Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
এশিয়াডে বাংলার মুখ

মায়ের চোখে জল দেখতে চান তৃষা

ধনুক থেকে তিরটা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে সেকেন্ড কয়েক লাগতে পারে। কিন্তু ওই কয়েকটি মুহূর্তেই মেয়েটির চোখের সামনে একের পর এক ছবি ভেসে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

প্রত্যয়ী: এশিয়ান গেমসে লক্ষ্যভেদের অপেক্ষায় তৃষা। ফাইল চিত্র

প্রত্যয়ী: এশিয়ান গেমসে লক্ষ্যভেদের অপেক্ষায় তৃষা। ফাইল চিত্র

কৌশিক দাশ
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৮ ০৩:০৭
Share: Save:

ধনুক থেকে তিরটা লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে সেকেন্ড কয়েক লাগতে পারে। কিন্তু ওই কয়েকটি মুহূর্তেই মেয়েটির চোখের সামনে একের পর এক ছবি ভেসে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কখনও হয়তো তাঁর মায়ের মুখ, কখনও তাঁর প্রয়াত বাবার মুখ। কখনও সেই সব মানুষের মুখ, যাঁরা তাঁকে বলেছিলেন, এত কম উচ্চতায় তিরন্দাজিতে সফল হওয়া যায় না।

এই সব ছবির মধ্যে একটা ছবি খুব বেশি করে দেখতে চান তৃষা দেব। মায়ের চোখে জল!

ভারতের মুখ হয়ে ওঠা বাংলার এই তিরন্দাজ বলছিলেন, ‘‘জানেন, আমি যখন কোনও প্রতিযোগিতায় হেরে যাই, কেঁদে ফেলি, তখন মা আমাকে সান্ত্বনা দেয়, বোঝায়। চোখের জল মুছিয়ে দেয়। আবার আমি যখন পদক জিতি, মা খুশিতে কেঁদে ফেলে।’’ মা সুপ্রা দেবের এই কান্না আরও একবার দেখতে চান তৃষা। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সোনা জেতার পরে।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা, সদ্য সমাপ্ত বার্লিন বিশ্বকাপে রুপো। এর সঙ্গে যোগ করুন চার বছর আগে এশিয়ান গেমসের কম্পাউন্ড তিরন্দাজিতে জোড়া ব্রোঞ্জ। বছর সাতাশের বঙ্গ তনয়ার কেরিয়ার পদকের আলোয় উজ্জ্বল। কিন্তু এই ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে রয়েছে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের লড়াইয়ের কাহিনি। যেখানে একটা আন্তর্জাতিক মানের ধনুক কেনা ছিল প্রায় স্বপ্নের মতো। সোনপত থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে তৃষা শোনাচ্ছিলেন সেই লড়াইয়ের কাহিনি। ‘‘আন্তর্জাতিক মানের ধনুকের দাম অনেক। যখন শুরু করেছিলাম, একটা ভাল ধনুক জোগাড় করাই খুব কঠিন ছিল। ওই সময় একটা সরকারি স্কিম ছিল, ৭৫ শতাংশ-২৫ শতাংশ। আমাদের পরিবারে তখন কারও কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না। ওই সময় বাড়ি বদলানো হচ্ছিল। মা কোনও ভাবে ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে আমাকে একটা ভাল ধনুক কিনে দেয়।’’

আর্থিক সমস্যা একটা বাধা তো ছিলই। পাশাপাশি ছিল আরও একটা বাধা। তৃষার উচ্চতা (পাঁচ ফুট)। যে উচ্চতার কারণে বার বার তাঁকে হোঁচট খেতে হয়েছে। ‘‘বেশ কয়েক বার টাটা অ্যাকাডেমিতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। বলা হয়, এই উচ্চতায় তিরন্দাজিতে কিছু হবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা ভারতেই আছে। অথচ রিয়ো অলিম্পিক্সে সোনজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েটির (চ্যাং হাই জিন) উচ্চতা কিন্তু বেশ কম,’’ বলছিলেন বরাহনগরের মেয়ে।

কষ্ট পেতেন, যন্ত্রণা হত, কিন্তু লড়াই কখনও ছাড়েননি তৃষা। বছর সাতেক আগে বাংলা থেকে পঞ্জাবে চলে আসেন তিনি। জীবনের মোড় ঘোরাও শুরু ওখান থেকে। বর্তমানে তিরন্দাজির জাতীয় কোচ জীবনজ্যোৎ সিংহের কোচিংয়ে নতুন করে লড়াই শুরু তৃষার। যে লড়াই এনে দিয়েছে একের পর এক আন্তর্জাতিক পদক।

আসন্ন এশিয়ান গেমসে কম্পাউন্ড তিরন্দাজিতে ব্যক্তিগত ইভেন্ট নেই। আছে মিক্সড টিম এবং টিম ইভেন্ট। কী রকম হচ্ছে প্রস্তুতি? তৃষা বলছিলেন, ‘‘আমরা পুরোপুরি তৈরি। জীবনজ্যোৎ স্যর ছাড়াও আমরা ইতালিয়ান কোচের কাছে ট্রেনিং নিয়েছি। উনি জোর দিয়েছেন মানসিক কাঠিন্য বাড়ানোর ওপর। বুঝিয়েছেন, একটা শট বাজে মারলেও কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।’’

চার বছর আগে এশিয়ান গেমস থেকে জোড়া ব্রোঞ্জ জিতলেও খুশি হননি বাবা প্রলয় দেব। চেয়েছিলেন, মেয়ে যেন সোনা জেতে। বছর দু’য়েক আগে বাবা মারা যান তৃষার। বাবার সেই অধরা স্বপ্ন সত্যি করার লক্ষ্যে জাকার্তায় আবার ধনুক তুলে নেবেন তিনি। শপথ নেবেন, আবার যেন দেখতে পান মায়ের অশ্রুসিক্ত মুখখানা! অবশ্যই খুশির অশ্রু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE