গাঢ় লাল আর কালোর কম্বিনেশনে তাঁকে বেশ ভাল মানিয়েছে।
সযত্ন ট্রিম করা দাড়ি, ধারালো গ্রীবা আর হেয়ারস্টাইলের আধুনিকতায় তাঁর ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ ভাবমূর্তি বহু দিন ধরে বিশ্বের ক্রিকেট-বাজারে চালু। তার উপর রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু নতুন যে জার্সিটা আমদানি করেছে তার চোখ ঝলসানো রং-ডিজাইনে তাঁর ‘মাচো লুক’ যেন আরও খুলে দিয়েছে।
চিন্নাস্বামীর একচ্ছত্র মালিকানাও এখন পুরোপুরি তাঁর। স্টেডিয়ামের যেখানে দাঁড়াবেন, সেখানে পাবেন। মাঠে ঢুকেই গেইলের সঙ্গে। ভেতরে ঢুকুন, বিজ্ঞাপনে এবি ডে’ভিলির্য়াসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। আবার আরসিবি টিম বাস, সেখানেও। বাসটাকে যে শুধু নতুন জার্সির আগুন রংয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে তা নয়, সাতাশ বছরের যুবকের বিশাল একটা কাটআউটও বসানো হয়েছে গায়ে। গেইল-এবি, দু’জন দু’পাশে। মধ্যে তিনি বিরাট কোহালি। নীচে দেখা গেল আবার দু’টো খুনে শব্দ। খুব সম্ভবত এ বারের আরসিবি ট্যাগলাইন।
প্লে বোল্ড!
আর সব দেখেশুনে যদি ওই শব্দজোড়াকে আসন্ন আইপিএলে ক্যাপ্টেন কোহালির থিম সং হিসেবে ব্যবহার করতে কারও ইচ্ছে হয়, অন্তত জামানত বাজেয়াপ্ত হবে না। সোমবার সন্ধেয় আরসিবি ক্যাপ্টেনের যে ডাকাবুকো দাদাগিরি চলল, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স সংসারে খোঁজ নিয়ে তাঁর যে বার্তার সারমর্ম পাওয়া গেল, সে সবের মোদ্দা কথা তো ওই একটা— প্লে বোল্ড! শোনা গেল, আইপিএল ট্রফি শৃঙ্গ অভিযানে নেমে আর শূন্য হাতে ফিরতে চাইছেন না বিরাট। দু-দু’বার অধরা ক্রিকেট-শৃঙ্গের শেষ সিঁড়িতে পৌঁছেও রানার্স আপ ট্রফি নিয়ে পোডিয়াম থেকে নামতে হয়েছে। আর কত এ সব ভাল লাগে। কেকেআর দু’বার। চেন্নাই দু’বার। মুম্বই দু’বার। রাজস্থান-হায়দরাবাদেরও একবার করে আছে, আর তিনি বিরাট-রাজা আট বছর ধরে ক্রিকেট-দুনিয়া শাসন করেও কি না একটাও পাননি! আর কত এ সব সহ্য হয়। শোনা গেল, বিরাট নাকি এ বার যে কোনও মূল্যে ট্রফিটা চাইছেন। আরসিবিকে ক্যাপ্টেন নাকি চাইছেন, তাঁর টিম চাপ উড়িয়ে ‘মাচো’ ক্রিকেট খেলুক। আস্কিং রেটের প্রেশার কুকারে সেদ্ধ না হয়ে ফুরফুরে থেকে ম্যাচ করুক।
ক্যাপ্টেন কোহালির এ হেন প্রাক্-আইপিএল তেড়েফুঁড়ে ওঠার পিছনে ওয়াংখেড়ের অভিশপ্ত রাত জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে কি না, কে জানে। আরসিবি সংসারে যোগ দেওয়ার পর কাপ সেমিফাইনালের দুঃখের কোনও টুকরো ছবি নাকি তাঁর মধ্যে দেখেনি কেউ। কিন্তু তা বোধহয় অর্ধসত্য। ওয়াংখেড়ে রাত তাঁকে এত দিন পর বিনিদ্র রজনী উপহার না দিতে পারে। কিন্তু চোরা মনোকষ্ট আছে, এখনও আছে। নইলে পেশাদার ক্রিকেটারের বর্ম ফুঁড়ে সোমবার সে সব প্রপাতের মতো বেরিয়ে আসবে কেন?
বিরাট কোহালি তো তাঁর আইপিএল উদ্বোধনী ম্যাচের আগে বলে ফেললেন, ওয়াংখেড়ে রাত খুব সহজে তাঁর পক্ষে ভোলা সম্ভব হয়নি। বিরাট কোহালি তো বলে ফেললেন, “সেমিফাইনালে ও ভাবে হারাটা মেনে নিতে পারিনি। এত ভাল এগোচ্ছিলাম টুর্নামেন্টে। দারুণ মোমেন্টাম পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি সত্যি আমরা চেয়েছিলাম, শেষ পর্যন্ত যেতে। ব্যক্তিগত ভাবে, আমার সময় লেগেছে সামলাতে। কয়েক দিন লেগেছে।” আরসিবি অধিনায়ককে ঠিক এর পরপরই বলতে শোনা গেল, আইপিএলে এ বারই তাদের জেতার সেরা সুযোগ বলবেন না। কিন্তু এটা ঠিক যে, এ বার অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের ‘দয়া-দাক্ষিণ্যের’ উপর নির্ভর করে আইপিএল ভাগ্য এগোক, তিনি চান না। তাঁকে বেঙ্গালুরুর ফ্র্যাঞ্চাইজি গত আট বছরে অনেক দিয়েছে। এ বার ফ্র্যাঞ্চাইজিকে কিছু ফিরিয়ে দিতে নিজের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ আরও বাড়াতে চান। শোনার পর কেউ যদি ভাবে ওয়াংখেড়ে অভিশাপকে আগামী ২৯ মে-র ওয়াংখেড়ের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন কোহালি, খুব ভুল ভাবা হবে কী?
আর বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের ট্রেলার তো দেখা গেল। টিমের ফুটবল থেকে নেট সেশন, দায়বদ্ধতার প্রতিনাম যদি কেউ সোমবার থেকে থাকেন, তা হলে তিনি কোহালি। নিছকই গা ঘামানোর ফুটবল ম্যাচে গোল করে এমন কিশোরসুলভ আচরণ করতে শুরু করলেন যে দেখলে মনে হবে, লা লিগায় এখুনি বার্সেলোনার বিরুদ্ধে গোল করে উঠলেন! আবার নেট। সেখান থেকে বরাবরের মতো নড়ানো যাচ্ছে না। ঘুরে ঘুরে একবার এটা, একবার ওটা। টিমকেও নিজ-মন্ত্র নাকি দিয়েছেন টুকটাক। শোনা গেল উদাহরণ দিয়ে নাকি বলেছেন যে, শেষ পাঁচ ওভারে যদি ষাটও বাকি থাকে চাপে পড়ার দরকার নেই। টি-টোয়েন্টিতে ওটা এখন জলভাত, মাথা ঠান্ডা রাখলেই তুলে দেওয়া যাবে। এটাও নাকি বলেছেন, আরসিবির যা টিম, প্রত্যেকে তাদের প্রতি প্রত্যাশাটুকু মেটাতে পারলেই চলবে। কেউ ছুঁতে পারবে না।
বেঙ্গালুরু তৈরি হচ্ছে ক্যাপ্টেনকে সামনে রেখে।-পিটিআই
এ সব শুনে যদি রোমাঞ্চকর লাগে, তা হলে বলে রাখা যাক বিরাট রাজার রাজধর্ম বোঝা এখনও বাকি আছে। যেমন গত বার থেকে তাঁর আরসিবির হয়ে ওপেন করার আসল কারণ। ভারতের হয়ে বরাবর তিন নম্বরে নামেন তিনি। কিন্তু গত বার আইপিএল থেকে আচমকাই দেখা যায়, ক্রিস গেইলের সঙ্গে ওপেন করতে যাচ্ছেন। কেন, এত দিন কেউ জানত না। আজ জানল। তিনি বললেন বলে জানল। বিরাটের আরসিবির হয়ে ওপেন করার কারণের নাম এবি ডে’ভিলিয়ার্স। দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটিং-মায়েস্ত্রো যে চার বা পাঁচে অসাধারণ, বিরাট জানেন। কিন্তু জেনেও তাঁকে তিনি ওপেনে পাঠান, যাতে এবিডি একটু খোলামেলা খেলতে পারেন! যাতে একটু বল বেশি পান! “আসলে ওকে দক্ষিণ আফ্রিকার তিনটে ফর্ম্যাটেই পারফরম্যান্সের চাপ নিতে হয়। প্রত্যাশা মেটাতে হয়। ওকে তিনে পাঠানোর কারণ যাতে ওকে একটু রিল্যাক্স করে খেলতে দেওয়া যায়। হয়তো এ বারও করব। আমি ওপেন করতে চাই বলে ওপেন করছি, এমন নয়। এবি তিনে নামলে আমার টিমের বেশি লাভ। তাই আমি ওপেনিংয়ে যাই,” কথাগুলো যখন বলেন বিরাট ভেতরের নির্ভেজাল সত্যতা বাইরে থেকেও অনায়াসে পড়ে ফেলা যায়।
কী বলবেন একে? ভাবা যায়, ভারতের টেস্ট অধিনায়ক দিনের পর দিন নিজ-ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ওপেন করছেন, টিমের প্রিয় সতীর্থের সুবিধের কথা ভেবে! কী ব্যাখ্যা হয় এর?
কেন, কোন যুক্তিতে, ভেবে বোধহয়ও লাভও নেই। জিনিয়াসকে কে কবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে? আর জিনিয়াসের প্রতিভার মতো তার আত্মত্যাগও আম ক্রিকেটারের দেখানো পথে হাঁটবে, সেটাও বা কে বলল?
আরও পড়ুন:
আইপিএলের বিস্তারিত সময়সূচি
আইপিএলের বিস্তারিত পয়েন্ট টেবল