Advertisement
২৮ মার্চ ২০২৩
বিরাট দর্শন

ড্রেসিংরুমে ধোনির গলা এখনও শুনতে পান কোহলি

বিরাট কোহলি এখনও মাঝেমধ্যে গলাটা শুনতে পান। টেস্ট ম্যাচ চললে এখনও মনে হয়, লোকটা নিশ্চয়ই কোথাও বসে আছে। কারও না কারও সঙ্গে ঠিকই কথাবার্তা বলছে। ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এক-এক সময় মনে হয়, ওই তো গলাটা। এখুনি সশরীরে বেরিয়েও আসবে। বিরাট কোহলি আজও নিজের টেস্ট সংসারে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির গলাটা শুনতে পান। অস্তিত্ব টের পান।

হরভজনকে নিয়ে হোটেলে অন্য মেজাজে অধিনায়ক। রবিবার। ছবি: দেবাশিস সেন

হরভজনকে নিয়ে হোটেলে অন্য মেজাজে অধিনায়ক। রবিবার। ছবি: দেবাশিস সেন

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
ফতুল্লা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৫:০৫
Share: Save:

বিরাট কোহলি এখনও মাঝেমধ্যে গলাটা শুনতে পান। টেস্ট ম্যাচ চললে এখনও মনে হয়, লোকটা নিশ্চয়ই কোথাও বসে আছে। কারও না কারও সঙ্গে ঠিকই কথাবার্তা বলছে। ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এক-এক সময় মনে হয়, ওই তো গলাটা। এখুনি সশরীরে বেরিয়েও আসবে।

Advertisement

বিরাট কোহলি আজও নিজের টেস্ট সংসারে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির গলাটা শুনতে পান। অস্তিত্ব টের পান।

প্রথম প্রথম একটু অদ্ভুত লাগত। সচিন-পাজি ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সময় যেমন লাগত। কয়েকটা ম্যাচ কিছুতেই মনকে বিশ্বাস করাতে পারতেন না যে, তেন্ডুলকর আর খেলবেন না। মনে হত, পাজি কাছাকাছি কোথাও আছে। এসে যাবে। ঠিক যেমন আজ মনে হয় ধোনিকে নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভাঙা সিরিজের সিডনিকে যদি অগ্রাহ্য করা যায়, টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তাঁর পূর্ণাঙ্গ সফর শুরু হল পদ্মাপারের ফতুল্লা থেকে। তবু দেখলে মনে হয়, এমএসডির প্রভাব থেকে বেরোতে পারেননি আজও। “খুব অদ্ভুত। সব সময় মনে হয়, এমএসের গলাটা শুনতে পাব। দেখতে পাব। ও টেস্ট ছেড়ে দিল। কিন্তু এখনও ঠিক ঘুরেফিরে ওর নামটা চলে আসে। আলোচনায়। কথাবার্তায়,” ফতুল্লার বৃষ্টিস্নাত সন্ধেয় এক মনে বলে যান ভারত অধিনায়ক।

বিরাট কোহলির হৃদয় বলে, তিনি একটা বীরেন্দ্র সহবাগও আবার পেয়ে গিয়েছেন। শিখর ধবনের ব্যাটিং দেখলে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বীরু’-র বীরগাথা চোখের সামনে ধুলো ঝেড়ে বেরোয়। “ওর ওই মারাত্মক ব্যাটিংটা আমার টিমের লাগবে। এক সময় বীরু যে কাজটা করত, আমার টিমে শিখর সেটা এখন করছে।”

Advertisement

বিরাট কোহলি টিমের অগ্রজকে সম্মান করেন। হরভজন সিংহকে দেশের জার্সিতে দেখলে তাঁর অসম্ভব ভাল লাগে। এক বারও দেশের স্পিন-সিংহকে মনে করাতে যাননি যে, তোমার কামব্যাক হল। বলেছেন এসো, সংসারে আবার এসো। ভাজ্জিপা, এটা তোমার কামব্যাক নয়। কামিং ব্যাক। আনন্দ করতে ফিরে আসা। “ভাজ্জিপা দেশকে কত ম্যাচ জিতিয়েছে! চারশো উইকেট নিয়েছে। আমি বরাবরই সেই বোলারের ভক্ত যে ম্যাচ জিতিয়ে দেবে।”

বিরাট কোহলি রবিবার ভারতবর্ষের নতুন টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে নতুন এক যুগের শালগ্রামশিলা স্থাপন করে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর দেশে টেস্টটা বৃষ্টির দাপুটে ব্যাটিংয়ে জেতা গেল না, কিন্তু টেস্ট পরবর্তী সময়ে অফুরান রোমান্সের অমৃতকুম্ভ দেশবাসীর জন্য রেখে গেলেন। যেখানে হরভজন সিংহের প্রত্যাবর্তনে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পেল। নিজের ভবিষ্যৎ-দর্শন ব্যাখ্যা করে গেলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন, পূর্বসূরির টিমের সাফল্যকে আরও উঁচু শিখরে নিয়ে যাবেন। দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার সময় এ বার তাঁর এসেছে।

চরিত্রগত ভাবে অধুনা ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর মতো আকর্ষণীয় আর কেউ আছে কি না সন্দেহ। ইনি সেঞ্চুরি করে ফ্লাইং কিস উড়িয়ে দিতে পারেন গ্যালারিতে থাকা প্রেমিকার দিকে। অভিমানী প্রেমিকের মতো ডাকতে পারেন প্রেস কনফারেন্স, প্রেমিকার প্রতি কটু মন্তব্যের পাল্টা দিতে। একই লোক আবার রান না পেলে ব্যাটের সঙ্গে একা একা কথা বলতে বসে পড়েন। অনুষ্কা শর্মার মতো মিচেল জনসনের দিকেও তাঁকে চুমু ছুঁড়তে দেখা যায়। দেখা যায়, মাঠে বিপক্ষের সঙ্গে লাগলে জরিমানায় গুলি মেরে কড়া চোখমুখে ছুটে যেতে। এবং ভারতীয় টিমের প্র্যাকটিসে ফুটবল থাকলে তো একটা ব্যাপার অবশ্যই দেখা যায়। ডিফেন্স করছেন। গোল করছেন। করাচ্ছেন। কাটাচ্ছেন। পড়ে যাচ্ছেন। উঠছেন। আবার গোল করছেন। অর্থাত্‌ তাঁর মানসিক বুনোটটাই হল যে ব্যাপারে থাকব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত থাকব। একশো নয়, দেব দু’শো শতাংশ।

বিরাট কোহলি যে দর্শনে এ বার টিমকেও বিশ্বাসী করাতে চান। র‌্যাঙ্কিং তাঁর কাছে গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব পায়, টিমের সাফল্যের সিঁড়ি চড়ার ইচ্ছে। এবং আগামীতে যে বিরাট-দর্শন ভারতীয় ক্রিকেট-উপকূলে আছড়ে পড়তে চলেছে, তার একটা ম্যাপও দিয়ে যান।

টিমে এগারো জনের খিদেটা যেন একই রকম থাকে। বিশেষ করে ফিল্ডিংয়ের সময়। কারণ ফিল্ডিংয়ে টিমের বাকি দশ অধিনায়কের মতো সম-মনোভাবাপন্ন না হলে মুশকিল।

ভারত এ বার থেকে ক্রিকেটের সেই ‘ব্র্যান্ড’টা খেলবে, যা গত অস্ট্রেলিয়া সফরে অ্যাডিলেড টেস্ট দেখেছে। টিম তাতে জিততে পারে। হারতে পারে। কিন্তু ক্রিকেটীয় ব্র্যান্ড পাল্টাবে না।

চারের বদলে টেস্টে পাঁচ বোলার নিয়ে নামাকে অগ্রাধিকার দেবেন। ওটার তিনি ফ্যান! কারণ রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ব্যাটিং গড় চল্লিশ। হরভজন সিংহ যথেষ্ট ভাল ব্যাট করেন। লোয়ার মিডলে ঋদ্ধিমান, অশ্বিন, হরভজন রান পাওয়া শুরু করলে ব্যাটিংটা আট নম্বর পর্যন্ত চলবে।

কল্পনাপ্রসূত মন্তব্য নয়, সবই এ দিন বিরাটের বলে যাওয়া। যিনি এটাও ঘুরিয়ে বললেন যে, টেস্ট ক্রিকেটে যদি রিজার্ভ ডে চালু হয় তাঁর ভোটটা পাওয়া যাবে। “আমি এটা নিয়ে সরাসরি কিছু বলব না। গুড সাজেশন। যদি হয়, ভালই হয়। একটা টিমের জয় নিশ্চিত অথচ বৃষ্টি পড়ছে বলে সময়ভাবে সে জিততে পারছে না, এটাও তো ঠিক নয়,” বলে গেলেন বিরাট। নতুন টেস্ট অধিনায়কের প্রত্যেকটা দর্শন ‘মাচো’। বুঝিয়ে দেন, ছাব্বিশে টেস্ট অধিনায়ক হয়েছেন বলে টেনশনে ছাপ্পান্নর ‘সব দিক বুঝে চলার’ লাগেজ তিনি টানবেন না। কিন্তু এটা দিয়ে শেষ করতে গেলে ব্যাখ্যাটা একমাত্রিক হয়ে যাবে। এটা অধিনায়ক বিরাটের শুধু একটা দিক। অন্য দিকে সে এখনও দেশের আর পাঁচ জন সাধারণ যুবকের এক, যার কাছে ছাব্বিশে টেস্ট ক্যাপ্টেন্সি পাওয়া স্বপ্ন। যে অনর্গল কথা বলতে বলতে হেসে ফেলবে। আগের অধিনায়কের কথা বলতে বলতে আবেগে বিভোর হয়ে যাবে। টিমের ‘বস’ হয়েও বহু দিনের ব্রাত্য সিনিয়রের সম্মানে ঝুঁকিয়ে ফেলবে মাথা।

বিরাট কোহলি আজ থেকে টেস্ট ক্যাপ্টেন্সিতে নতুন অধ্যায় শুরু করে দিতে পারেন। কিন্তু তাঁর ভেতরের ফুটফুটে কিশোরকে বোধহয় কোনও দিন ভুলতে পারবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.