Advertisement
E-Paper

বাইরে জল, ভিতরে আগুন, এই আমাদের মাহি

রেলে চাকরির প্রস্তাব নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন রাঁচীর বাড়িতে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বহু দিনকার বন্ধু। একসঙ্গে খেলেছেন, খড়গপুরে রেলের চাকরির সময় ছিলেন একই কোয়ার্টারে। রবিবার ধোনির খেলা দেখতে এসেছিলেন ইডেনে। ম্যাচ দেখার ফাঁকে অজানা ধোনি-কাহিনি আনন্দবাজার-এর কাছে ফাঁস করলেন মাহির বন্ধু।সাউথ ইস্টার্ন রেলে তখন গঙ্গোপাধ্যায় স্যার এক জন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান খুঁজছেন। উনি সারা দেশের ক্রিকেটের খুব খোঁজ রাখতেন। নিশ্চয়ই উনি শুনেছিলেন রাঁচীর এই তরুণের কথা।

সত্য প্রকাশ কৃষ্ণ

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:১২
ঘনিষ্ঠ বন্ধু ধোনির সঙ্গে ফেসবুকে ছবি সত্য প্রকাশ কৃষ্ণের।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু ধোনির সঙ্গে ফেসবুকে ছবি সত্য প্রকাশ কৃষ্ণের।

সাউথ ইস্টার্ন রেলে তখন গঙ্গোপাধ্যায় স্যার এক জন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান খুঁজছেন। উনি সারা দেশের ক্রিকেটের খুব খোঁজ রাখতেন। নিশ্চয়ই উনি শুনেছিলেন রাঁচীর এই তরুণের কথা।

আমি তত দিনে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির প্রতিভার সন্ধান পেয়েই গিয়েছি। একসঙ্গে খেলেছি রাজ্য দলে। সিনেমার দৃশ্যটা মনে আছে তো? আমিই মোটরবাইক চালিয়ে গিয়েছিলাম মাহির বাড়িতে খবরটা দিতে। কোলফিল্ডে তখন খুব অল্প টাকার স্টাইপেন্ডে কাজ করত ও। রেলের ট্রায়ালে ডাক পাওয়া মানে ভাগ্য খুলে যাওয়ার মতো ব্যাপার।

মাহির কাছে সেরা আকর্ষণ ছিল আমার কালো রঙের মোটরবাইকটি। যেটা ফিল্মেও দেখানো হয়েছে। ‘এমএসডি আনটোল্ড স্টোরি’র যখন শ্যুটিং হচ্ছে, সুশান্ত সিংহ রাজপুত ওটা কিনতে চেয়েছিলেন। আমি দিইনি। বলে দিয়েছিলাম, এটা মাহির প্রিয় মোটরবাইক। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বিক্রি করব না।

রেলের ট্রায়ালে পাশ করার পরে মাহি ‘জয়েন’ করে ফেলল। ক্রিকেট আর টিকিট চেকারের দ্বৈত ভূমিকা চলতে থাকল। এর মধ্যেই কিন্তু বড় মঞ্চের জন্য প্রস্তুতি চলছিল ওর। এক দিন আবিষ্কার করলাম, টুকরো টুকরো কাগজে কী সব লিখে রাখে ছেলেটা। জিজ্ঞেস করায় ভেঙে কিছু বলেনি।

পরে জেনেছিলাম, মাহি প্রত্যেক ম্যাচ থেকে নিজের পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করে ও ভাবে লিখে রাখত। তখন থেকেই নিজেই নিজের কোচিং শুরু করে দিয়েছিল। এই সময়ে আরও একটা উত্তেজক ব্যাপার ঘটল। খড়গপুরে ডিউস বলে ম্যাচ বলতে শুধুই রেলের ম্যাচ। কিন্তু টেনিস বলে প্রচুর ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো। সেগুলো নিয়ে আমরা খুব উৎসাহী হয়ে পড়লাম। আমি আর মাহি অনেক জায়গায় খেলা শুরু করলাম।

আরও পড়ুন: ইডেনে সেঞ্চুরি করে জবাব দিলের ক্যাপ্টেন ধোনি

ইডেনে রবিবার মাহির খেলা দেখতে খড়গপুর থেকে প্রায় কুড়ি জনের যে গ্রুপটা এসেছিল, তার মধ্যে ছিল প্রদীপ ভাই (সরকার)। খড়গপুরে গ্রিন অ্যাকাডেমির তরফে উনি খুব বড় টেনিস বলের টুর্নামেন্ট করতেন। এখানেই পয়সা নিয়ে খেলতাম আমি আর মাহি। মোটামুটি ১০০ টাকা প্রতি ম্যাচে বাধা ছিল। চুটিয়ে এই সব টুর্নামেন্টে খেলেছি আমরা। এই সময়টায় মাহি সব দিক দিয়েই ছিল অলরাউন্ডার। মানে ব্যাট করত, বল করত আবার দরকার হলে উইকেটকিপিংও করে দিতে পারত।

লর্ডসে এক বার একটি টেস্টে কিপিং প্যাড-গ্লাভস খুলে নিয়ে মাহি বল করতে শুরু করে দিয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়েছিল। আমরা অবাক হইনি কারণ মাহিকে বল হাতে জেতাতে দেখেছি। খড়গপুরে টেনিস বলের টুর্নামেন্টেই একটা ম্যাচে শেষ ওভারে ৮ রান দরকার ছিল প্রতিপক্ষের জয়ের জন্য। মাহি করতে দেয়নি। বেশ জোর ছিল ওর বলে।

কিন্তু সত্যি কথা বলছি, ও যে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হয়ে উঠবে আর দু’টো বিশ্বকাপ জিতবে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতবে, আইপিএল জিতবে, ভারতের সেরা ক্যাপ্টেন হবে, কখনও সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। কারণ, মাহিকে কখনও অধিনায়কত্ব করতেই দেখিনি। রেল বা রাজ্য, কোথাও ক্যাপ্টেন্সি করেনি ও। এক বারই শুধু আমাদের অধিনায়ক অসুস্থ থাকায় ওকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। কিন্তু সে দিন এমন কোনও ঝলক ছিল না, যা থেকে মনে হতে পারত, ভবিষ্যতের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অধিনায়ককে দেখছি।

‘ক্যাপ্টেন কুল’-কে দেখতে পাইনি। তবে ‘কুল কুল ধোনি’ দেখেছি। খড়গপুরে থাকার সময়কার একটি ঘটনা। আমাদের সাউথ ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে সেন্ট্রাল রেলের খেলা ছিল। ম্যাচের আগের দিন মাঠের মধ্যে সেন্ট্রালের পেসার সন্তোষ সাক্সেনা অনুশীলন করছিল। আমরা ওপরের ব্যালকনিতে ছিলাম। ওপর থেকে আমি সন্তোষকে বললাম, ‘‘কী সন্তোষ ভাই, বাজি হবে? ৫০০ টাকা লাগাও। আউট করতে পারলে আমি দেব। না পারলে তুমি।’’

সন্তোষ প্রথমে রাজি হল। তার পর হঠাৎ বলল, না দরকার নেই। সেটা শুনে আমি দু’কথা শুনিয়ে দিলাম। সন্তোষও পাল্টা বলল। ঘটনা বাড়ছে। হঠাৎ মাহি বেরিয়ে এসে বলল, ‘‘ছোড় দো সত্য ভাই, ইয়ে তো ডর গয়া।’’ বিদ্রুপ শুনে ক্ষিপ্ত সন্তোষ অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করল। মাহি স্তম্ভিত। কিন্তু একটা কথাও বলল না। এক বারের জন্যও উত্তর দিতে গেল না। যা জবাব দেওয়ার, পরের দিন মাঠে দিল। ওই ম্যাচে সন্তোষকে ও যা পিটিয়েছিল, জীবনে ভুলব না। এমন নির্দয় প্রহার আমি কখনও কোনও ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে দেখিনি। আগের দিন দেখেছিলাম ওর শান্ত দিকটা। সে দিন দেখলাম আগুনটা।

মাহি-চরিত্রে বরাবর এই দু’টো দিক। বাইরে জল, ভিতরে আগুন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও সেটাই দেখেছে। কেউ গালাগাল করলেও হেসে চলে যেত। আগুনটা দেখাত ম্যাচে গিয়ে। ভাল ম্যাচ জিতলে আমরা সকলে মিলে টাকা তুলে রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। মাহিও যেত। আর একটা মজার ব্যাপার ছিল। কোয়ার্টারে আমাদের নিজেদের রান্না করতে হতো। কিন্তু নিয়ম করা হয়েছিল, কেউ বেশি ছক্কা মারলে সে দিন সে রান্না করা থেকে ছুটি পাবে। এই নিয়মের সুবিধে সবচেয়ে বেশি নিত মাহি। ওর মতো ছক্কা কে মারবে! দেখা যেত ওকে কার্যত কোনও দিনই রান্না করতেই হতো না। এত জোরে বল মারতেও আমি আর কোনও ব্যাটসম্যানকে দেখিনি। কেউ ওকে ব্যাট দিতে চাইত না। মাহির হাতে পড়া মানে ব্যাট ভেঙে যেতে পারে।

খেলার বাইরে দু’টো জিনিসে সব চেয়ে আগ্রহ মাহির। মোটরবাইক আর ফাইটার বিমান। রাঁচীতে থাকার সময় কলাইকুন্ডা থেকে ফাইটার বিমান আকাশে উড়লেই ও ঘরের বাইরে চলে আসত দেখার জন্য। আর একটা ব্যাপার হয়তো অনেকে জানেন না। ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়কের অনেক কুসংস্কারও আছে। যেমন ব্যাটে সব সময় কমলা রঙের গ্রিপ ব্যবহার করে।

মাহির সাফল্য বিশ্লেষণ করতে বসলে আমার কৃতিত্ব দিতে ইচ্ছে করে ওর মননটাকে। ভীষণ শক্তিশালী মন ওর। লক্ষ্যটা ঠিক করে নেয়। তার পর অর্জুনের মতোই সেরা লক্ষ্যভেদী। পাখির চোখকে তাক করবে। কোনও কিছুই ওর ফোকাস নষ্ট করতে পারবে না। ও যখন কিছু বলবে, শুনতেই হবে। কখনও কর্কশ ভাবে কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু শীতল একটা কর্তৃত্ব থাকে। যেটা খণ্ডন করা অসম্ভব। মনে হয় অধিনায়ক হিসেবে ওর সাফল্যের পিছনে প্রধান কারণ চরিত্রের এই দু’টো দিকের মিশ্রণ।

ইডেনে বিজয় হাজারের এই ম্যাচটা দেখতে দেখতে বেশ নস্ট্যালজিক লাগছিল। ক্লাব হাউজের বক্সটায় কে না ছিল রবিবার। যে চায়ের দোকানে না গেলে মাহির চলত না, সে দোকান বন্ধ করে চলে এসেছে। টেনিস বলের টুর্নামেন্টে যাকে উইকেটকিপিংয়ের দায়িত্ব দিয়ে মাহি স্লগ ওভারে বল করত, সে চলে এল। কেউ বাকি ছিল না আসতে।

শিবসাগর সিংহের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ইডেনে। আবার ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম। খড়গপুরে একটা ম্যাচে আমরা জিতেছি। মাহি-কে তখন ক’জনই বা চেনে! ম্যাচটায় প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিল তখন বাংলার বাঁ হাতি স্পিনার শিবু। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা রেলের উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানকে নিয়ে কারও আগ্রহ ছিল বলে মনে হয়নি।

অনামী সেই ক্রিকেটার ফাইটার বিমানে চড়েই যেন উড়ে গেল মহাতারকাদের গ্রহে। খড়গপুরের সেই মাটিতে শুয়ে থাকার দিনগুলো মনে পড়লে এখনও মনে হয়, আসল এমএসডি-কাহিনি তো নিজের চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছি। ফিল্মের নাটকীয় চিত্রনাট্যও যে অবিশ্বাস্য যাত্রার কাছে হার মানবে!

Satyaprakash Krishna MS Dhoni Friend
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy