মেজাজ: প্র্যাকটিস যাওয়ার আগে হোটেলে কোহালি। টুইটার
কী নামকরণ করা যায় এর?
পিচ থ্রিলার?
বিরাট কোহালি তাঁর দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রাক-টেস্ট প্রস্তুতি সেরে। আর তার আধ ঘণ্টার মধ্যে পিচ প্রস্তুতকারক ঢুকলেন তাঁর দলবল নিয়ে। এতক্ষণ যে বাইশ গজ ঢাকা ছিল, তার পরদা উন্মোচন হল এবং দ্রুত জনা দশেক লোককে লেগে পড়তে দেখা গেল কাজে।
কোহালি যে সামান্য সবুজের আভা দেখে মাঠ ছেড়েছিলেন, আজ, বুধবার টস করতে এসে দেখবেন, সেটা সম্পূর্ণ উড়ে গিয়েছে। তার বদলে শ্রীলঙ্কা তাঁদের ফেলছে ধূসর উইকেটে। মানে রঙ্গনা হেরাথের কথা ভেবেই উইকেট। এর পর আর. অশ্বিন, তুমি যদি কেরামতি দেখিয়ে ধ্বংসলীলা চালাতে পারো তো চালাও। বেশ একরোখা এবং মরিয়া চালই মনে হচ্ছে শ্রীলঙ্কা নিচ্ছে।
সমস্যা হচ্ছে, এই সব পিচ-নাটকের প্রাসঙ্গিকতা অন্য ক্রিকেট কেন্দ্রে থাকতে পারে। গলের মাঠে এ সব গৌণ। গলের ক্রিকেট মানে হচ্ছে সি এল আর জেমসের ক্রিকেট। ‘হোয়াট ডু দে নো অব ক্রিকেট হু ওনলি ক্রিকেট নো’! তারা কী জানে ক্রিকেটের, যারা শুধু ক্রিকেটই জানে!
বক্সিং ডে খেলাধুলোর মানচিত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দিন। আর ২০০৪-এর বক্সিং ডে-ই কিনা বরাবরের জন্য পাল্টে দিয়ে গেল গলের ক্রিকেটকে। বিশ্বের যত দৃষ্টিনন্দন ক্রিকেট মাঠ আছে, তার মধ্যে গল অন্যতম। সত্যিই কী অপূর্ব শোভা! প্যাভিলিয়নের পিছন দিকে ভারত মহাসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। মাঠের একটা দিক জুড়ে গল ফোর্ট। শোনা যায় প্রায় ৪২৩ বছরের পুরনো। পর্তুগিজদের হাতে তৈরি কিন্তু শ্রীলঙ্কার সেরা আকর্ষণে পরিণত হয় ডাচদের হাতে।
কিন্তু কে জানত, সুন্দরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আতঙ্কের বিভীষিকা। আর খেলাধুলোর জগতে বিশেষ ভাবে উল্লোখযোগ্য বক্সিং ডে-তেই নৈসর্গিক শোভার মধ্যে থেকে জেগে উঠবে সুনামি নামক দৈত্য। এখনও ওই মাঠে কর্তব্যরত বেশ কয়েক জন কর্মী আছেন, যাঁরা সেই আতঙ্ক মনে করলে আঁতকে ওঠেন, সুন্দর এই সমুদ্রই আবার কেঁপে উঠবে না তো?
সিরিজের ভাগ্য ঠিক হতে পারে দুই স্পিনারের লড়াইয়ে
রঙ্গনা হেরাথ
• টেস্ট কেরিয়ার: টেস্ট ৮১ উইকেট ৩৮৪ সেরা ৯-১২৭ গড় ২৭.৭২ ইনিংসে পাঁচ উইকেট ৩১
• শেষ সিরিজে পারফরম্যান্স: টেস্ট ৩ উইকেট ১৫ সেরা ৭-৪৮ গড় ৩১.০০
• অস্ত্র: বাঁ হাতি স্পিনারের লাইন-লেংথ নিখুঁত। গলে ভয়ঙ্কর। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এই মাঠে হ্যাটট্রিকও আছে। ভারতের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৭ টেস্টে ২৭ উইকেট।
রবিচন্দ্রন অশ্বিন
• টেস্ট কেরিয়ার: টেস্ট ৪৯ উইকেট ২৭৫ সেরা ৭-৫৯ গড় ২৫.২২ ইনিংসে পাঁচ উইকেট ২৫
• শেষ সিরিজে পারফরম্যান্স: টেস্ট ৩ উইকেট ২১ সেরা ৬-৪৬ গড় ১৮.০৯
• অস্ত্র: ক্যারম বলের পাশাপাশি বড় অফস্পিন করাতে পারেন। পিচে টার্ন থাকলে ভয়ঙ্কর। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শেষ সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি।
‘‘সেই দিনটা পরিষ্কার মনে আছে এখনও। বাইরে থেকে একটি দল এসেছিল খেলতে। তারা ওয়ার্ম আপ করছিল। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগে আবার সেই দৈত্যকার ঢেউ তেড়েফুঁড়ে এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল,’’ বলছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে গলের মাঠে কাজ করা দু’তিন জন কর্মী। তাঁরা সে দিনও ছিলেন মাঠে। ‘‘যে যার মতো প্যাভিলিয়নের দিকে দৌড় লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই সময় মতো আশ্রয়ে পৌঁছতে পারেনি,’’ বলতে বলতে মুখ নামিয়ে নেন তাঁরা। দু’জন মাঠকর্মী তাঁদের সামনে দিয়েই সেই জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যান। আর তাঁরা ফেরেননি।
মঙ্গলবার গলের মাঠে ঢুকে ফের মনে হল, কত কিছুই পাল্টে গিয়েছে আবার কোনও কিছুই পাল্টায়নি। তেরো বছর হয়ে গেল। সুনামি নামক সামুদ্রিক দৈত্যের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে গল। এখানকার মাঠ আবার বিশ্বের সেরা নৈসর্গিক ক্রিকেট কেন্দ্রের একটা হয়ে উঠেছে। ওই তো সমুদ্রের পারে ভয়ডরহীন ভাবে ফের ক্রিকেট খেলে চলেছে কিশোরের দল। পিছনে সেই একই ভারত মহাসাগর। আপন নিয়মে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সেই ঢেউয়ে সৌন্দর্যই আছে, আতঙ্ক নেই।
তাই কি? কেমন যেন খটকা লাগে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথায়। গলে ঢোকার মুখে সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাওয়ায় কেন তিনি বলে ওঠেন— ‘‘কী দরকার, ছেড়ে দিন না। সমুদ্রের কখন কী মেজাজ হয়!’’ তার পরেই উল্টো দিকের বহুতলের দিকে দেখিয়ে বলে ওঠেন, ‘‘সুনামি যে দিন এসেছিল, ওই জায়গাটা পর্যন্ত জল উঠে গিয়েছিল। প্রায় বিশ-তিরিশ ফুট তো হবেই। এই রাস্তাটার সঙ্গে সমুদ্রের কোনও তফাত ছিল না।’’ সত্যিই গলে সমুদ্রের পার আর রাস্তার মধ্যে কোনও তফাত করাই কঠিন। এত কাছাকাছি জল আর ডাঙা। তেরো বছর আগে সুনামির ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের হাত থেকে যে কারণে রাস্তায় চলন্ত যানবাহনও রক্ষা পায়নি। নির্মম সাগরের গ্রাসে চলে যায় সব কিছুই। সামান্য খোঁচাতেই তাই পুরনো সেই আতঙ্ক ফিরে ফিরে আসে— ঘুমন্ত দৈত্যটা আবার জেগে উঠবে না তো?
কোহালিদের জন্যও তো গল মানেই সভ্যতা পুনর্গঠনের। এ মাঠেই তরুণ ক্যাপ্টেন কোহালি এবং তাঁর দল নিশ্চিত ভাবে জেতা টেস্ট ম্যাচ হেরে যায়। তখন টিম ডিরেক্টর ছিলেন রবি শাস্ত্রী। গোটা টিমকে ডেকে বলেন, এখান থেকে ময়নাতদন্ত করে তবেই আমরা হোটেলে ফিরব। গলের ড্রেসিংরুমে সে দিন ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দেড় ঘণ্টা বসে মিটিং করেছিল কোহালির ভারত।
অনিল কুম্বলে বিতর্কের যবনিকা ঘটিয়ে শাস্ত্রী এখন আবার ভারতীয় দলের হেড কোচ। তিনি মনে করেন, গলই কোহালিদের বালক থেকে পুরুষ করে তুলেছিল। সে দিন ড্রেসিংরুমে দেড় ঘণ্টা ধরে বসে পোস্টমর্টেম করা দল দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ২-১ সিরিজ জিতেছিল। কোহালিও মনে করেন, পরবর্তী সময়ে যে তাঁরা টেস্টের এক নম্বর দল হলেন, সেই যাত্রাটা কোনও জয় দিয়ে শুরু হয়নি। শুরু হয়েছিল গলের পরাজয় দিয়ে।
সেখানেই বুধবার শাস্ত্রী-কোহালি নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে। ভারতীয় ক্রিকেটের চাণক্য-চন্দ্রগুপ্ত হয়ে উঠবেন তাঁরা, না কি আবার কোনও ঝটকা অপেক্ষা করছে? গল মানেই যে সৌন্দর্যের পাশাপাশি আতঙ্কেরও উপস্থিতি।
কখন আবার দৈত্যটা জেগে ওঠে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy