প্রশংসা: কোহালির দলের ভারসাম্যে মুগ্ধ সনৎ জয়সূর্য। —ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: ক্রিকেটকে মিস করেন?
সনৎ জয়সূর্য (হাসি): অবশ্যই ক্রিকেটকে মিস করি। এখনও করি। ছোটবেলা থেকে নেশার মতো একটা জিনিস নিয়ে পড়ে থেকেছি। স্কুলে পড়ার সময় থেকে। সেই জিনিসটা জীবন থেকে চলে গেলে মিস তো করবই। তবে এটাই জীবন, তাই না?
প্র: কেরিয়ারের দিকে পিছন ফিরে তাকালে কী মনে হয়? সেরা প্রাপ্তি হিসেবে কোন জিনিসটাকে বাছবেন?
জয়সূর্য: কুড়ি বছরের উপর খেলেছি খুব আবেগ নিয়ে। খুব কঠিন লড়াইও লড়তে হয়েছে। আমার বাড়ি ছিল মাতারায়। সেখান থেকে কলম্বোয় এসে ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠা। নিজের বাড়িঘর ছেড়ে এখানে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করে থাকা। জীবন এক দিনের জন্যও সহজ ছিল না। পিছন ফিরে তাকালে সেটা দেখেই সব চেয়ে ভাল লাগে যে, এই লড়াইটা আমি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলাম। রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে যাইনি। জীবনযুদ্ধে জিতে ক্রিকেট মাঠে সাফল্য পাওয়াটাই সেরা প্রাপ্তি।
প্র: প্রায় ২২ বছরের কেরিয়ার। এত দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের রহস্য কী?
জয়সূর্য: দেশের হয়ে খেলব, এটাই ছিল সব চেয়ে বড় মোটিভেশন। এটাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে গিয়েছে। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে বলে গিয়েছি, স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে নিরন্তর পরিশ্রম করে যেতে হবে। এক দিনের জন্য কখনও ফাঁকি দিইনি। দীর্ঘ কেরিয়ারের রহস্য এটাই।
প্র: তা হলে নিজের কেরিয়ার নিয়ে আপনি খুশিই? কোনও আক্ষেপ নেই।
জয়সূর্য: মোটামুটি ভাবে আমি তৃপ্ত। তবে এটাও মনে হয় যে, হয়তো আরও ভাল করতে পারতাম। নিজের দেশকে গর্বিত করার জন্য সেরাটা দিয়ে গিয়েছি। সেটা আমাকে তৃপ্তি দেয়। আবার মনে হয়, আমি খুব খুশি হওয়ার মতো কিছু করেছি কি? মাঝামাঝি কোনও একটা অবস্থায় আছি। আমি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মাঝামাঝি অবস্থানটাই আমাদের জন্য ঠিক। খুব খুশি নয়, খুব হতাশ নয়।
প্র: শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট কতটা সনৎ জয়সূর্যের মতো কাউকে মিস করছে?
জয়সূর্য: বড় কেউ চলে গেলে তাকে মিস করবেই সে দেশের টিম। মুথাইয়া মুরলীধরন, মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমার সঙ্গকারা, অরবিন্দ ডি’সিলভা, অর্জুন রণতুঙ্গা বা সনৎ জয়সূর্য। এরা প্রত্যেকে বিশেষ দক্ষতার ক্রিকেটার। এদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের সমান কাউকে চট করে পাওয়া কঠিন। কিন্তু তার পরেও তো এগিয়ে যেতে হবে। ভারতেই তো কত ভাল ভাল প্লেয়ার পর-পর চলে গিয়েছে। গাওস্কর, শাস্ত্রী, বেঙ্গসরকর। তার পর তেন্ডুলকর, সৌরভ, কুম্বলে-রা এসেছে, আবার চলেও গিয়েছে। কিংবদন্তি আসবে, চলেও যাবে।
আরও পড়ুন: চোট, সিরিজ থেকে ছিটকে গেলেন শ্রীলঙ্কার প্রদীপ
প্র: এখনকার শ্রীলঙ্কা টিমের জন্য আপনার উপদেশ কী?
জয়সূর্য: আমি এখনকার ক্রিকেটারদের উদ্দেশে বলতে চাই, শুধু কিংবদন্তির সিংহাসনটাই দেখো না। কী করে ওরা কিংবদন্তি হল, সেটাও খুঁজে দেখো। কিংবদন্তি হয়ে কেউ খেলতে আসে না। এটা একটা পদ্ধতি। এক জন খেলোয়াড় প্রতিভাধর হিসেবে আসতে পারে। ভাল খেলোয়াড় থেকে সে এর পর খুব ভাল খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। বহু লড়াই করে, বহু ম্যাচ জিতিয়ে তবেই সে কিংবদন্তি হয়।
প্র: নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের থেকে কী প্রত্যাশা করছেন?
জয়সূর্য: আমি একটাই জিনিস চাই ওদের কাছ থেকে। ওরা যেন শিখতে চায়। ভুল সকলেই করে। আমরাও করেছি। কিন্তু ভুল থেকে দ্রুত শিক্ষাও নিয়েছি। সেই কারণেই সফল হয়েছি।
প্র: শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের জন্য এটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়?
জয়সূর্য: ইয়েস। আমি তো বলব, আমাদের ক্রিকেটের জন্য খুব কঠিন, এসপার-ওসপার হওয়ার সময়। সকলের জন্য। নির্বাচকদের জন্য। ক্রিকেট ভক্তদের জন্য। শ্রীলঙ্কা টিমের জন্য। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা সেই ধৈর্য দেখাতে রাজি আছি। কিন্তু ক্রিকেটারদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নেওয়া মানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই তাই। যারা চাপ নিতে পারবে, তারাই টিকবে। না পারলে হারিয়ে যাবে।
প্র: আপনার কোনও বিশেষ টোটকা আছে, কী ভাবে চাপ সামলে সফল হওয়া যায়?
জয়সূর্য: এর মধ্যে কোনও রকেট সায়েন্স নেই। পুরোটাই নির্ভর করে মানসিক ভাবে কে কতটা শক্তিশালী, তার উপর। কুড়ি বছরের ক্রিকেটজীবনে আমি অনেক বার কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে তখন ভাবতে হয়েছে, কী ভাবে এই অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পারব? আর কত দ্রুত বেরনো যায়? এটাই পদ্ধতি। সকলের ক্ষেত্রেই এক।
প্র: শোনা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে যথেষ্ট প্রতিভা নাকি আসছে না। এটা কি সত্যি? নির্বাচকদের প্রধান হিসেবে আপনি কি চিন্তিত?
জয়সূর্য: আমি চিন্তিত নই। আমি চাই আমাদের ক্রিকেটাররা সঠিক মানসিকতা দেখাক। যেটা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হোম সিরিজে দেখিয়েছিল। আমরা এক নম্বর টিমকে আমাদের দেশে ৩-০ হোয়াইটওয়াশ করেছি। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে খেত্তরামায় (এখন নাম প্রেমদাসা) পঞ্চম দিনে ৩৮৮ তাড়া করে টেস্ট জিতলাম। তার মানে আমরা পারি। প্রতিভা আছে। নিজেদের দক্ষতায় বিশ্বাস করতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
প্র: ভারতের বিরুদ্ধে অনেক ম্যাচ খেলেছেন। আগের টিমগুলোর সঙ্গে এখনকার দলের কী তফাত?
জয়সূর্য: আগেও ভারতের ভাল টিম ছিল। কিন্তু এখনকার ছেলেরা টিম হিসেবে খুব ভাল একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তার জন্য প্রধান কৃতিত্ব দিতে হবে নেতৃত্ব গুণকে। ক্যাপ্টেনকে সামনে থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়। বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হিসেব কষে ঝুঁকি নিতে জানতে হয়। ক্রিকেটে সেই ঝুঁকিগুলো কখনও পক্ষে যাবে, কখনও বিপক্ষে। তবু ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে হবে। এই ভারতীয় দলটা খুব ইতিবাচক। ওরা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে। তার মানে এই নয় যে, ওরা প্রথম বল থেকেই ব্যাট চালাচ্ছে। ডিফেন্ড করার মধ্যে দিয়েও কারও চরিত্রের বলিষ্ঠতা প্রকাশ পেতে পারে।
প্র: আর কী মনে হচ্ছে এই ভারতীয় দলটাকে দেখে?
জয়সূর্য: ওরা টিমটাকে সাজিয়ে ফেলেছে। ওদের ব্যাটিং দারুণ। বোলিং বিভাগে যেমন ফাস্ট বোলার আছে, তেমন ভাল স্পিনার রয়েছে। দলের ভারসাম্য খুব ভাল। যে কোনও পরিবেশ, পরিস্থিতিতে সফল হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এই ভারসাম্যের জন্য।
প্র: এখনকার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কাকে আপনার ভাল লাগে?
জয়সূর্য: যারা শট খেলতে পারে, তাদের ব্যাটিং দেখতেই বেশি ভাল লাগে। ভারতের শিখর ধবনকে ভাল লাগে। দারুণ সব শট খেলছিল। আমার দর্শনটা হচ্ছে, ডিফেন্ড করার সময়েও যেন একটা ইতিবাচক ভঙ্গি এবং মনোভাব ফুটে ওঠে। যেন তোমাকে আত্মবিশ্বাসী দেখায়। তবেই না তুমি প্রতিপক্ষকে শাসন করতে পারবে। শিখরের মতো ব্যাটসম্যান প্রায় প্রত্যেক বলে বাউন্ডারি মারার ক্ষমতা রাখে। ওভার প্রতি চারের রানরেট রেখে স্কোর করে ও। দর্শকরাও এমন ব্যাটিং দেখতে চায়।
প্র: ডেভিড ওয়ার্নারও দ্রুত রান তুলতে পারেন। ওঁকেও পছন্দ?
জয়সূর্য: স্কোরিং রেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধবন বা ওয়ার্নার দ্রুত রান তুলতে পারে। এমনকী, বিরাট কোহালিও আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান। ভাল গতিতে স্কোর করতে পারে বিরাট।
প্র: আপনার মতে বড় ব্যাটসম্যানের প্রধান গুণ কী?
জয়সূর্য: দু’টো ব্যাপার আসল। চাপ নিতে জানতে হবে আর স্কোরিং রেট ভাল হতে হবে। দ্রুত রান করতে পারলে চাপটাকেও অনেক তাড়াতাড়ি সিস্টেম থেকে বের করে দেওয়া যায়।
প্র: ১৯৯৬ বিশ্বকাপে আপনার এবং কালুভিথর্নের ওয়ান ডে ক্রিকেটকে পাল্টে দেওয়া সেই স্ট্র্যাটেজি। ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে তুলে মারা শট। কী ভাবে এই স্ট্র্যাটেজিটা মাথায় এসেছিল?
জয়সূর্য: আরে, অত সব ভাবিইনি। স্কুল জীবন থেকেই আমি আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতাম। ক্লাব পর্যায়েও তাই করেছি। আমার মনে হয়েছিল, বোলারকে পেটানোটাই আমার জন্য সঠিক স্ট্র্যাটেজি। তাই ঠিক করেছিলাম, বিশ্বকাপেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করব।
প্র: নিজের সব চেয়ে প্রিয় এবং স্মরণীয় দু’তিনটি টেস্ট ইনিংস বাছতে বললে কোনটাকে বাছবেন?
জয়সূর্য: সবার উপরে রাখব ওভালের ডাবল সেঞ্চুরিকে। ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিলাম আমরা সেই টেস্টে (১৯৯৮-এর অগস্টে সেই টেস্টে জয়সূর্য করেছিলেন ২১৩)। তার পর ভারতের বিরুদ্ধে প্রেমদাসায় ৩৪০। আর এসএসসি-তে যত দূর মনে করতে পারছি, ভারতের বিরুদ্ধেই ১৯৯ করে আউট হয়ে গিয়েছিলাম (১৯৯৭-এ ভারতের বিরুদ্ধে এই মাঠে সত্যিই তিনি এক রানের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি পাননি)। টেস্টের কথা বললে এই তিনটে ইনিংসই বেশি মনে পড়ে।
প্র: বলা হতো ভারতীয় বোলিং সনৎ জয়সূর্যের সব চেয়ে প্রিয় খাদ্য।
জয়সূর্য (হাসি): না, না প্রিয় খাদ্য নয়। ভারত ভাল টিম ছিল। রান পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আজ হয়তো পরিসংখ্যান বলবে, সনৎ জয়সূর্যের কুড়ি হাজারের উপর রান আর ৪২টা সেঞ্চুরি রয়েছে দু’ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে। কিন্তু একটা রানও সহজে আসেনি। প্রত্যেকটা রানের পিছনে অনেক ঘাম, রক্ত ঝরানো সংগ্রাম রয়েছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy