ফোনটা করে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন দীপা কর্মকার। ফোঁপানো কান্নার মধ্যে অস্ফুট স্বগোতক্তি, ‘‘পারলাম না মা। পারলাম না দেশকে পদক দিতে।’’
স্বাধীনতা দিবসের ভোর। আগরতলার উজান অভয়নগরের মোড়ে দেশাত্মবোধক গান বাজছে তখন। নিজের অফিসের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন দুলাল কর্মকার। ঠিক তখন রিওর ফোনটা আসে স্ত্রী গৌরীদেবীর কাছে।
মা, পারলাম না। নিজের সেরা দিলাম। তবু পারলাম না।
সন্তান কাঁদলে জন্মদাত্রীর আবেগহীন থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। গৌরী কর্মকারও পারেননি সামলাতে। হাতের মোবাইল স্ক্রিন দুঃখটাকে যে আবার নাড়াচাড়া করে নতুন করে দেয়। আসলে দীপার ছবি মোবাইল স্ক্রিনে। হাসিখুশি মুখ। হাতে কমনওয়েলথ পদক। চোখের জল সামলাতে সময় লাগে। বহুক্ষণ পর গৌরীদেবী শেষ পর্যন্ত মেয়েকে বলতে পেরেছিলেন, ‘‘জানি, তুই সেরাটা দিয়েছিস। কিন্তু পদকটা সব নয়। মনে রাখবি, তোর পারফরম্যান্সে ত্রিপুরা তো বটেই, গোটা ভারত গর্বিত।’’
কর্মকার বাড়িতে দীপা কর্মকারের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা মজার জিনিস শোনা গেল। ভারতের সোনার মেয়ে নাকি ভেবেছিলেন, কাগজে-টাগজে নিশ্চয়ই তাঁকে নিয়ে যা-তা লেখা হয়েছে! এত কাছে এসেও পদক দিতে পারেননি দেশকে, তাই। ‘‘শুনে বললাম, চিন্তা করিস না। কেউ খারাপ লেখেনি তোকে নিয়ে। সবাই তোকে নিয়ে গর্বিত।’’
গর্বিত বললেও বোধহয় কম বলা হয়। অমিতাভ বচ্চন থেকে আগরতলা বাজারের সবজি বিক্রেতা— সেলেব্রিটির মেহফিল থেকে টানাটানির সংসার, সবার কাছেই তো দীপা কর্মকার এখন স্বপ্নের নাম। দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় দুঃখ, অপ্রাপ্তি ভুলে থাকার বিষল্যকরণী। আগরতলা বাজারের ওই সবজি বিক্রেতা শোনা গেল, দীপাকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা ভাবছেন। নিজেদের ছোটাখাটো একটা অ্যাসোসিয়েশন আছে। তাদের পক্ষ থেকে যতটা সম্ভব, করা হবে হাসিখুশি মেয়েটার জন্য। আর সংবর্ধনা-পর্ব মোটেও তাতে শেষ হচ্ছে না। দীপার বাড়ি ফেরার কথা ২২ অগস্ট। যা শোনা গেল, তাতে বিমানবন্দর থেকে হুডখোলা গাড়িতে নিয়ে আসা হবে দীপাকে। রাস্তায় চলবে ফুল-বৃষ্টি, যে কোনও দিকে তাকালে দীপা দেখতে পাবেন তাঁরই প্রমাণ সাইজের সব কাটআউট। অন্তত দশ হাজার লোকের ভিড় জমার খবর আছে সে দিন। বাড়ির সামনে চলে এলে একটা চমকও থাকবে দীপার জন্য।
লাল কার্পেট।
‘‘রেড কার্পেট বিছিয়েই ঘরে আনা উচিত মেয়েকে। ও যে দেশের জিমন্যাস্টিক্সে কী করে গেল, বোঝানো তো দরকার ওকে,’’ বলতে শোনা গেল দীপার প্রথম কোচ সোমা নন্দীকে। ‘‘ম্যাটে ছোঁয়া লেগেও চতুর্থ। ভাবুন তো, ওটা না হলে কী হত? মনে রাখবেন, মেয়েটা শেষ তিন মাস ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়েছে। বিদেশি সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পেরেছে মাত্র দু’মাস,’’ বলে যান সোমা। কর্মকার-বাড়ির আবার চিন্তা অন্য। গৌরীদেবী মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন যে, ২২ অগস্ট যা সংবর্ধনা হওয়ার হবে। তার পর আবার ৩০ অগস্টের পরে। ফেরার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দীপাকে তো বসতে হচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরীক্ষায়। এমএ করছেন তিনি। ‘‘ওই আট দিন একেবারে সবার নো এন্ট্রি। টিনার পরীক্ষায় পাশ করাটা খুব জরুরি।’’
ভাল। বোঝা গেল। কিন্তু সম্ভব তো? নায়িকা-বরণ নিয়ে ত্রিপুরাবাসীর আগাম যে আকুতি দেখা গেল গোটা দিন, সংর্বধনার যে বহর শোনা গেল, যে ভাবে তৈরি হচ্ছে দীপার ভক্তকুল, তার পর কর্মকার-পরিবারের ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ বোর্ড টিকবে তো?
জেদ আর সংকল্পে ভক্তকুলের এক-একজনকে তো সিমোন বাইলসই মনে হচ্ছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy