Advertisement
E-Paper

ঘৃণার গলি থেকে পোলিশ উত্তরণের ‘ওঝা’

রোগাসোগা ছেলেটাকে ভরসোভিয়া ক্লাবের কেউ পছন্দ করত না। পোলিশে ডাকত, ‘বোবেক’। যার অর্থ খুব নরমসরম ভাবে বললেও বলতে হয়, অতীব ঘৃণ্য এক চরিত্র।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০৪:১৭

রোগাসোগা ছেলেটাকে ভরসোভিয়া ক্লাবের কেউ পছন্দ করত না। পোলিশে ডাকত, ‘বোবেক’। যার অর্থ খুব নরমসরম ভাবে বললেও বলতে হয়, অতীব ঘৃণ্য এক চরিত্র। যাকে বোঝার, চেনার প্রয়োজন পড়ে না। ঘৃণা স্বতঃস্ফূর্ত চলে আসে!

রোগাসোগা ছেলেটা প্রাকৃতিক ধর্ম মেনে বড় হয়েছে। চেহারাটা পাল্টেছে একটু-একটু করে। কিন্তু কোথায়, ধারণা তো পাল্টায়নি। পেপ গুয়ার্দিওলাকে মনে পড়ে? বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে বায়ার্ন মিউনিখে আসার সময়কার লেভানডস্কিকে নিয়ে কী বলেছিলেন? কোথাও ভীতু-ভীতু দেখতে ছেলেটাকে নিয়ে খারাপ কথা বলেননি স্প্যানিশ এল মায়েস্ত্রো। কিন্তু উচ্চকিত প্রশংসাও করেননি। সেন্টার ফরোয়ার্ড তত্ত্বের চিরকালীন বিরোধী পেপ ছোট্ট করে শুধু বলেছিলেন, “আমি ক্লাবকে এমন সুন্দর একজন প্লেয়ার সই করানোর জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছি!” পেপ পোলিশ নন, স্প্যানিশ। কে জানে স্প্যানিশে ‘বোবেক’-কে কী বলে!

রোগাসোগা ছেলেটাকে লোকে খুব জ্বালাত। স্কুলের পিটি-শিক্ষক চেয়েছিলেন, ছাত্র ফুটবল নয়, দেশের সেরা দৌড়বাজদের সরণিতে থাকুক। তার উপর চেহারা সে আর এক যন্ত্রণা। কেউ দেখত না, ছুটোছুটির সময় তাঁর হৃদযন্ত্রের অফুরান জ্বালানি। কেউ বুঝত না, ফিটনেসে তিনিই টিমে শ্রেষ্ঠ। ভরসোভিয়ায় প্রথম কোচ তো দেখামাত্র বলেছিলেন, শোনো ভাই, তোমাকে ভাল করে বেকন খেতে হবে। এই চেহারায় ফুটবল হয় না।

ইউরো কোয়ার্টার ফাইনাল নামের স্বপ্নের স্টেশনে দাঁড়িয়ে রবার্ট লেভানডস্কির আজ মনে পড়ছে?

রবার্ট লেভানডস্কি— নামটা ফুটবল-পৃথিবী ভাল করে শুনেছিল বছর তিনেক আগে। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালের সময়, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বিরুদ্ধে। রোনাল্ডোর রিয়ালকে সে দিন একা চার গোল দিয়েছিলেন বরুসিয়ার ‘বোবেক’। বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিল, নতুন এক আগুনের আবির্ভাব। তিন বছর পর আবার আজ রোনাল্ডো। আবার কাগজ-কলমে অসম যুদ্ধ। বুধবার রাতে ধুলো সরিয়ে মহাকীর্তির পুরনো পাতা কি লেভানডস্কি দেখবেন একবার?

রোনাল্ডো বৃহস্পতিবার তাঁর প্রতিবন্ধকতা, রোনাল্ডো আবার তাঁর অলক্ষ্য যোগসূত্র। জীবনে, পারফরম্যান্সে। রোনাল্ডো পিতৃহারা, বছর দশেক আগে জোসে আভেইরো মারা যান অতিরিক্ত মদ্যপানে। লেভানডস্কি আবার বাবাকে হারান যখন, পোলিশ স্ট্রাইকারের বয়স মাত্র ষোলো। রোনাল্ডো চেয়েছিলেন নেশাগ্রস্ত বাবাকে মুক্ত করতে, রিহ্যাবে পাঠিয়ে। লাভ হয়নি। লেভানডস্কি সেই সুযোগটাও পাননি। আচমকা হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে কী করার থাকতে পারে? ইউরোতেও কত মিল। দু’জনেই দেশের সেরা প্লেয়ার। বলা যায়, দেশজ প্রত্যাশার দায়ভার মেটানোর একমাত্র। কিন্তু দু’জনের সঙ্গেই যেন ফর্ম বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তবু দু’টো গোল করেছিলেন সিআর সেভেন, আর এল নাইনের সেটাও নেই। ইউরোয় এখনও একটাও গোল নেই।

তা হলে এত লেখা কেন?

বুধবার শুনলাম, পোল্যান্ড সমর্থকরা নাকি কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গেলে অত দুঃখ পাবেন না। তাঁরা নাকি সাংবাদিকদের বলেওছেন যে, টিম এত দূর আসবে ভাবতে পারেননি। তাঁরা বরং অনেক বেশি দুঃখ পাবেন, লেভানডস্কি একটাও গোল না করে ফিরে গেলে। যে ছেলেটা মনেপ্রাণে এত ভাল, যে দেশে থাকলে প্রতি রবিবার গির্জায় গিয়ে ছোট-ছোট ছেলেদের অনুপ্রেরণা দেয়, তার এতটা অবিচার হবে?

আসলে ফ্রান্সে যেমন জিদান, পোলিশ ফুটবলে লেভানডস্কি। হয়তো প্রভাবে তার চেয়েও বেশি। ফ্রান্স জিদানের আগে একটা প্লাতিনি পেয়েছে। পোলিশ ফুটবলে লেভানডস্কির আগে কোনও খ্যাতনামাকে তো মনে পড়ে না। বহু দিন আগে একটা কাগজ তাঁকে নিয়ে লিখেছিল ‘বোথ পায়োনিয়ার অ্যান্ড একসরসিস্ট’। একদম ঠিক। দেশের অতীত ব্যর্থতার ভূত তাড়িয়েছেন তিনি, দেশে ফুটবল-গর্বের নতুন মিনার তৈরির সৃষ্টিকর্তাও তিনি। ধুলো-ময়লা পরিবৃত ভরসোভিয়া ক্লাবে তাঁর জেতা ট্রফিগুলো আজও সযত্নে রাখা থাকে, বিদেশি সাংবাদিক দেখলে ষাট বছরের বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের ভাষা বোঝার প্রয়োজন পড়ে না, আপনাআপনি অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, “আহ্, লেভানডস্কি!”

তাই রবার্ট লেভানডস্কি নিয়ে এত শব্দ লেখা। পোল্যান্ডের ‘বোবেক’-কে নিয়ে আসলে হাজার-হাজার শব্দ লেখা যায়।

robert lewandowski
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy