Advertisement
E-Paper

বন্ধু তোমার চলে যাওয়ার খবর শুনে অনেক পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে

অনুশীলন শেষ হলেই আমাকে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। তার পরে শুরু হত চা ও জলখাবারের সঙ্গে আমাদের আড্ডা।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০৩:৩১
বিষণ্ণ: শেষ হয়ে গেল ষাট বছরের সম্পর্ক। বন্ধু পিকের প্রয়াণ বিশ্বাস হচ্ছে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ফাইল

বিষণ্ণ: শেষ হয়ে গেল ষাট বছরের সম্পর্ক। বন্ধু পিকের প্রয়াণ বিশ্বাস হচ্ছে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ফাইল

বন্ধু ভাবতে পারছি না প্রায় ষাট বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি এ ভাবে চলে যাবে। আর আমাকে তোমার স্মৃতিচারণ করতে হবে।

সকলের কাছে তুমি পিকে (প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। কিন্তু আমার কাছে তুমি শুধুই বন্ধু। আমাদের আলাপ কবে ও কী ভাবে হয়েছিল, তা এত দিন পরে আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু আলাপ হওয়ার পর থেকে তোমাকে সব সময় বন্ধু বলেই সম্বোধন করেছি। তোমার মুখেও কখনও সৌমিত্র ডাক শুনিনি। তুমিও আমাকে বন্ধু বলেই সম্বোধন করতে।

বন্ধু তোমার চলে যাওয়ার খবর শুনে অনেক পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন থাকতাম মির্জাপুর স্ট্রিটে। তুমি থাকতে আমার বাড়ির কাছেই শিয়ালদহ স্টেশনের পিছনে কাইজ়ার স্ট্রিটে রেলের কোয়ার্টারে। তুমি তখন ভারতীয় ফুটবলের তারকা। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিক্সে তোমার অধিনায়কত্বেই খেলেছিল ভারতীয় ফুটবল দল। আমি অবাক হয়ে যেতাম ফুটবলের প্রতি তোমার আনুগত্য দেখে। শীতের ভোরেও একা একা অনুশীলন করতে কোয়ার্টারের উল্টো দিকে রেলের মাঠে। আমি নিজেও শারীরচর্চা করতাম বলে তুমি ডাকতে। তত দিনে আমিও চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেছি। তোমার কাছে ট্রেনিংয়ের সেই দিনগুলো আজ ভীষণ মনে পড়ছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন করার পরে শট মারতে। মাঠের এক দিকে একটি ঘর ছিল। তুমি সেই ঘরের ঘুলঘুলি লক্ষ্য করে ৩০-৪০ গজ দূর থেকে একের পর এক শট মারতে। আমাকে বলতে, কটা বল ঘুলঘুলিতে লাগল তা তুমি গুনবে। এখনও মনে পড়ছে, তোমার অধিকাংশ শটই নির্ভুল লক্ষ্যে পৌঁছত।

অনুশীলন শেষ হলেই আমাকে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে যেতে। তার পরে শুরু হত চা ও জলখাবারের সঙ্গে আমাদের আড্ডা। একটা ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও আমি রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ি। আমার টি-শার্ট ঘামে ভিজে গিয়েছিল। তুমি নিজের একটি জার্সি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, এটা পরে বাড়ি যাবে। জার্সিটা হাতে নিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ তো জাতীয় দলের জার্সি। এটা পরেই তো রোম অলিম্পিক্সে তুমি মাঠে নেমেছিলে।

ভারতীয় দলের অধিনায়কের জার্সি পরে রাস্তায় বেরোতেই পাড়ার ছেলেদের বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলাম। ওরা বলল, সৌমিত্রদা এটা কী হচ্ছে? প্রদীপদার জার্সি পরে আপনি ঘুরছেন? মনে আছে, পরের দিনই সেই জার্সি তোমাকে ফেরত দিয়েছিলাম।

তুমি ছিলেই বলেই তো কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানিচির সঙ্গে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। লখনউয়ে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা দু’জনেই নিমন্ত্রিত ছিলাম। গল্প করতে করতে হঠাৎ পিছনে ঘুরে কাউকে হাত নাড়লে তুমি। তার পরে বলল, এসো বন্ধু তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি— নাদিয়া কোমানিচি। আমি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম। বলেছিলাম, আপনিই প্রথম মানুষ যিনি দশে দশ স্কোর করেছেন। নাদিয়া হেসে বলেছিলেন, আমি প্রথম দশে দশ করতে পেরেছিলাম বলেই হয়তো সকলে মনে রেখেছে। ভবিষ্যতে অনেকেই এই স্কোর করবে। নাদিয়াকেও তুমি চমকে দিয়েছিলে বন্ধু। গড়গড় করে কিংবদন্তি জিমন্যাস্টের সাফল্যের খতিয়ান দিয়েছিলে। অবাক হয়ে নাদিয়া প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি এত সব জানলে কী করে। আমি যদিও অবাক হইনি। তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে জানি, বিশ্বের সব খেলাধুলোর প্রতি তোমার জ্ঞান অগাধ। ফুটবলের মধ্যেই তুমি নিজেকে শুধু সীমাবদ্ধ রাখোনি। অন্যান্য খোলাধুলোর প্রতিও তোমার একই রকম আগ্রহ ছিল। সের্গেই বুবকার রেকর্ডও তোমার মুখস্থ। তুমি ছিলে ‘স্পোর্টস এনসাইক্লোপিডিয়া’। এ রকম প্রাণশক্তি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। আমার স্ত্রী ব্যাডমিন্টন খেলত। ওর খেলার যাতে উন্নতি হয়, তার জন্য দীপু ঘোষকে নিয়ে এসেছিলে। শুধু তাই নয়। আমার স্ত্রীকে বলেছিলে, আমি আর বন্ধু দু’জনে মিলে তোমাকে ও দীপুকে হারিয়ে দেব। যদিও তা অসম্ভব ছিল আমাদের পক্ষে। কিন্তু বন্ধু তুমি কখনও পিছিয়ে যাওনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছো।

চলচ্চিত্রের প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিল বন্ধুর। আমার সঙ্গে একবার চলে গিয়েছিলে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। মুহূর্তের মধ্যে মানিকদার মন জয় করে নিয়েছিলে তুমি। আরতির সঙ্গে তোমার বিয়ের কাহিনিটাও আজ মনে পড়ে যাচ্ছে। আরতির ভাইয়েরা আমাদের বন্ধু ছিলেন। বিয়ের যাবতীয় আয়োজন করেছিল আমার স্ত্রী। দীপু ঘোষও ছিল। বন্ধু তোমার সূত্রেই বহু ক্রীড়াবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। চুনীর (গোস্বামী) সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তুমি।

তোমার জন্যই কখনও কোন ক্লাবের সমর্থক হতে পারিনি আমি। যখন যে ক্লাবে কোচিং করিয়েছো, তোমার সাফল্য কামনা করেছি। মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম, এ বারও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে তুমি। আবার আমরা আগের মতো গল্প করব। কিন্তু তোমার যে এত তাড়া ছিল বন্ধু, জানতাম না।

ভাল থেকো!

PK Banerjee Death Football Soumitra Chatterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy