুটবল স্কিল নিয়ে এক বহুজাতিক সংস্থা ফিল্ম বানাচ্ছে। কোথাও আবার আবিষ্কৃত হয় যে, মেসুট ওজিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাঁরই মতো ফুটবল কেরিয়ার নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে চান।

অথচ এই মেসুট ওজিলই ইউরো শুরুর আগে অপ্রত্যাশিত এক চরম আঘাত পেয়েছিলেন। তা-ও আবার অন্য কোথা থেকে নয়, সোজাসুজি নিজের দেশ থেকে!

ঠিক কী ঘটেছিল?

ফ্রান্স ইউরো তখনও শুরু হয়নি, হব-হব করছে। আচমকাই জার্মান অ্যান্টি-ইমিগ্র্যান্ট পার্টির নেত্রী ফ্র পের্তি আক্রমণ করে বসেন ওজিলকে। বলে দেন, জার্মানি টিমটা নামেই জার্মানি। আদতে তা নয়। ওজিলকে নাকি জার্মান জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শোনা যায় না। বলা হয়, এ সব করে ওজিল আসলে খুব সুক্ষ্ম ভাবে বোঝাতে চাইছেন যে তিনি আদতে জার্মান নন। দেশাত্মবোধ তাঁর বিন্দুমাত্র নেই! এক সংবাদপত্রে ওই নেত্রীকে বলতে শোনা যায়, “দেখলে খারাপ লাগে ওজিলের মতো এক জন ফুটবলার জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চায় না। এটা থেকে ও কী বার্তা দিতে চাইছে? দুনিয়া জুড়ে ওর অসংখ্য ভক্ত আছে। প্রচুর জার্মান শিশু ওকে রোলমডেল করে এখন বড় হচ্ছে। তারা কী শিখবে?” সোশ্যাল মিডিয়ায় জার্মান মিডফিল্ডারের এক ছবি পোস্ট করা নিয়েও ব্যঙ্গ করা হয়। এবং শুধু ওজিলেই যে ব্যাপারটা শেষ হয়েছিল তা নয়। জেরোম বোয়াতেংকেও ছাড়া হয়নি। বোয়াতেং জন্মসূত্রে জার্মান নন, ঘানাজাত। তাঁর ভাই কেভিন প্রিন্স বোয়াতেং ঘানার হয়ে খেলেন। তাঁকে নিয়েও বর্ণবিদ্বেষী মূলক মন্তব্য করে বসে ওই রাজনৈতিক দল।

এমন অযাচিত, জঘন্য আক্রমণ সত্ত্বেও ওজিলকে এ নিয়ে কোথাও কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে শোনা যায়নি। ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালে জোয়াকিম লো-র টিমের সেরা প্লেয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পরেও এ সব নিয়ে টুঁ শব্দ কোথাও করেননি। কিন্তু জার্মানি করল। টুঁ শব্দ নয়, সিংহগর্জন করল। কাইল নামের এক জার্মান যুবকের সঙ্গে উয়েফা ফ্যান জোনে প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলে মনে হল, ঘৃণা তাঁরা ওজিলকে নন, ওই উগ্র জার্মান রাজনৈতিক দলটাকে করেন। উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, “জার্মানিকে যত আমরা সুন্দর করতে চাইছি, যত আমরা বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আসতে চাইছি, তত এই পার্টিগুলো ঝামেলা তৈরির চেষ্টা করছে।” ইনি নিজে ক্যাথলিক। কিন্তু সব সময় চেষ্টা করেন যাতে সর্বধর্ম সম্মেলন ঘটানো যায় নিজের দেশে। তিতকুটে মেজাজে ইনি ফের বলতে থাকেন, “আসলে ওদের নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট খারাপ। তাই এ সব সস্তার প্রচার পেতে ব্যস্ত। মিডিয়াও হয়েছে তেমনই। গরমাগরম কিছু পেলেই ছাপিয়ে দিচ্ছে। কে জাতীয় সঙ্গীত গাইল না, কে জন্মসূত্রে কোথাকার, তাই নিয়ে তোদের কী?”

পাশে দাঁড়ানো কাইলের বন্ধু বাকিটুকু জুড়ে দেন যে, কে কতটা জার্মান, বোঝানোর জন্য কেউ জাতীয় দলের জার্সি পরে না। জার্মানি মনে করে, ওজিল তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এক জন। বোয়াতেং তার সেরা ডিফেন্ডার। কাইল-বন্ধুর নামটা আর জানা হয়নি। কিন্তু তাঁকেও বলতে শোনা গেল, “আমি জার্মান। আমি বলছি, অধিকাংশ জার্মানি এ সব জঘন্য মতবাদে বিশ্বাস করে না। ওজিল যদি নিজেকে চূড়ান্ত ভাবে জার্মান না ভাবত, যদি ওর দেশাত্মবোধ না থাকত, খেলত এই খেলাটা? ওর গোলটা না হলে তো আমরা অনেক আগেই হেরে যাই!”

শুনলে মনে হবে, লো-র সমালোচিত টিমে ওজিল শনিবার রাতে শুধু মোহিনী ফুটবল খেললেন না, জার্মান অ্যান্টি-ইমিগ্র্যান্ট পার্টির বিরুদ্ধে দশ সতীর্থের বদলে গোটা দেশ নিয়ে খেললেন, গোলও দিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE