Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Sports

একান্ত আলাপচারিতায় সচিন: অমর মারাদোনার জাদু, অস্ট্রেলিয়ায় বড় রান তুলতে হবে

সচিন তেন্ডুলকর আসন্ন টেস্ট সিরিজ নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ শোনালেন। বুধবার দুপুরে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলেন কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাকেও...

সচিন তেন্ডুলকর। ফাইল চিত্র।

সচিন তেন্ডুলকর। ফাইল চিত্র।

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ ১৫:০৭
Share: Save:

মহারণ আসছে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চার টেস্টের সিরিজ। প্রথম টেস্টের পরে বিরাট কোহালির ফিরে আসা। স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারদের (প্রথম টেস্টে যদিও ওয়ার্নার নেই) উপস্থিতিতে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া। সব মিলিয়ে অগ্নিপরীক্ষার জন্য কতটা তৈরি ভারত? ক্রিকেটজীবনে বরাবর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেরা পারফরম্যান্স করা সচিন তেন্ডুলকর আসন্ন টেস্ট সিরিজ নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ শোনালেন। বুধবার দুপুরে আনন্দবাজারের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলেন কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাকেও...

প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট শুরু হচ্ছে অ্যাডিলেডে দিনরাতের অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে। ভারতীয় দলের সামনে ঠিক কী রকম প্রশ্নপত্র থাকতে পারে?

সচিন: অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে খেলাটা সব সময়ই বড় পরীক্ষা। সে দিক দিয়ে নতুন তো কিছু নয়। ক্রিকেটীয় এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকা উচিত। এ বারের নতুনত্ব হচ্ছে, প্রথমেই দিনরাতের টেস্ট। তার জন্য তৈরি থাকা দরকার। গোলাপি বলে খেলার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলো হতে পারে, সে দিকে নজর রাখা দরকার। আমার মনে আছে, ইডেনে ভারত যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক দিনরাতের টেস্ট খেলল, বিরাটের সঙ্গে কথা হয়েছিল। আমি ওকে বলেছিলাম, ডিক্লেয়ার করার বিষয়টা দিনরাতের টেস্টের মতো করে ভেবো। যেমন, আমার টেলএন্ডারেরা ব্যাট করছে, অথচ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠবে। তখন বাড়তি ২০-৩০ রান যোগ করার কথা ভাবব না কি ডিক্লেয়ার করে দিয়ে প্রতিপক্ষকে ওই সময়টাতেই ব্যাট করতে এগিয়ে দেব? একটু গভীরে গিয়ে যদি ভেবে রাখা যায়...

প্রশ্ন: মাত্র একটা দিনরাতের টেস্ট খেলেছে ভারত। অভিজ্ঞতার দিক থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে তারা?

সচিন: না খেললে তো অভিজ্ঞতা কখনওই হবে না। দিনরাতের টেস্ট আগে যতই খেলা থাকতে পারে, ঘটনা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়াতে এটা আমাদের দলের প্রথম দিনরাতের টেস্ট হতে যাচ্ছে। একটা জিনিস কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দল বহু দিন টেস্ট ক্রিকেট খেলেনি। খুব সম্ভবত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে আমরা শেষ টেস্ট খেলেছি নিউজ়িল্যান্ডে। আমার মতে, দিনের টেস্ট দিয়ে সিরিজটা শুরু হলে হয়তো দলের পক্ষে ভাল হত। পরে হতো চতুর্থ টেস্টটা গোলাপি বলে খেললাম। তাতে কী হত, এত দিনের টেস্ট ক্রিকেট না খেলার খামতিটা পুষিয়ে মাঠে নেমে সড়গড় হয়ে তার পরে গোলাপি বলে খেলা যেত। পাশাপাশি, এটা বলতে চাই যে, আমি নিশ্চিত, দলের সকলে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়েই অ্যাডিলেডে নামবে।

প্রশ্ন: কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার বলে আপনি মনে করেন?

সচিন: আশা করব, ওরা হোমওয়ার্কটা ঠিকঠাক করেছে। দিনরাতের ম্যাচে কী করা যায়, কী করা যায় না, সেটা ভেবে রেখেছে। দিনরাতের টেস্টের বিভিন্ন সময়ে কী ধরনের রণনীতি নিতে হবে, সেটা বোঝা দরকার। প্রত্যেকটা সেশন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবং, খেয়াল রাখতে হবে প্রত্যেক সেশনে পরিবেশ, পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। সেই অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।

প্রশ্ন: আপনি নিজে ক্রিকেটজীবনে প্রস্তুতির উপরে এত জোর দিতেন। দিনরাতের টেস্টের জন্য ব্যাটসম্যানের কাছে আদর্শ প্রস্তুতি কী হতে পারে?

সচিন: প্রস্তুতির দিক থেকে দিনের টেস্টের চেয়ে যেটা একমাত্র অন্য রকম বলে আমার মনে হয়, তা হচ্ছে, সন্ধ্যাবেলায় গোলাপি বলে প্র্যাক্টিস করা। দিনের টেস্টে তো আর সন্ধ্যার সময় খেলতে হয় না। দিনরাতের ম্যাচে সেটা করতে হবে। যখন অন্ধকার হয়ে আসছে, প্রকৃতির আলো থেকে কৃত্রিম আলোতে ঢুকে পড়ছে খেলা, সেই সময়টার জন্য ব্যাটসম্যানদের আলাদা প্রস্তুতির কথাই আমি বলব। এ ছাড়া বাকি কোনও কিছু দিনেরবেলার টেস্টের চেয়ে পাল্টাতে যাওয়ার দরকার নেই। দিনরাতের টেস্টে ব্যাটসম্যানের দু’টো জিনিসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। কৃত্রিম আলো এবং বলের গোলাপি রং।

প্রশ্ন: টেস্টের মহারণ বলা হচ্ছিল আসন্ন সিরিজকে। যুযুধান দুই দল, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া কতটা শক্তিশালী, জানতে চাইব। আগের সফরে স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার ছিলেন না। বল-বিকৃতি কাণ্ডে নির্বাসনের সাজা কাটছিলেন। এ বারে কিন্তু ওঁরা দু’জনেই থাকছেন।

সচিন: দু’টো দলেই দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। আমার মতে, খুবই ‘ওপেন’ সিরিজ। যে কেউ জিততে পারে। দু’টো দলেরই খুব ভাল ব্যাটিং রয়েছে, দারুণ বোলিং আক্রমণ রয়েছে। ভাল লড়াই হবে, সিরিজের ভাগ্য যে কোনও দিকে যেতে পারে।

প্রশ্ন: ভারতের নতুন শক্তির বোলিং আক্রমণ কি বিদেশে ভাল ফলের জন্য বেশি আশাবাদী করে তুলতে পারে?

সচিন: আমি তুলনা পছন্দ করি না। তাই অন্য কোনও যুগ বা প্রজন্মের সঙ্গে তুলনায় যাব না। কেউ কেউ বলছে ঠিকই, এটাই না কি ভারতের সর্বকালের সেরা পেস বোলিং আক্রমণ। আমি বলব, তুলনা টানাটা না হয় থাক। বর্তমান দলের বোলিং আক্রমণকে বর্তমান প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের নিরিখেই বিচার করা সম্ভব। ওরা যাদের বিরুদ্ধে বল করেছে বা করছে। তাই সর্বকালের বা সব প্রজন্মের বিচারে তুলনা করায় আমি বিশ্বাসী নই। তবে আমি বলব, ভারতের হাতে এখন খুব সম্পূর্ণ একটা বোলিং আক্রমণ আছে। এই দলে এমন পেসার আছে, যারা সুইং করাতে পারে, যারা এক্সপ্রেস গতিতে বল করতে পারে, বাউন্স আদায় করতে পারে। রিস্ট স্পিনার (যাঁরা কব্জির মোচড়ে স্পিন করান, যেমন কুলদীপ যাদব) যেমন আছে, তেমনই আছে ফিঙ্গার স্পিনার (যাঁরা আঙুলের সাহায্যে স্পিন করান, যেমন অশ্বিন)। সব ধরনের হাতিয়ার রয়েছে। এই বোলিং আক্রমণ যে কোনও দেশে, যে কোনও পরিবেশে সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখে।

প্রশ্ন: স্বর্ণযুগের অস্ট্রেলিয়া দলকে শাসন করেছেন আপনি। অস্ট্রেলিয়ায় সফল হওয়ার টোটকা কী?

সচিন: আমার মনে হয়, অস্ট্রেলিয়ায় জিততে গেলে স্কোরবোর্ডে বড় রান তুলতে হবে। লক্ষ্য করে দেখবেন, আমরা যখনই ওখানে সফল হয়েছি, প্রধান কারণ ছিল আমরা বড় স্কোর তুলতে পেরেছিলাম। যার ফলে ওদের উপরেও চাপ তৈরি করা গিয়েছিল। যখন আমরা সেটা পারিনি, ফলটাও আমাদের পক্ষে যায়নি। তাই এটা নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই যে, অস্ট্রেলিয়াকে চাপে ফেলতে গেলে বোর্ডে বড় রান চাই। আর শুধু অস্ট্রেলিয়াই বা বলছি কেন, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে এটাই তো প্রধান শর্ত। আমি জানি, ক্রিকেটের বহু পুরনো কথা— ম্যাচ জিততে গেলে কুড়িটা উইকেট নিতে হয়। কিন্তু ওই কুড়িটা উইকেট নিতে গেলে বোর্ডে রানটাও দরকার। না হলে বোলাররা কী নিয়ে লড়াই করবে? তাই আমার মনে, বড় রান করা এবং উইকেট তোলা, দু’টোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে ব্যাট করলে ব়ড় রান তুলতে হবে। প্রথমে বল করলে প্রতিপক্ষকে তিনশোর মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু তিনশোর মধ্যে রাখলেও কিন্তু ব্যাট করতে এসে বড় রান তুলতে হবে।

প্রশ্ন: আপনাদের প্রজন্মের ভারতীয় দল যখন ব্রিসবেন, অ্যাডিলেড বা সিডনিতে বড় রান তুলেছে, চাপে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া। রেকর্ডই বলছে...

সচিন: একদমই তাই। অনেক সময় এমন হয়েছে, আমি রান করেছি। কিন্তু টিম বড় রান তোলেনি। ম্যাচ ধরে রাখা যায়নি। আবার অস্ট্রেলিয়াও অনেক সময় প্রথমে ব্যাট করে বড় রান করেছে। তখন আমরা চাপে থেকেছি। তাই আমার মনে হয়, অস্ট্রেলিয়ায় যারা বড় রান তুলতে পারবে, তারা প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারবে।

প্রশ্ন: বিরাট কোহালি ফিরে আসছেন প্রথম টেস্টের পরেই। এর কী প্রভাব পড়তে পারে ভারতীয় দলে? কতটা তফাত হতে পারে টেস্ট সিরিজে?

সচিন: বিরাটের মতো অভিজ্ঞ, উচ্চ মানের ক্রিকেটার না থাকাটা বড় ক্ষতি তো বটেই। যে কি না অস্ট্রেলিয়ায় এত খেলেছে, রান করেছে, ওখানকার পরিবেশ সম্পর্কে খুব ভাল জানে। আবার বলছি, বিরাটের না থাকাটা বড় ক্ষতি কিন্তু একই সঙ্গে এ ভাবেও তো ভাবা যায় যে, সিরিজ চলতে চলতে চোট পেয়ে কেউ সিরিজের বাইরে চলে যেতে পারত। বিরাটের ফিরে আসাটা পরিকল্পনা করে হচ্ছে। অনেক আগে থেকে তা জানার সুযোগ রয়েছে। চোট পেয়ে কেউ বাইরে চলে গেলে সেটা পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটে না। বিরাটের প্রথম টেস্টের পরে চলে আসাটা নিঃসন্দেহে শূন্যতা তৈরি করবে কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলতে চাই, ভারতীয় ক্রিকেটের বেঞ্চ শক্তিও এখন অনেক বেশি। তাই কারও অনুপস্থিতি অন্য কোনও নতুন মুখের জন্য একটা সুযোগও। সে হয়তো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের হয়ে জ্বলে উঠবে। হ্যাঁ, আমাদের এক জন প্রধান ক্রিকেটার হয়তো থাকছে না কিন্তু ক্রিকেট খেলাটা তো দলগত। সেটাও মনে রাখা দরকার।

প্রশ্ন: দিয়েগো মারাদোনার প্রয়াণে সারা বিশ্বে শোকযাপন চলছে। মারাদোনার প্রভাব কতটা ছিল আপনার উপরে?

সচিন: যে কোনও খেলাতেই এমন কিছু প্রতিভা আসেন, যাঁরা এমন এক উচ্চতায় তাঁদের খেলাকে নিয়ে যান যে, আশেপাশের সকলে তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়। দিয়েগো মারাদোনা ছিলেন সে রকমই এক জন শিল্পী। ওঁর এনার্জি দেখে আমি সব চেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। সংক্রমণের মতো তা ছড়িয়ে পড়ত সকলের মধ্যে। শুধু আমি বা আমাদের প্রজন্ম নয়, একাধিক প্রজন্মের উপরে সেই আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন উনি। নিছক এক জন ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে বলতে পারি, যখন এমন কোনও জাদুকর তাঁর শৈলী বা নৈপুণ্য দেখান, তার চেয়ে মনোরম দৃশ্য আর কিছু হয় না! দিয়েগো মারাদোনা শান্তিতে ঘুমোন, সারা বিশ্বের কাছে আপনার জাদুটা থেকেই যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE