বিচারপতি লোঢার বাউন্সারে তাঁদের উইকেট চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তা বলে আহত-অবসৃত (রিটায়ার্ড হার্ট) হয়ে ম্যাচ ছেড়ে যেতে নারাজ বোর্ড কর্তারা। এ বার তাঁরা ব্যাট তুলে দিতে চান পরিবারের লোকজনদের হাতে।
‘আমাদের খেলতে না দিলে খেলবে আমাদের পরিবার’— বিস্ময়কর শোনালেও লোঢা কমিটির বাউন্সারকে পাল্টা জবাব দিতে এই মন্ত্রই অনুসরণ করতে চলেছেন বোর্ডের অধীনস্থ অনেক রাজ্য সংস্থার কর্তারা। যার প্রভাবে রাজনীতির পরিবারতন্ত্র চলে আসতে পারে ক্রিকেটে। এমন নয় যে ক্রিকেট প্রশাসনে পরিবারতন্ত্র ছিল না। ভারতের একাধিক রাজ্য সংস্থায় দিনের পর দিন একই পরিবারের প্রতিনিধিরা বংশানুক্রমিক ভাবে মসনদ ধরে রেখেছেন।
কিন্তু এ বারের ঘটনা সম্পূর্ণ অন্য রকম। যা আইনের ফাঁক দিয়ে গলে লোঢা সংস্কারকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিতে পারে। আইপিএলে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে বোর্ডের সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংস্কারের প্রধান দায়িত্ব দিয়েছিল বিচারপতি লোঢার উপরে। একটি কমিটি গঠিত হয় তিন সদস্যের। সেই কমিটির করা দু’টি সুপারিশ সর্বাধিক চর্চিত। এক) ৭০ পেরিয়ে গেলে আর প্রশাসনে থাকা যাবে না এবং দুই) টানা তিন বছর পদাধিকারী থাকার পরে ‘কুলিং অফ’ অর্থাৎ পদ ছেড়ে বিশ্রামে যেতে হবে। এর সঙ্গে আর একটি সুপারিশ হচ্ছে, কোনও সংস্থায় ৯ বছর হয়ে গেলে সেই ব্যক্তি আর কখনও কোনও পদে বসতে পারবেন না। পাকাপাকি ভাবে তাঁকে সংস্থা থেকে বিদায় নিতে হবে।
এই সুপারিশের বাউন্সারেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এবং তার অধীনস্থ বিভিন্ন রাজ্য সংস্থায় কর্তাদের মৌরসিপাট্টা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ সংস্থাতেই গরিষ্ঠ সংখ্যক কর্তা ৯ বছরের উপর সময় কাটিয়ে ফেলেছেন। টানা তিন বছর তো অনেক কম সময়, অনেকে কাটিয়ে ফেলেছে দুই দশক বা তিন দশকও। সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই চললেও এখন মোটামুটি পরিষ্কার হতে শুরু করেছে যে, বেশির ভাগ কর্তাকেই ক্রিকেট প্রশাসন থেকে অব্যাহতি নিতে হবে। কারও কারও সম্পূর্ণ ভাবেই বিদায় আসন্ন।
এই বিধানের পাল্টা হিসেবে বিভিন্ন সংস্থায় কর্তারা ‘মাস্টারপ্ল্যান’ বানিয়েছেন বলে খবর। কী সেই মোক্ষম পরিকল্পনা? না, আত্মীয়স্বজনদের তাঁরা ধরে এনে বসাবেন সংস্থার চেয়ারে। কেউ ধরে আনছেন ভাইকে, কেউ এগিয়ে দিচ্ছেন নিজের ছেলেকে, আবার কেউ কেউ এমনকি, স্ত্রীকেও বসিয়ে দিতে পিছপা হচ্ছেন না। দিল্লি ক্রিকেট সংস্থাতেই যেমন একটি ঘটনা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সি কে খন্নার স্ত্রী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন লড়ার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। যা দেখে কারও কারও লালুপ্রসাদ যাদবের রাতারাতি রাবড়ি দেবীকে বিহারের মসনদে বসানোর ঘটনা মনে পড়ে যেতে পারে।
খন্নার স্ত্রীকে নিয়ে সংস্থার অন্দরমহলে আপত্তি উঠেছে কিন্তু দিল্লিতে ফোন করে জানা গেল, সেই আপত্তি টেকার সম্ভাবনা কম। আইনজ্ঞদের মতে, খন্নার স্ত্রীর মনোনয়নপত্র গ্রহণ না হওয়ার কোনও কারণ বিরোধীদের হাতেও নেই। লোঢা কমিটির সংস্কারের বিধি অনুযায়ী নাকি তাঁকে ঠেকানোর কোনও পথ নেই।
ক্রিকেট সংস্থায় কোনও পদাধিকারী যোগ্যতামান হারালে তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে মনোনয়ন জমা করাচ্ছেন, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। যদিও ভাই বা পুত্রকে মসনদে বসানোর রেওয়াজ অনেক জায়গাতেই ছিল। এখন লোঢা আইনের বেড়াজালে সেটা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। হিমাচল প্রদেশে অনুরাগ ঠাকুর থাকতে পারছেন না। শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবেন তাঁর ভাই। অন্ধ্রপ্রদেশে গঙ্গা রাজুর ছেলে, সৌরাষ্ট্রে নিরঞ্জন শাহের ছেলে জয়দেব শাহরাও আসতে পারেন। জয়দেব ক্রিকেট খেলেন। কিন্তু কেরিয়ারের ভবিষ্যৎ খুব একটা নেই দেখে বাবা নিয়ে আসতে পারেন ক্রিকেট প্রশাসনে। নিয়ম অনুযায়ী, ঠেকানোর উপায় নেই। লোঢা সংস্কার কার্যকর হল, আবার সংস্থার রাশও থেকে গেল পরিবারের মধ্যে। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
দিল্লিতে খন্নার স্ত্রী একা নন। আরও দু’এক জন কর্তা, যাঁরা যোগ্যতামান হারিয়েছেন, তাঁরা নিয়ে আসতে পারেন দাদা, ভাই বা ছেলেকে। সিএবি-তে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাদা স্নেহাশিসের বৈঠকে আগমন নিয়েও চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। যদিও স্নেহাশিসকে একই ফর্মুলা মেনে ভবিষ্যতে কোনও পদে বসানোর জন্য আনা হয়েছে কি না, সেই ইঙ্গিত এখনও স্পষ্ট নয়। ওড়িশায় আশীর্বাদ বেহরা তাঁর ছেলেকে বসাতে পারেন। তেমনই ঘটতে পারে হরিয়ানাতেও। কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে না চাইলেও এ রকম একটা পরিকল্পনা যে চতুর্দিকে চলছে, সেই ইঙ্গিত যথেষ্টই মিলেছে।
যা পরিস্থিতি, পাল্টা বাউন্সারে লোঢা কমিটিরই না স্টাম্প ছিটকে যায়! কিন্তু ‘নো বল’ ডাকবে কে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy