স্বর্গারোহিণী (৬২৫২ মিটার)।
এ বছরের প্রাক্-বর্ষা আরোহণ মরসুমে বেশ ভাটা পড়েছে নেপালের ভূমিকম্পের কারণে। অধরা থেকে গিয়েছে এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, চো-ইয়ুর মতো আট হাজারি শৃঙ্গগুলি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেই নতুন কোনও কীর্তি গড়তে পারেননি নেপাল হিমালয়ে পাড়ি জমানো বাঙালি পর্বতারোহীর দল।
কিন্তু এই না-পারার যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়ে সাফল্যের বাতি জ্বালিয়ে রাখল হাওড়া ডিসট্রিক্ট মাউন্টেনিয়ার্স অ্যান্ড ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন (এইচডিএমটিএ) এবং ইছাপুরের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকার্সের (ওএফএমটি) মতো দু’টি তথাকথিত ‘অনামী’ ক্লাবের দু’টি সফল অভিযান, যথাক্রমে নন্দাঘুণ্টি (৬৩০৯ মিটার) ও স্বর্গারোহিণী(৬২৫২ মিটার)। আট-হাজারি স্বপ্নের ভিড়ে নাম লেখানো নয়, নতুন ও অজানা পথ ও স্মৃতির সরণীই তাদের বিশেষ সাফল্যের চাবিকাঠি। আর ঘটনাচক্রে, দু’টি অভিযানই সফল হল ঠিক একই দিনে, চলতি বছরের ১০ জুন।
সেই সঙ্গেই অনেক নামি-দামী অভিযানের ভিড়ে ছোট্ট করে সাফল্যের নাম লিখিয়ে ফেলল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড হাইকিং ক্লাব (জেইউএমএইচসি)। হিমাচলের লাহুল উপত্যকার কোয়া রাং-২ শৃঙ্গে (৬১৮৭ মিটার) সফল অভিযান করে ভারতের একমাত্র ছাত্র-ছাত্রী পরিচালিত ক্লাবটির ঐতিহ্য বজায় রাখলেন এই ক্লাবের পড়ুয়া-সদস্যরা।
এইচডিএমটিএ-র গন্তব্য ছিল উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায়, গঢ়বাল হিমালয়ের নন্দাঘুন্টি শৃঙ্গ। ১৯৬০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বাঙালি পর্বতারোহী দলের আরোহণ হয়েছিল এই শৃঙ্গে। হিমালয়ান ইনস্টিটিউটের (পরবর্তী কালে নাম বদলে পর্বত অভিযাত্রী সঙ্ঘ) সদস্য সুকুমার রায় ও সঙ্গী শেরপা নিমা তাশির ওই আরোহণটিকেই বাঙালির প্রথম সফল অভিযান বলা হয়। এইচডিএমটিএ-র মুখপাত্র কিরণ মুখোপাধ্যায় জানালেন, কঠিন শৃঙ্গের চ্যালেঞ্জ নয়, স্মৃতিমেদুর এই শৃঙ্গটিকে আরও এক বার ছুঁয়ে আসাই আমাদের এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল।
অন্য দিকে, ইছাপুরের ওএফএমটি-র দশ সদস্যের দলটি পা বাড়িয়েছিল গঢ়বাল হিমালয়েরই অন্য এক শৃঙ্গ স্বর্গারোহিণীর পথে। আর এই অভিযানে সফল হয়ে বাংলার পর্বতারোহণ ইতিহাসে নতুন সাফল্যের অধ্যায় যোগ করল তারা। জুন মাসের দশ তারিখে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রথম বাঙালি হিসেবে শৃঙ্গে পা রাখেন ওই দলের তিন সদস্য জয়দীপ মণ্ডল, পরমেশ চট্টোপাধ্যায় ও ভাস্কর রায়। ১৯৯০ সালে ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং’-এর একটি দল প্রথম স্বর্গারোহিণী আরোহণ করে। কিন্তু এত দিন কোনও বাঙালির পা পড়েনি ৬২৫২ মিটার উচ্চতার এই শৃঙ্গে।
এই অভিযানের দলনেতা প্রদ্যুৎ ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘‘প্রস্তুতি পর্ব ছিল সব চেয়ে কঠিন। কারণ এই শৃঙ্গে পূর্ববর্তী অভিযানের কোনও রিপোর্ট ছিল না আমাদের হাতে। সাম্প্রতিক অতীতে আরোহণ হয়নি শৃঙ্গটি। অনেক পুরনো কিছু তথ্য, সিনিয়র সদস্যদের অভিজ্ঞতা আর আন্দাজকে কাজে লাগিয়েই শুরু করেছিলাম আমরা। ইতিহাস গড়ব বলে ভাবিনি, ভেবেছিলাম পরিচিত আরোহণের ভিড়ে নতুন একটা চেষ্টা তো হবে!’’
স্বর্গারোহিণী অভিযানের আরও বর্ণনা শোনা গেল শৃঙ্গ আরোহী সদস্য জয়দীপ মণ্ডলের মুখে। জানালেন, বেস ক্যাম্প পেরিয়ে ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত সব কিছু ঠিক ছিল। তার পরেই ক্যাম্প টু-এর পথ খুঁজে এসে শেরপারা জানিয়ে দেন, তিন জন সদস্যের বেশি কিছুতেই ওঠা যাবে না ওপরে। তা-ই সদস্য সংখ্যা কমিয়ে জয়দীপ, পরমেশ ও ভাস্কর এগিয়ে যান। প্রায় সাড়ে ছ’শো মিটারের খাড়া দেওয়াল আরোহণ করে ক্যাম্প টু। পরের দিন, ৯ জুন ক্যাম্প থ্রি অর্থাৎ অন্তিম শিবির। আরোহণ ক্রমেই কঠিন হচ্ছিল, প্রতিকূল হচ্ছিল আবহাওয়াও। তাই দেরি না করে সে রাতেই থেন্ডু শেরপার নেতৃত্বে শৃঙ্গের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা।
১০ জুন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সফল হল এত দিনের প্রস্তুতি, এত দিনের স্বপ্ন। ইতিহাস গড়লেন তিন বাঙালি তরুণ। প্রথম বাঙালি দল হিসেবে অবশেষে ইছাপুরের ওএফএমটি-র পতাকা উড়ল স্বর্গারোহিণীর মাথায়। তখনও তাঁরা জানেন না, আর ঘণ্টা দুয়েক পরেই গঢ়বালেরই অন্য শৃঙ্গ নন্দাঘুণ্টিতে উড়বে এইচডিএমটিএ-র পতাকা।
বিশ্রাম। কোয়া রাং-২ শৃঙ্গ অভিযানের সময়।
নন্দাঘুণ্টি শৃঙ্গ ছোঁয়া এইচডিএমটিএ-র সদস্য মলয় জানালেন, প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে গড়া হয়েছিল দল। চার জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষও ছিলেন। ৩০ মে গাড়িতে জোশিমঠ হয়ে রেনি পর্যন্ত পৌঁছনোর পর শুরু হয় ট্রেকিং। পাঁচ দিন হেঁটে বেস ক্যাম্প স্থাপিত হয় রন্টি শৃঙ্গের নীচে, প্রায় ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায়। আরও তিনটে শিবির পেরিয়ে ১০ জুন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ বাঙালির প্রথম আরোহণ করা শৃঙ্গে ফের উড়ল জাতীয় পতাকা, উড়ল হাওড়ার এইচডিএমটিএ-র পতাকা।
ওএফএমটি-র সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘পরিচিত আট হাজারির দৌড়ে নাম লেখানোর চেয়ে নতুন শৃঙ্গ অভিযানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় আমাদের সংগঠনে। প্রথম বাঙালি হিসেবে এ রকম একটা সাফল্য অর্জন করতে পেরে খুশি আমরা।’’
জেইউএমএইচসি-র কোয়া রাং-২ অভিযানে শৃঙ্গছোঁয়া সদস্য মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র প্রসূন দাস বলছিলেন, ‘‘পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর এটাই আমার প্রথম অভিযান। কিছু ভাল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেই গিয়েছিলাম। শৃঙ্গ ছোঁয়াটা বাড়তি পাওনা।’’ একই কথা জানালেন অন্য দুই শৃঙ্গ ছোঁয়া পড়ুয়া ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতায় বর্ষের ছাত্র সুমন সরকার ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র চন্দ্রদীপ কুমারও।
ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৃজন সাহা বললেন, ‘‘ভারতবর্ষের অন্য কোনও ছাত্র-ছাত্রী পরিচালিত পর্বতারোহণ ক্লাব আমাদের মতো এত বড় অভিযানের আয়োজন করে না প্রত্যেক বছর। আর্থিক অসুবিধাটাই আমাদের সব চেয়ে বড় সমস্যা, তা-ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও নিজেদের পকেট মানি মিলিয়ে প্রতি বছরই চার-পাঁচটি অভিযানের আয়োজন করা হয়। তার মধ্যে একটি অবশ্যই ছ’হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার কোনও শৃঙ্গে অভিযান থাকে।’’
বিভিন্ন এজেন্সি-আয়োজিত একক আরোহণ তো রয়েছেই। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই সেই তালিকায় উজ্জ্বল হয়েছে একাধিক বাঙালির নাম। বেশ কয়েকটি আট-হাজারি শৃঙ্গ ছুঁয়ে বাঙালির পর্বতারোহণের ইতিহাসকে তাঁরা এগিয়ে দিয়েছেন এক ধাক্কায়। সেই ভিড়ে হয়তো এই ‘ছোট’, ‘অখ্যাতনামা’ ক্লাবগুলির সাফল্য দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, কিন্তু তবু গৌরবের ভাগ তাদের বড় কম নয়। ইতিহাসের প্রথম পাতায় না-ই বা রইল বিশাল থেকে বিশালতরদের মাঝে এক পাতা জায়গা করাটাই বা কম কথা কীসের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy