গত বছর আই লিগের একটা ডার্বি ম্যাচের দিন গিয়েছিলাম সুপ্রিম কোর্টের এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বাড়িতে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ওরা মোহনবাগান সমর্থক হলেও বাড়ির যে কোনও অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকেন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে এসে বছর সত্তরের মানুষটি বললেন, ‘‘এই যে আমাদের শত্রু এসে গিয়েছেন। আসুন টিভিতে খেলা দেখি। আজ কিন্তু আমরাই জিতব। আপনাকে আমাদের বিরুদ্ধে এত গোল করতে দেখেছি যে যে এখনও শত্রু রয়ে গিয়েছেন।’’ বলেই হাসতে হাসতে হাত ধরে ঘরে ডেকে নিলেন।
চাকরির জন্য ফুটবলার জীবনের শেষ বছরে রেলে চলে গিয়েছিলাম। দরিদ্র পরিবারের ছেলে আমি। হায়দরাবাদ থেকে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে এসেছিলাম বেঁচে থাকার তাগিদে। থাকতাম ইস্টবেঙ্গলের মেসে। কখনও বালিগঞ্জে, কখনও সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কোনও ঘরে অন্য সতীর্থ ফুটবলারদের সঙ্গে। কলকাতায় মাথা গোঁজার একটা ঠাই দরকার ছিল। বাঁচার জন্য টাকারও। ইস্টবেঙ্গলে সব পেলেও ওঁরা আমাকে চাকরি দিতে পারেনি। তাই রেলের প্রস্তাবে রাজি ছিলাম। না হলে লাল-হলুদ জার্সিতেই হয়তো জীবনের শেষ ম্যাচ খেলতাম।
সেটা হয়নি বলে দুঃখ নেই। আসলে আমি তো ইস্টবেঙ্গলেরই। ইস্টবেঙ্গল তো একটা প্রতিষ্ঠান। কোটি কোটি মানুষের ভালবাসার প্রতিষ্ঠান। এখানেই তো জীবনের সেরা ম্যাচ খেলেছি। দেশের হয়ে জোড়া অলিম্পিক্স, দুটো এশিয়ান গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি।। জাকার্তায় সোনা জিতেছি। সব সাফল্যের মঞ্চ এবং ভিত তো সেই লাল-হলুদ জার্সি।
১৯৫৭ থেকে ’৬২—ছয় বছরে ১০৪টে গোল করেছি। নয় বছর পর আমার সময়েই ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ জিতেছিল। সে বার আমি ২৩ টি গোল করে সেরা গোলদাতা হয়েছিলাম। লাল-হলুদ জার্সি তো আমার হৃৎপিন্ড। তবুও খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর আমি ক্লাবে আর পা রাখিনি। সেটা একেবারেই অন্য কারণে। নিজের সম্মানের জন্য। এ বার শুনলাম অধিনায়কদের ডাকা হচ্ছে। সেখানেও হয়তো যাব না। কিন্তু তাতে ইস্টবেঙ্গলের সম্মান একটুও কমবে না। কারণ আমার এখনকার উত্তরপাড়ার বাড়ির পাশের বয়ে যাওয়া গঙ্গার মতোই ইস্টবেঙ্গল পবিত্র। আমার কাছে তীর্থস্থান।
কত স্মৃতি জড়িয়ে এই ক্লাবের সঙ্গে। প্রয়াত ক্লাব সচিব জ্যোতিষচন্দ্র গুহ আমাকে এনেছিলেন এই ক্লাবে। আমাদের সময় কোনও কোচ ছিলেন না। জ্যোতিষবাবু বলতেন, ‘‘সালে, আমেদ, বেঙ্কটেশ এঁদের কোচিং করাবেন কে? ওরাই তো এক একজন প্রতিভাবান। সকালে দু’ঘণ্টা করে অনুশীলন করলেই চলবে।’’ আমরাও সেই দর্শন নিয়েই চলতাম। প্রতিদিন সকালে সবার আগে মাঠে চলে আসতেন জ্যোতিষবাবু। আমরা কখনও তাঁর আগে মাঠে আসতে পারিনি। ডার্বি ম্যাচের আগে অবশ্য অন্য দৃশ্য দেখা যেত ড্রেসিংরুমে। তথন আমরা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচকে বলতাম ‘চ্যারিটি ম্যাচ’। ওই ম্যাচটা জেতার জন্য কর্তা-সদস্য-সমর্থকরা পাগল হয়ে যেত। রাশভারী মানুষ ছিলেন জ্যোতিষবাবু। কিন্তু ওই ম্যাচের আগে এসে আমাদের সঙ্গে তাস আর ক্যারম খেলতেন তিনি। একসঙ্গে খেতেন। তার মধ্যেই আলোচনা করে ঠিক করতেন প্রথম একাদশ কি হবে। কী ভাবে ফর্মেশন হবে। সে ভাবেই আমরা খেলতাম এবং জিততাম। জীবনে যত চ্যারিটি ম্যাচ খেলেছি তাঁর ষাট ভাগই আমরা চুনীদের দলকে (গোস্বামী) হারিয়েছি।
চুনী-আমি একসঙ্গে বাংলার হয়ে খেললেও চ্যারিটি ম্যাচ যা এখন ডার্বি, তাতে দু’জনে ছিলাম প্রবল প্রতিপক্ষ। মাঠের ভিতর যত লড়াই-ই থাক ম্যাচের পর সৌজন্য বিনিময় হত। আমরা জেতার পর ওদের তাঁবুতে যেতাম ‘কোল ড্রিঙ্কস’ খেতে। ওরাও আসত। এবং মজার ব্যাপার হল, চুনী প্রথম আমাকে গ্লাসে ঢেলে ঠান্ডা পানীয় দিত। আমাদের ক্লাবে আসলে ওকে আমি একই ভাবে বরণ করে নিতাম। হেরে গেলে সবাই কাঁদত কিন্তু ঢিল ছুড়ত না। একবার মনে আছে জেতার পর আমরা মোহনবাগান তাঁবুতে গিয়েছি। যত দূর মনে আছে আমার গোলে সে বার হেরেছিল চুনীরা। ঢোকার সময় একজন সবুজ-মেরুন সমর্থক আমাকে লক্ষ করে একটা গালি দিয়েছিল। অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে কার্ড কেড়ে নিয়েছিল। এখন সেই সৌজন্য দেখি না।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, এখনকার চেয়েও আমাদের সময় ডার্বির আবেগ বা উচ্ছ্বাস ছিল অনেক বেশি। তিন দিন আগে থেকে লোকে টিকিটের জন্য লাইন দিত। সাইকেল, ইট দিয়ে লাইন রাখত অন্যদের। একবার কী হল ম্যাচের আগের দিন আমরা অনুশীলনে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন। আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে তাঁকে তুলে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলাম। এবং মাঠে এসে সবাই মিলে শপথ নিলাম মোহনবাগানকে এই ম্যাচটা হারাতেই হবে। জিততে হবে এই সমর্থকের কথা ভেবেই। যাতে উনি হাসপাতালে শুয়ে ইস্টবেঙ্গলের জয়ের কথা শুনে অন্তত আনন্দিত হন। ম্যাচটা আমরা জিতেছিলাম। সে বার সম্ভবত আমি অধিনায়ক ছিলেন।
তখন দিল্লিতে ডুরান্ড কাপ বা ডি সি এম খেলতে গেলে বহু নামী মানুষ আসতেন। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ এসেছিলেন একবার ডার্বি দেখতে। শচীন দেব বর্মণ বা রাহুল দেব বর্মণ ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ সমর্থক। প্রয়াত সুরকার শচীনদেব মনের দিক থেকে এত দুর্বল ছিলেন যে মাঠে খেলা দেখতে আসতেন না। অনুশীলনে আসতেন। আর খেলার সময় ফোন করে স্কোর জানতে চাইতেন। ওর ছেলে রাহুল অবশ্য গ্যালারিতে বসে খেলা দেখত। একবার ডার্বি জেতার আনন্দে রাহুল আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ওদের স্টুডিওতে। ‘রাত কা সামা’ ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছিল তখন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সেখানেই আলাপ হয়েছিল। আমার প্রিয় গায়িকা লতাজি আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। গান শুনে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এ সবই তো ইস্টবেঙ্গলের জন্য। সেই ক্লাবকে ভোলা সম্ভব নয়। এখন তিরাশি বছর বয়স আমার। এখনও রাস্তায় আমাকে দেখলে অনেক প্রবীণ মানুষ বলেন, ‘‘আপনার গোলগুলো এখনও চোখে ভাসে। ডার্বিতে আপনি নামলেই জানতাম ইস্টবেঙ্গল জিতবে।’’ এটা বিরাট পাওয়া। যত দিন বাঁচব এই গৌরব নিয়েই বাঁচব। ইস্টবেঙ্গলের জার্সি গায়ে আমি খেলেছি। জিতেছি। গোল করেছি।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।