বাঙালি চল্লিশেই চালশে, এটাই বলা হয়। ৬০ বছর বয়সি প্রণব বর্ধন ও ৫৬ বছর বয়সি শিবনাথ দে সরকার হলেন মূর্তিমান ব্যতিক্রম। প্রচলিত ধারণার ছকই ভেঙে দিয়েছেন দু’জনে। সোনার ছেলে নয়, সোনার বুড়ো! এশিয়ান গেমসে ব্রিজে সোনাজয়ী দুই বাঙালি আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সেই জয়ের নেপথ্য কাহিনি।
জাকার্তা থেকে ফিরে সব কিছুই কি অচেনা ঠেকছে? এত ভালবাসা, এত অভিনন্দন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন তাস খেলা থেকে পাবেন?
শিবনাথ: একটা সোনা সত্যিই বদলে দিয়েছে জীবন। আগে বলত, ‘তাস-দাবা-পাশা, তিন কর্মনাশা।’ এখন কিন্তু ব্যাপারটা হয়ে গিয়েছে, ‘তাস-দাবা-পাশা, কর্মের আশা।’ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত তাস খেলে চাকরি পাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এই সোনা জেতার পর আশা করছি, ছবিটা পুরোপুরি বদলে যাবে। এ বার সবাই বুঝতে পারবে খেলাটা। আমরা কেমন ভাবে খেলি, তা জানবে। পরিবর্তন হবেই। লোকে জানতে চাইছে, এটা কী করে খেলা হচ্ছে, নেটেই বা কী করে খেলা যায়।
প্রণব: তা ঠিক। বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। একটা সোনাই পাল্টে দিয়েছে। আগে যাঁরা খোঁজখবরও নিতেন না, তাঁরাও আসছেন বাড়িতে। তবে আমি নিজেকে বদলাতে চাই না। যেমন আছি, তেমনই থাকতে চাই।
কাল হয়তো বাজারে গিয়ে দেখলেন মাছওয়ালা দামই নিল না!
প্রণব (হেসে): দেখুন, সোনা জেতার একটা তৃপ্তি তো রয়েইছে। কিন্তু, এর জন্য আমার কোনও অহমিকা হবে না। নিজেকে বদলাবও না। সবাই জানছে, অভিনন্দন জানাচ্ছে, এটা স্বস্তির তো বটেই। এই প্রচার আমাদের ব্রিজের জন্যও ভাল। আমরা সফল হয়েছি, সোনা জিতে দেখাতে পেরেছি বলেই তো সবাই আমাদের কথা শুনতে চাইছে।
তাস খেলতে শুরু করার পর নিশ্চয়ই নানা আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে।
শিবনাথ: সেগুলো তো প্রচুর শুনতে হয়েছে। বলা হত, অকর্মার ঢেঁকি, কিছু করে না, তাস খেলে বেড়ায়। জুয়া খেলি বলেও প্রচার হয়েছে। খারাপ তো লাগতই। তবে একটা পর্যায়ের পর আমরা এটা কাটিয়ে উঠেছি। ২০০৫ সালের পর আমরা সাফল্য পেতে শুরু করি। এমনিতে বাড়ির লোকের সমর্থন সব সময় ছিল। সেটা নিয়ে সমস্যা হয়নি। মায়ের সমর্থন ছাড়া তো হতই না। বাবা-মায়ের তরফ থেকে কখনও মুশকিলে পড়তে হয়নি। ওঁরা কখনও বলেননি যে, তাস খেলো না। বরং হারলে মা কষ্ট পেতেন।

সাফল্যের হাসি। এশিয়ান গেমসে ব্রিজে সোনা জেতার পর প্রণব-শিবনাথ। ছবি: পিটিআই।
বাড়িতে কখনও রাগারাগি বা মনোমালিন্য হয়নি?
শিবনাথ: না, না। তাস খেলা নিয়ে বাড়িতে কখনও অঘটন কিছু ঘটেনি। এটা আমার সৌভাগ্য। বরং পাড়া-প্রতিবেশী বা অন্য জায়গা থেকে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু, বাড়িতে সমর্থনই পেয়েছি। তার জন্যই খেলে যেতে পেরেছি। সমস্ত রকম প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।
প্রণব: পরিবারের দিক দিয়ে আমারও কখনও সমস্যা হয়নি। বাড়িতে এর চল ছিল। বাবা, মা পাশে ছিল শুরুতে। পরবর্তীকালে আমার স্ত্রী, মেয়ে, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, সবাই উত্সাহ দিয়েছে।
পাড়াপ্রতিবেশীরা কেমন রিঅ্যাক্ট করতেন?
শিবনাথ: এই ধরুন বসে রয়েছি পাড়ায়। তাস নিয়েই গল্প হত। আমরা তো বিনা তাসেও ব্রিজ খেলি। তা তখন অনেকেই ভাবত, আমরা হয়তো জুয়া খেলছি। জুয়া নিয়ে আলোচনা করছি। খোঁচা দিয়ে বলা হত, এদের কি কোনও কাজ নেই নাকি? সারা দিন রকে বসে রয়েছে! লোকে হেনস্থার দৃষ্টিতে দেখত।
নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হতেন?
শিবনাথ: না, সেটাকে আমরা পার করে এসেছিলাম। যখন বুঝতাম যে এদের বলে লাভ নেই, এরা অবুঝ। কিছু জানে না, তখন পাত্তা না দেওয়াই ভাল নয় কি! আমি কি পাগল নাকি যে ঝগড়া করে বোঝাতে যাব? এই যে সোনা পেলাম, এটাই প্রমাণ হয়ে থাকল!
আরও পড়ুন : দল হারলেও নতুন রেকর্ড করলেন ক্যাপ্টেন কোহালি
আরও পড়ুন : কেন পারলেন না কোহালিরা, দেখুন বিরাটদের হারের কিছু কারণ
প্রণববাবু, আপনাকে তো পাসপোর্ট অফিসে জুয়া খেলতে যাচ্ছেন কি না, সেই প্রশ্নের সামনেও পড়তে হয়েছে!
প্রণব: কষ্ট হত খুব। মানতে পারতাম না। আমার যেটা ভালবাসার জায়গা, সেটা নিয়ে কেউ উল্টোপাল্টা বললে খারাপ তো লাগবেই। কিন্তু পাল্টা কিছু বলতে পারতাম না। ভদ্রতায় বাধত। আবার ভালবাসার জায়গাকে নিয়ে বাজে কথা সহ্য করতেও যন্ত্রণা হত। আর জুয়ার কথা যদি ওঠে, তবে বলুন তো পৃথিবীতে কোন খেলা নিয়ে জুয়া হয় না? ফুটবল, ক্রিকেট, বক্সিং, হকি, সব খেলাতেই তো হয়। সেই দৃষ্টিকোণে সব খেলা নিয়েই তো জুয়া হয়। জুয়া তো খেললেই খেলা যায়। কিন্তু যে খেলছে, সেটা তার ব্যাপার। আমি তো সেটার মধ্যে নেই। আমি তো নিষ্ঠা নিয়ে, প্রাণ ভরে ভালবেসে এটা নিয়ে সাধনা করছি। আমার দর্শন আর অন্যের দর্শন তো এক হবে না!
কাউকে কি কখনও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ব্রিজ আসলে লজিকের খেলা।
প্রণব: দেখুন, যাঁর মনের মধ্যে এই রকম বদ্ধমূল ধারণা, সে তো বুঝতে চাইবেই না। আর সে যদি আমার সঙ্গে আলোচনা করে বা করতে চায়, তবেই বোঝানোর প্রশ্ন ওঠে। আপনি যদি আলোচনা করেন, তবে আমার বক্তব্য জানাতে পারি। কিন্তু, আপনার অধিকার আছে, আপনি বলে চলে গেলেন, তা হলে কিছু করার থাকে না। আমার পক্ষে কি জনে জনে ডেকে বলা সম্ভব যে, ‘ও দাদা, শুনে যান, শুনে যান।’ সেটা তো সম্ভব নয়। আপনার বক্তব্য আপনি বললেন। এ বার আমার বক্তব্য আমি বলব। সেটা শুনতে হবে। তার পর সেটা বিশ্লেষণ যে যাঁর মতো করে করবেন। এটা তো আসলে ব্রেন গেম। মস্তিষ্কের খেলা। নিজেকে সুস্থ রেখে, মাথা সুস্থির রেখে যে প্রয়োগ করতে পারবে নিজেকে, জয় তারই হবে।
তার মানে ফেলুদার মতো এটাও মগজাস্ত্রের লড়াই?
প্রণব: একেবারেই। এটা পুরোপুরি মগজাস্ত্রের লড়়াই। অসম্ভব ধৈর্য লাগে। মগজটাকে খুব ঠান্ডা রাখতে হয়। এবং, খুব ঠান্ডা ভাবে খেলতে হয়।
যাঁরা সমালোচনা করতেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া এখন কী?
শিবনাথ: তারাই এখন মাথায় তুলে নাচছে। সবচেয়ে বেশি দেখছি তারাই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এখন বলছে সোনার ছেলে, গর্বের ছেলে, এই ছেলে, ওই ছেলে। আমি শুনে যাচ্ছি!
আরও পড়ুন : জল-দানবের প্রবল তাণ্ডব কেম্পটি জলপ্রপাতে, দেখুন ভিডিয়ো
আরও পড়ুন : এই বলি নায়িকার সঙ্গে প্রেম করছেন রবি শাস্ত্রী?
অকর্মার ঢেঁকি থেকে সোনার ছেলে! নিশ্চয়ই মনে মনে খুব হাসছেন।
শিবনাথ: (হেসে) এখন সত্যিই আমি তৃপ্ত। আমার যে পুরনো বন্ধুবান্ধব, তারা ঠিকঠাকই রয়েছে। এরাই শুধু নাচানাচি করছে আচমকা। একটা কথা না বললেই নয়। আমায় যিনি চাকরি দিয়েছিলেন, সেই সি ভি রাও এক জন ব্রিজ-প্রেমিক। হায়দরাবাদে আমার অফিস। কিন্তু আমায় অফিস করতে হয় না। আমি সালকিয়াতেই থাকি। শুধু তাস খেলতে যেতে হয়। এমনও নয় যে শুধু ওদের হয়েই খেলতে হবে। আমাকে শুধু তাস খেলার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে।
স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে আপনারা সফল। এটা কতটা কঠিন?
প্রণব: অবশ্যই কঠিন। আসলে ব্রিজেও অনেক ভাবনাচিন্তা রয়েছে। সেগুলোকে সংহত করে একদম মাথা ঠান্ডা রেখে এগনো দরকার। না পারলে পরাজয় নিশ্চিত। লোকের কথায় কান দিলে তাই চলত না।

পারিবারিক প্রণব বর্ধন। নাতি অগস্ত্যের সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র।
আপনারা দু’জনে তো প্রায় দুই দশক ধরে একসঙ্গে খেলছেন। ব্রিজে তো নিজের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গীর ভাবনাও মিলতে হয়। আবার দু’জনে মিলে ধরতে হয় বিপক্ষের ভাবনা। নিজেদের মধ্যে কথা না বলেই এটা করতে হয়। কতটা কঠিন?
শিবনাথ: দেখুন, সমমনস্কতা দরকার। জুটি মানেই মানসিকতার দিক দিয়ে এক রকম হতে হয়। ওর ভাবনা আমি যদি ভাবতে না পারি, আমার ভাবনা যদি ও ভাবতে না পারে, তা হলে চলবে না। এই ভাবনা বোঝাটাই আসল। এটা দীর্ঘকালীন পরিশ্রমের ফল।
ব্রিজে তো দুটো ভিন্ন ভাবনার স্রোত উপলব্ধি করতে হয়। একটা সঙ্গীর, অন্যটা প্রতিপক্ষের।
প্রণব: ঠিকই। বিপক্ষ আমাকে পাজলড করার চেষ্টা করবে। আমাকে সেটা ভাঙতে হবে। আমার পাল্টা আমিও পাজলড করার চেষ্টা করব প্রতিপক্ষকে। এই রিভার্স কাজটা করতে হবে। নিজেদের কাজে সফল হয়েছি বলেই আমরা সোনা পেয়েছি।
শিবনাথ: আমি একটা কথা বলি? আমি বাইরে গিয়ে দেখলাম ব্রিজ নিয়ে বিদেশে প্রচণ্ড বেশি চর্চা। চিন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ায় ব্রিজ জাতীয় ক্রীড়ার মতোই। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো খেলে চলেছে। আট থেকে কুড়ি বছর বয়সিরা সবসময় খেলছে। আমরা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছিলাম, তাদের গড় বয়স ত্রিশ। তারা স্কুল পর্যায় থেকে খেলে আসছে এশিয়ান গেমসে। একটু যদি ব্রিজ প্রচার পায়, তা হলে এখানেও এটা হতে পারে।
এশিয়াডে কোথাও কি নিজেদের বেমানান ঠেকছিল? উল্টো দিকে কমবয়সীরা। আর এ দিকে আপনারা দুই প্রবীণ।
প্রণব: দেখুন, ওরা অনেক প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। তারুণ্য বনাম প্রবীণের লড়াই নিঃসন্দেহ অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু, আমরাও ভেঙে পড়িনি। নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক ছিলাম। তার জন্যই লড়াইয়ে আমারা জিতেছি। সোনা পেয়েছি।
আরও পড়ুন : ধারাবাহিক ব্যর্থতা, পঞ্চম টেস্ট থেকে বাদ পড়তে পারেন এই চার ক্রিকেটার
আরও পড়ুন : বারুদের গন্ধ থেকে ডার্বির সল্টলেক, স্বপ্ন সফর জঙ্গলমহলের পিন্টুর
(অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস হোক কিংবা ফুটবল বিশ্বকাপ, ক্রিকেট বিশ্বকাপ - বিশ্ব ক্রীড়ার মেগা ইভেন্টের সব খবর আমাদের খেলা বিভাগে।)