Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ব্যাডমিন্টনে ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’ হয়ে থাকল সিন্ধুদের লড়াই

‘চার দশকে আমার দেখা সেরা ম্যাচ’

এ রকম তুমুল লড়াই, কোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়া, প্রত্যেকটা শট, র‌্যালি, পয়েন্টের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া তীব্র রেষারেষি আগে দেখিনি। ব্যাডমিন্টনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা লড়াই হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে রবিবারের ফাইনাল।

লড়াকু: গ্লাসগোয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস লড়াই করে পিভি সিন্ধু হারলেন ওকুহারার কাছে। ছবি: এএফপি।

লড়াকু: গ্লাসগোয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস লড়াই করে পিভি সিন্ধু হারলেন ওকুহারার কাছে। ছবি: এএফপি।

মধুমিতা বিস্ত
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৫৮
Share: Save:

এই না হলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল!

চার দশকেরও বেশি হয়ে গেল ব্যাডমিন্টনের সঙ্গে আমি যুক্ত। প্রচুর ম্যাচ খেলেছি, দেখেছি। কিন্তু রবিবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সিন্ধু আর নজোমি ওকুহারার লড়াইটা আমার দেখা সেরা।

এ রকম তুমুল লড়াই, কোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বীকে এক ইঞ্চি জমি না ছাড়া, প্রত্যেকটা শট, র‌্যালি, পয়েন্টের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া তীব্র রেষারেষি আগে দেখিনি। ব্যাডমিন্টনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা লড়াই হিসেবে জায়গা করে নিতে পারে রবিবারের ফাইনাল।

প্রায় এক ঘণ্টা ৫০ মিনিটের ম্যাচে সিন্ধু শেষ পর্যন্ত হয়তো হারল ১৯-২১, ২২-২০, ২০-২২। তবে আমার কাছে এ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে শুধু ওকুহারা নয়, চ্যাম্পিয়ন সিন্ধুও। যে রকম খেলেছে আমাদের মেয়েটা, ফাইনালে ওর রুপোর পদকের দাম সোনার থেকে কোনও অংশে কম নয়।

ভেবেছিলাম সিন্ধু হয়তো কিছুটা এগিয়ে থাকবে। এমনিতে মুখোমুখি লড়াইয়ে দু’জনের রেকর্ড ৩-৩ হলেও শেষ দু’বার, মানে এ বছর সিঙ্গাপুর ওপেন আর তার আগে রিও অলিম্পিক্সে ওকুহারাকে সহজেই হারিয়ে দিয়েছিল সিন্ধু। তা ছাড়া সিন্ধুকে এ বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্ধর্ষ ফর্মে দেখছিলাম। তৃতীয় ম্যাচটা ছাড়া ওকে তো তিন গেমে যেতেই হয়নি। দু’টো চিনা খেলোয়াড়কে হারিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য লাগছিল ওকে তাই ফাইনালে।

আরও পড়ুন: হেরে গেলেও সাইনা দেখালেন তিনি ফুরিয়ে যাননি

কিন্তু ওকুহারা বুঝিয়ে দিল কেন ওকে সার্কিটে ‘জায়ান্ট কিলার’ বলা হয়। আর একটা নাম আছে ওকুহারার। ‘প্রত্যাবর্তনের রানি’। ম্যাচে পিছিয়ে গিয়েও অবিশ্বাস্য ভাবে ফিরে এসে প্রচুর ম্যাচ ও আগে জিতেছে বলেই হয়তো এই নামে অনেকে ডাকে ওকে। ঠিক যে ভাবে সাইনার বিরুদ্ধেও ও জিতল শনিবার। রবিবারের ফাইনালে প্রথম গেমে ওকুহারা ৬-১৩ পিছিয়ে যাওয়ার পরও তাই হয়তো মনে হয়নি ওকে দেখে কোনও রকম চাপে রয়েছে। ঠিক সময়ে গিয়ার পাল্টাল। সিন্ধুকে পিছনের কোর্টে ঠেলে দিয়ে, সামনের দিকে ফাঁকা জায়গায় শাটল রেখে পয়েন্ট তোলার স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল। এর পরে সতেরোর মধ্যে ১৩টা পয়েন্ট জিতে নিয়ে প্রথম গেম মুঠোয় পুরে ফেলে ওকুহারা।

১৯৭৫ সালের মহম্মদ আলি আর জো ফ্রেজিয়ারের বিখ্যাত ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলার’ কথা মনে পড়ছিল গ্লাসগোর এই ফাইনালটা দেখতে দেখতে। ১৪ রাউন্ড রিং-এ যে তুমুল লড়াইকে খেলাধুলোর ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলা হয়। মহম্মদ আলি আর জো ফ্রেজিয়ার যেখানে মার খেতে খেতে পড়ে গিয়েও, ফের উঠে দাঁড়িয়ে আবার লড়াইয়ে নেমেছিল। সিন্ধু আর ওকুহারাও লম্বা ৩০-৩২ শটের র‌্যালিগুলোয় কখনও পয়েন্ট বাঁচাতে ডাইভ দিয়ে, কখনও প্রতিপক্ষের ঘাতক ড্রপশট সামলাতে কোর্টে পড়ে যাচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, আর ওঠার শক্তি অবশিষ্ট নেই দু’জনের। কিন্তু হার না মেনে আবার উঠে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছে দু’জনই। যে লড়াইকে কুর্নিশ করতেই হবে।

তবে ক্লান্তি সিন্ধুর ক্ষেত্রেও আসাটা ছিল স্বাভাবিক। শনিবার সেমিফাইনালের পরে ২৪ ঘণ্টাও তো ও পায়নি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। ওকুহারা কিন্তু সেই সময়টা পেয়েছে শনিবার অনেক আগেই ওর সেমিফাইনাল শেষ হয়ে যাওয়ায়। তবু ক্লান্তি কাটিয়ে সিন্ধু কিন্তু দারুণ ভাবে ফিরে এল দ্বিতীয় গেমে। তবে ওকুহারা সহজে ছাড়েনি। সিন্ধুকে প্রচুর লড়তে হয়েছে গেমটা জিততে। দ্বিতীয় গেমের শেষের দিকে তো ৭৩ শটের একটা র‌্যালি হয়েছে! ভাবা যায়!

তৃতীয় গেমে সিন্ধুকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল ক্লান্তি পুরোপুরি চেপে ধরেছে। বারবার বিশ্রাম নিতে থেমে যাচ্ছিল। আম্পায়ার বেশ কয়েকবার সিন্ধুকে কোর্টে দ্রুত ফিরে আসার নির্দেশ দিচ্ছিল। যা অমান্য করায় হলুদ কার্ড দেখিয়ে সিন্ধুকে সতর্কও করে দেন তিনি। তবু সিন্ধু কিন্তু তৃতীয় গেমে ১-৫ পিছিয়ে গিয়ে ফিরে এসেছে। কোর্টের ধারে থাকা দুই কোচ মানে গোপী আর মুলো হান্দোয়োকে দেখছিলাম, সিন্ধুকে ধৈর্য ধরার ইঙ্গিত করতে। ৫-৫, ৭-৭, ৯-৯, ১১-১১, ১২-১২, ১৬-১৬, ১৯-১৯, ২০-২০ এই পয়েন্টগুলোই বুঝিয়ে দিচ্ছে লড়াইটা কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

শুনলাম, ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে বুমরার পাঁচ উইকেট, রোহিত শর্মার সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ভারতীয় সমর্থকরা টিভিতে ক্রিকেট থেকে সরে এসেছিল ব্যাডমিন্টনে। ভারতীয় খেলাধুলোর জগতে রবিবারের ফাইনাল তাই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। সিন্ধুর রুপোর মূল্য তাই সোনার চেয়ে কম কীসে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE