Advertisement
E-Paper

অ্যাডভেঞ্চারে ভয় পায় না বেলজিয়াম

এক সঙ্গে এতগুলো ভাল ফুটবলার কি আর কখনও বেলজিয়ামের জার্সি পরে খেলেছে? খুব কাছের তুলনাও যদি টানা যায়, আমার মনে পড়ছে ১৯৮৬-র দলটার কথা। এনজো শিফোদের সেই দল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে ০-২ গোলে হেরে যায় দিয়েগো মারাদোনার আর্জেন্টিনার কাছে।

ফিলিপ ডি রাইডার

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০৫:৪৩
উচ্ছ্বাস: হলুদ নয়, দেখা গেল লাল জার্সির উৎসব। ছবি: গেটি ইমেজেস।

উচ্ছ্বাস: হলুদ নয়, দেখা গেল লাল জার্সির উৎসব। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শনিবার রাতে এডেন অ্যাজার, রোমেলু লুকাকুদের সামনে ব্রাজিলের মতো ফেভারিট দলকে বিপর্যস্ত হতে দেখে আমার দেশের এক ফুটবল অ্যাকাডেমির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ‘আন্দারলেখ্ত সেন্টার অব এক্সেলেন্স’। যেখানে বেলজিয়ামের খুদে প্রতিভাদের লড়াই করতে শেখানো হয়। যেখানে আমাদের দেশের উঠতি ফুটবলাররা প্রথম শেখে, কী ভাবে না হারা পর্যন্ত হার মানতে নেই। যেখানে ফুটবলার নয়, সৈনিক তৈরি করা হয়।

বেলজিয়াম ফুটবলের সেরা কারখানা এই অ্যাকাডেমি। এখান থেকেই লুকাকু, ভ্যানসঁ কোম্পানি, দ্রিস মের্তেন্স, আদনান ইয়ানুজাই, মারুয়ান ফেলাইনিরা তৈরি হয়েছে। যে বেলজিয়াম দলটা শনিবার রাতে ব্রাজিলকে ২-১ হারিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠল, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ফুটবলার এই অ্যাকাডেমির ফসল। ব্রাসেলসের অভ্যন্তরে অবস্থিত এই অ্যাকাডেমিতে কিশোর বয়স থেকে জোর দেওয়া হয় ফিটনেসের উপর। স্কিল গড়ে তোলার উপর। স্ট্রাইকার হলে তাকে বিশেষ ভাবে শেখানো হয়, কী ভাবে মাটিতে এবং শূন্যে গোল করতে হবে। বেলজিয়াম এই বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন পর্ব থেকে শুরু করে সব চেয়ে বেশি গোল করা দল। সেটা রাতারাতি ঘটেনি। এই গোলের সাফল্যের পিছনে রয়েছে আমাদের দেশের অ্যাকাডেমির হাত। সেখানকার কোচেরা স্ট্রাইকারদের বিশেষ ধরনের ‘ড্রিলস’ শেখান। হয়তো দেখা যাবে আধ ঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অ্যাকাডেমির খুদে স্ট্রাইকাররা ড্রিবল অনুশীলন করছে। বা শূন্যে লাফিয়ে হেড করে গোল করার অনুশীলন করছে। সব কিছুতে পেশাদারিত্বের ছাপ। কোম্পানি, লুকাকুদের বিশ্বকাপ সাফল্যে কোথাও যেন আমাদের দেশের ফুটবল কারখানাও জিতছে।

আমাদের দেশে তিনটি বড় ক্লাব আছে। আন্দারলেখ্ত, ব্রাহ্ এবং স্তাদাঁ লিয়েজে। ঘরোয়া ফুটবলকে শাসন করে এরাই। এখান থেকেই দেশের সেরা ফুটবলাররা বেরিয়ে আসে। বিশ্ব ফুটবলে ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ, স্পেনের লা লিগা বা জার্মানির বুন্দেশলিগা নিয়ে মেতে থাকেন ভক্তরা। ইটালীয় লিগ আগে খুব শক্তিশালী ছিল। বেলজিয়ামের ফুটবল লিগ নিয়ে সে ভাবে হয়তো কিছু শোনা যায় না। আমাদের দেশে কিন্তু অনেক সময় অনেক ভাল বিদেশি ফুটবলারও খেলে গিয়েছে। বেলজিয়ামের ক্লাবগুলোতে খেলে গিয়েছে ইয়া ইয়া তোরে, দানিয়েল আমোকাচি, আন্তোলিন আলকারাজরা। কিন্তু সে সবই হয়তো ঝলক ছিল। মনে রাখার মতো কিছু নয়। বেলজিয়ামের এই দলটাকে নিয়ে প্রত্যেক পদক্ষেপে দেশের মানুষ খবর রাখে কারণ, ওদের মনে করা হয় সোনার প্রজন্মের দল।

এক সঙ্গে এতগুলো ভাল ফুটবলার কি আর কখনও বেলজিয়ামের জার্সি পরে খেলেছে? খুব কাছের তুলনাও যদি টানা যায়, আমার মনে পড়ছে ১৯৮৬-র দলটার কথা। এনজো শিফোদের সেই দল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে ০-২ গোলে হেরে যায় দিয়েগো মারাদোনার আর্জেন্টিনার কাছে। সে বার আমাদের হারিয়ে ফাইনালে উঠে বিশ্বকাপ জেতে মারাদোনার দল। দু’টো গোলই ছিল মারাদোনার। তৃতীয় স্থান দখলের ম্যাচে আমরা হেরে যাই ফ্রান্সের কাছে। আর ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারায় জার্মানিকে। অনেকে হয়তো পুরনো সেই ঘটনা ভুলে গিয়েছে। বেলজিয়ামের মানুষ কিন্তু সেই যন্ত্রণার রাত ভোলেনি। সেই কারণেই শনিবার এক হেভিওয়েট দলকে হারানোটা আমাদের কাছে এতটা মধুর। এত কাল ভাল দল থাকলেও আমাদের শুনতে হয়েছে, বেলজিয়াম কখনও বিশ্ব মঞ্চে বড়দের হারাতে পারবে না। যত ভাল দলই হোক, ওরা বড় দলের সামনে পড়লে ‘চোক’ করে যাবে। সেই ‘চোকার্স’ তকমা উড়িয়ে দিতে পেরেছে লুকাকুরা। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে, বেলজিয়ামও ফুটবল খেলতে পারে এবং বড়দের হারাতে পারে।

বেলজিয়াম কখনও বিশ্বকাপের ফাইনালই খেলতে পারেনি, জেতা তো দূরের কথা। কিন্তু এ বারে অ্যাজার, কোম্পানি, লুকাকুরা স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ব্রাজিলের শিল্প হয়তো আমাদের নেই। স্পেনের তিকিতাকা জাদু হয়তো আমাদের খেলায় দেখা যাবে না। কিন্তু শক্তি এবং স্কিলের মিশ্রণে ফুটবল ভক্তদের মন জিতে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। কেভিন দে ব্রুইন যে দূরপাল্লার শটে গোলটা করল, সেটা এই বিশ্বকাপের সেরার তালিকায় ঢুকে পড়েছে। অ্যাজার বেলজিয়ামের ১০ নম্বর। ওর চেয়ে অনেক বেশি মাতামাতি হয় ব্রাজিলের ১০ নম্বরকে নিয়ে। স্বাভাবিক, সেই ফুটবলারের নাম যে নেমার দা সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র)। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচে না পড়ে অ্যাজার দেখিয়ে দিল, ও কারও চেয়ে কম যায় না। দুই দশ নম্বরের দ্বৈরথে কে জিতল? এই প্রশ্ন করলে শনিবার রাতের পরে কিন্তু উত্তর হবে নেমার নয়, অ্যাজারই। তেমনই ব্রাজিলের ডিফেন্সে ঝড় তুলল লুকাকুর দৌড়। তবে দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে এসেছিল ব্রাজিল। ওদের একের পর এক আক্রমণ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। ২-১ হওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, সত্যিই না আর একটা গোল করে দেয় নেমাররা। অতীতে ভাগ্য সঙ্গে না থাকায় আমাদের নক-আউট পর্ব থেকে ছিটকে যেতে হয়েছে। এ বারে অবশ্য ভাগ্য সঙ্গে থাকল। সামনে এ বার ফ্রান্স। দুরন্ত ফর্মে আছে ওরা। গ্রিজম্যান, পোগবা, এমবাপে, জিহু, ভারান— দুর্দান্ত সব ফুটবলার রয়েছে ওদের।

সে সব মাথায় রেখেও একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। টিনটিনের দেশ বেলজিয়াম। অ্যাডভেঞ্চারকে আমরা ভয় পাই না, ভালবাসি!

(লেখক বেলজিয়ামের জাতীয় জুনিয়র দলে খেলেছেন। কোচিং করে গিয়েছেন কলকাতায়।)

Football FIFA World Cup 2018 বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ Romelu Lukaku Belgium
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy