রবি শাস্ত্রী পুরস্কার-প্রদান পর্বের সূচনা মাত্র চোখে সানগ্লাসটা চাপিয়ে নিলেন। কালো টিম ইন্ডিয়া টি-শার্ট আর শর্টসে প্রায় সিংহের মতো হাঁটছেন। গমগমে গলা। গরগরে ভঙ্গি। দু’টো বুম এগিয়ে গেল আর শাস্ত্রীয় নিনাদ, “ম্যাসিভ, রাইট? বাইশটা বছর কেউ পারেনি। কত বড় বড় প্লেয়ার এসেছে এর মধ্যে। আজ পার্টি হবে। কারও অনিচ্ছা দেখানো চলবে না। আমি নিজে চার্জে থাকব!”
ভারতীয় টিম ডিরেক্টরের গর্জনের ডেসিবেল শুনলে মনে হবে, পার্টির সম্পূর্ণ খরচ তাঁকে টানতে হলেও আপত্তি করতেন না। আসলে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবে সবুজের কোলে আলতো করে যে জায়ান্ট স্কোরবোর্ড বসানো আছে, ভারতীয় টিম ডিরেক্টর ভালই জানেন ওটা অসম্পূর্ণ। আবার সৌরাষ্ট্রের যে বছর সাতাশের ছেলেটা এই মাত্র পুরস্কার মঞ্চের দিকে ম্যাচের সেরার প্রাইজ নিতে গেল, সে-ও জানে যে প্রাপ্ত দর্প ভাগাভাগি হলে অভিযোগের জায়গা নেই। ওটা যেমন তাঁর, আর এক জনেরও। বিজয়ী আর বিজিতের সূক্ষ্ম ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বাদ দিলে ভারতের চেতেশ্বর পূজারা আর দ্বীপপুঞ্জের অ্যাঞ্জেলোর মধ্যে খুব ফারাক তো নেই। জীবনের ইনিংস খেলতে হলে দু’জনকেই যে টিমে ডাকতে হবে!
হেঁয়ালি বন্ধ করে তথ্যে ঢোকা যাক। বাইশ বছর পর সোনার লঙ্কার দর্পচূর্ণ হল মঙ্গলবার। কোনও এক মহম্মদ আজহারউদ্দিন যে পরিতৃপ্তির কৃতিত্ব নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে বসবাস করতেন, এ দিনের এসএসসি-উত্তর বিরাট কোহলিও এক প্রাসাদের বাসিন্দা। আজহারের মতো আজ থেকে কোহলিও দ্বীপপুঞ্জে টেস্ট সিরিজ জয়ের মালিক। শেষ টেস্ট ১১৭ রানে জিতে বহু দিন পর বিদেশের মাটি থেকে সাফল্যের হীরকদ্যূতি নিয়ে যিনি দেশের ফ্লাইট ধরবেন। শুধু একটা জিনিস বন্দরনায়েকে এয়ারপোর্টে চেক-ইন করবে না। বীরত্বের মুকুটটা করবে না। ওটা এখানেই রেখে যেতে হবে।
অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজের কাছে।
ক্রিকেট ইতিহাসে অসম্ভবের বিরুদ্ধে অমর লড়াইয়ের নির্দশন অসংখ্য আছে। চোদ্দো বছর আগে ইডেনে স্টিভ ওয়র অমিত শক্তিধর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভিভিএস লক্ষ্মণ-রাহুল দ্রাবিড়ের যুদ্ধ জয় লোকগাথা। ওয়াসিম আক্রমের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহ্য পিঠের যন্ত্রণা নিয়ে সচিন তেন্ডুলকরের সেঞ্চুরি করে যাওয়াও একই রকম অমরত্ব লাভ করেছে। জয়-পরাজয়ের স্ট্যাটসবুক কেউ মনে রাখেনি। ইনিংসগুলোকে রেখেছে। আজকের পর লঙ্কা-নৃপতির সেঞ্চুরি যদি এ দেশের ক্রিকেট-পাঠ্যে ঢুকে পড়ে, করতালিতে অভ্যর্থনা জানানো উচিত।
পিঠে তাঁর যন্ত্রণা ছিল না। কিন্তু অ্যাঞ্জেলোর টিমই তো যম-যন্ত্রণা! এগারোর প্রতিভূ হিসেবে যেখানে তাঁকে একা লড়তে হয়। একটা পার্টনারশিপের খোঁজে তাকালে অনন্ত মরুভূমি চোখে পড়ে। রেজাল্ট দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে, একা অ্যাঞ্জেলো মঙ্গলবারের এসএসসিতে ড্র নয়, অতিমানবিক জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন! ৩৮৫ রানের ভারত মহাসাগর পার করতে চেয়েছিলেন স্রেফ সাঁতরে। দু’টো সেশন বাজেয়াপ্ত করে কোহলিদের কাঁধ ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন একা। এতটাই তার প্রভাব যে, আউট হয়ে ফেরার সময় গত ক’দিনের বৈরিতা ভুলে গেল ভারত। বিরাট কোহলিদের দেখা গেল ছুটে গিয়ে অ্যাঞ্জেলোর পিঠ চাপড়ে দিতে।
বিলেতের সঙ্গে কলম্বোর একটা জায়গায় মিল আছে— হুড খোলা লাল দোতলা বাসে শহর ঘোরার ব্যবস্থায়। বিরাট কোহলিও আজ তেমন একটা বাস ভাড়া করে ইশান্ত শর্মাকে স্পেশ্যাল কলম্বো রাইড দিলে পারেন! ভারতীয় পেসারের পরিণতিবোধ নিয়ে অতীতে প্রচুর কথা হয়েছে। ধারাবাহিকতা, ফর্ম, দরকারের সময় ডুবিয়ে দেওয়ার ইতিহাস তাঁকে একটা সময় জাতীয় মিডিয়ার হাস্যরসের বিষয়বস্তু করে তুলেছিল। দিল্লি পেসার আজ প্রমাণ করে দিলেন, রণে-বনে-জঙ্গলে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো তিনিও এখন বিরাট কোহলির ভরসার কাঁধ। লর্ডসে প্রত্যাবর্তন ঘটলে, কলম্বোয় পেসার ইশান্তের পুনর্জন্ম হল। টি-সেশনের পর তৃতীয় যে বলটা অ্যাঞ্জেলো-মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটাল, সেটা কিন্তু দিল্লি পেসারের হাত থেকে বেরিয়েছে।
ভারত নিঃসন্দেহে গোটা সিরিজে তুলনায় ভাল খেলেছে। গলে দু’টো সেশন খারাপ না গেলে সিরিজ আগেই শেষ হয়ে যায়। এ দিন এসএসসিতেও খারাপ সময় এসেছিল। একটা সময় প্রয়োজনের উইকেট পড়েনি। যাবতীয় প্রচেষ্টা ম্যাথেউজ-প্রাচীরে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়েছে। প্রতিপক্ষের সেরা প্রতিরোধকে ফেরানোর অন্তত চারটে সুযোগ মাঠে গড়াগড়ি খেয়েছে। অশ্বিনকে মারাত্মক লাগেনি এবং অধিনায়ককেও বিভ্রান্ত দেখিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় নতুন বল এবং ইশান্ত শর্মা এ দিন গল-বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়নি। পাঁচ উইকেটে একশো ষাট চাই, এমন সমীকরণ ছিল এক সময়। ওভার পিছু প্রায় চার উঠছিল তখন আর কুশল পেরেরাকে রিভার্স সুইপের ‘লোভ’ দেখিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলেও অ্যাঞ্জেলো পড়ে ছিলেন। যাঁকে আর বাড়তে দেননি ইশান্ত। অশ্বিন এই ইনিংসে তাঁর চেয়ে একটা উইকেট বেশি পেতে পারেন। কিন্তু লঙ্কার সিংহাসনে বিরাট রাজাকে বসানোর কৃতিত্ব এক জনেরই, ওই দিল্লিওয়ালা।
রাতের দিকে শোনা গেল, ভারতীয় ড্রেসিংরুমে তুমুল পার্টি হয়েছে। প্রায় সন্ধে পর্যন্ত চলেছে গান। নাচ। শ্যাম্পেন। ভারতীয় টিমের সঙ্গে থাকা একজনের কাছে উৎসবের বিশদ বিবরণ জানতে চাওয়া হলে বললেন, “সব বলা যাবে না। হোয়াট হ্যাপেনস ইন ভেগাস, স্টেজ ইন ভেগাস।”
ঠিকই। উৎসবের মায়াবী আবহ দেখলে, আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ, আমলা-ডে’ভিলিয়ার্স, অনেক পরাক্রমী প্রতিপক্ষের সামনে সাফল্য-সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করবে না। এখনকার মতো ০-১ থেকে ২-১ করার নেশায় ডুবে থাকা যাক। সিরিজে ইশান্ত-অশ্বিনদের প্রতিপক্ষের ষাট উইকেট তোলার সাফল্য নিয়ে ডুবে থাকা যাক।
‘ভেগাস’ থেকে ফিরলে না হয় ও সব ভাবা যাবে।
কলম্বো টেস্টের স্কোর
ভারত
প্রথম ইনিংস ৩১২ ও দ্বিতীয় ইনিংস ২৭৪
শ্রীলঙ্কা
প্রথম ইনিংস ২০১
দ্বিতীয় ইনিংস
(আগের দিন ৬৭-৩)
সিলভা ক পূজারা বো উমেশ ২৭
ম্যাথেউজ এলবিডব্লিউ ইশান্ত ১১০
থিরিমান্নে ক লোকেশ বো অশ্বিন ১২
পেরেরা ক রোহিত বো অশ্বিন ৭০
হেরাথ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১১
কৌশল ন.আ. ১
প্রসাদ ক বিনি বো অশ্বিন ৬
প্রদীপ এলবিডব্লিউ মিশ্র ০
অতিরিক্ত ১৩
মোট ২৬৮ অল আউট
পতন: ১, ২, ২১, ৭৪, ১০৭, ২৪২, ২৪৯, ২৫৭, ২৬৩
বোলিং: ইশান্ত ১৯-৫-৩২-৩, উমেশ ১৫-৩-৬৫-২, বিনি ১৩-৩-৪৯-০, মিশ্র ১৮-১-৪৭-১, অশ্বিন ২০-২-৬৯-৪।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy